‘আমি সবাইকে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দেই’

মাহেলা জয়াবর্ধ্বনে ছিলেন শ্রীলঙ্কার সবচাইতে সফল অধিনায়কদের একজন। অধিনায়ক হিসেবে সফল হবার পর কোচ হিসেবেও নিজের ছাপ রেখে যাচ্ছেন তিনি। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের দায়িত্ব নিয়েই একের পর এক দেখছেন সফলতার মুখ। এই যে প্রথমে অধিনায়ক আর এরপর কোচ, এই যুগপৎ সফলতা তো চাট্টিখানি কথা নয়। নিজের পরিকল্পনা আর কৌশল নিয়ে ইএসপিএন ক্রিকইনফোর দ্য ক্রিকেট মান্থলিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মাহেলা জয়াবর্ধ্বনে। খেলা ৭১ এর পাঠকদের জন্যে সেই সাক্ষাৎকারটি দেওয়া হল।

আপনি যখন স্কুলটিমে ছিলেন তখন থেকেই আপনি অধিনায়কত্ব করছেন। দলের খেলোয়াড়দের সামলানোর ক্ষেত্রে কোন ব্যাপারটি আপনি প্রথম শিখেছিলেন?

অনূর্ধ্ব-১৩ আর অনূর্ধ্ব-১৫ এর কথা যদি আমি বলি, আমি এমন সব খেলোয়াড় বাছাই করার চেষ্টা করতাম যারা ম্যাচের বিভিন্ন সময়ে বল করতে জানে, যারা ম্যাচটা কঠিন হলেও ঠান্ডা মাথায় বল করতে জানে। আমি এমন বোলার খুঁজতাম যারা উইকেট টু উইকেট বল করতে জানে, কাজটা মোটেও কঠিন ছিল না। এবং অবশ্যই যারা ডানহাতি আর বাঁহাতি উভয়ের বিপক্ষেই সাচ্ছন্দ্য।

প্লেয়ার ম্যানেজমেন্টে শ্রীলঙ্কার অধিনায়কদের কাছ থেকে কি শিখেছিলেন?

আমি তিন বছর অর্জুনা রানাতুঙ্গা আর তিন বছর সনাথ জয়াসুরিয়ার অধিনায়কত্বে খেলেছি। এরপর হাশান তিলকারত্নে আর মারভান আতাপাত্তুও ছিলেন কিছুদিন। দুই বছর আমি সনাথ জয়াসুরিয়ার ডেপুটি হিসেবেও কাজ করেছি। ঐ সময়ই আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণে অধিনায়কের মতের একটা অংশ হয়ে যাই।

সনাথ জয়াসুরিয়া একজন জাত নেতার চাইতেও বেশি কিছু ছিলেন, মাঠেও তিনি ছিলেন ভীষণ তৎপর। এদিক দিয়ে হাশান তিলকারত্নে ছিলেন পরিকল্পিত অধিনায়ক যিনি পরিকল্পনা মানতে পছন্দ করতেন। আতাপাত্তুও অনেকটা এমনই ছিলেন। আসলে ঠিক বা বেঠিক বলে কিছু নেই, আমি আমার পুরো ক্যারিয়ারে অনেক ভুল করেছি।

আগের অধিনায়কদের এমন কোন ঘটনা কি আছে যা আপনাকে ভীষণ প্রভাবিত করেছিল?

এমন ঘটনা আসলে প্রচুর। সত্যি কথা বলতে, খুব সময়ই খেলার ক্ষেত্রে আমাকে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা দেওয়া হত। এই ব্যাপারটা আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল যখন আমি অধিনায়ক হয়েছিলাম। আমি দলে একটা ভিন্ন সংস্কৃতি আনতে চেয়েছিলাম। আমি চাইতাম দলের তরুণ সদস্যরা যেন পর্যাপ্ত স্বাধীনতা পায়, তারা যেন তাদের রেসপনসিবিলিটা ঠিকঠাক বুঝতে পারে। আমি যখন তরুণ ছিলাম, আমাকে বলা হয়েছিল আমাকে অপেক্ষা করতে হবে আমার সময় আসা পর্যন্ত। কিন্তু আমি যখন অধিনায়ক হলাম, আমি এই সংস্কৃতিটা পরিবর্তন করতে চেয়েছিলাম। সত্যি বলতে তা পেরেছিলামও। আমি কখনই চাইনি, আমার সাথে যা হয়েছিল তা অন্য কারো সাথে হোক।

মাঠে যেটা হয় সেটা আসলে খুবই ন্যাচারাল। একটা ঘটনা ঘটবে, আপনি প্রতিক্রিয়া দেবেন আর সেখান থেকেই শিখবেন। এভাবেই তো একজন তরুণ আস্তে আস্তে বড় হবে। আমি চাইতাম, শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে এমন এক সংস্কৃতি তৈরি করতে যা নিয়ে তারা গর্ব করতে পারে। বাকি অধিনায়কেরাও বিভিন্ন পরিবর্তন এনেছেন, অবশ্যই শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের ভালর জন্যেই এনেছেন, যেমন অর্জুনা আর জয়াসুরিয়া। কিন্তু আমি চাইতাম, তাদের রেখে যাওয়া ব্যাপারগুলোকে আরো ভালো করতে।

তরুণ খেলোয়াড়দের সামলানো কি সিনিয়র খেলোয়াড়দের সামলানো থেকে সহজ?

দুটোই আসলে সমান, কঠিন বা সহজ বলে কিছু নেই। খেলোয়াড় সিনিয়র হোক বা জুনিয়র, আপনাকে বুঝতে হবে তার প্লেয়িং ক্যারেক্টার কেমন, কোন রোলটা সে সামলাতে পারবে, আর কোন কোন রোলে সে কমফর্টেবল না। তরুণ খেলোয়াড়দের একটু স্বাধীনতা দিই আমি, যেহেতু তারা একদম নতুন। তবে এই স্বাধীনতাটাকে কাজেও লাগানো চাই। যেমন ধরুণ, মাঝেমাঝে তারা হাত খুলে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলে যেটা কিনা দলের জন্যে আসলেই খুব ভাল অস্ত্র। তবে এই স্বাধীনতা দেওয়াতে তারা উইকেট ছুড়ে প্যাভিলিয়নেও ফিরে আসে। কারণ তারা নতুন, অভিজ্ঞতা কম আর ম্যাচের সিচুয়েশনও বোঝার মত সক্ষমতা নেই।

সিনিয়র প্লেয়ারদের আমি বলি একটু বেশি রেসপনসিবিলিটি নিতে, ক্যালকুলেটিভ রিস্ক নিতে। এটা কেমন? এটা হল তাদের যে রোলটা দেওয়া হয় দল থেকে তারা যেন তা ঠিকঠাকভাবে পালন করে। আর অধিনায়ক হিসেবে আপনাকে আরেকটা ব্যাপারও বুঝতে হবে। দলের সব ক্রিকেটাররা একই সংস্কৃতি আর পরিবার থেকে আসেনা। তারা ভিন্ন পরিবার, ভিন্ন সমাজ, ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে আসে। আপনাকে অধিনায়ক হিসেবে এসব সামঞ্জস্য করে ঠিকঠাকভাবে সুবিধাটা নিতে হবে।

একটা উদাহরণ দিন, একজন খেলোয়াড় যখন আপনার অধীনে আসে, আপনি তাকে কিভাবে সামলান?

উদাহরণ চাইলে আমি লাসিথ মালিঙ্গার কথা বলব। ও যখন দলে আসল, আমরা ওকে সময় দিয়েছিলাম বেড়ে ওঠার জন্যে। ওকে আমরা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ফেলে দেখতে চাইতাম।ও কথা খুব কম বলত, তবে ওর সামর্থ্য সম্বন্ধে আমরা জানতাম। ওর বোলিং অ্যাকশন ছিল ইউনিক, এটা দলের জন্যে একটা সুবিধা ছিল। দলে আসার পর ও স্লোয়ার শিখল, বাউন্সার শিখল,এরপর ওর শিখতে হত এই সব কিছু ম্যাচে ঠিকঠাকভাবে কাজে লাগানো। এজন্যে আমরা ওকে গভীর পরিস্থিতিগুলোতে ফেলতে চাইতাম, ও যাতে সেখান থেকে শিখতে পারে।

সত্যি কথা বলতে, অন্য বোলারদেরকে আমি মালিঙ্গার মত এত ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ফেলে শেখাতে চাইনি। কারণ, অন্যদের মালিঙ্গার মত স্কিল নেই, যাতে তারা মালিঙ্গার মত দ্রুত শিখতে পারবে। যেমন নুয়ানে কুলাসেরাকার কথাই ধরুন, ওকে আমি সামলেছিলাম অন্যভাবে। আবার অজন্তা মেন্ডিস যখন দলে আসল, ওর সামর্থ্যও ছিল মালিঙ্গার মত। তাই ওকেও ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ফেলতে চাইতাম। আর এসবই আমি করতে পারতাম কারণ মেন্টর হিসেবে চামিন্দা ভাস আর মুত্তিয়া মুরালিধরণের মত কেউ আমার পাশে ছিল।

ব্যাটসম্যানদের কথা বললে, তরুণ ব্যাটসম্যানেরা সবাই একই রকম। মাঝেমধ্যে ভাল ইনিংস খেলবে, মাঝেমধ্যে রান পাবেনা । সে সময় অধিনায়ক হিসেবে আপনাকে তাদের সাথে বসতে হবে,বলতে হবে, ‘তুমি চাইলে আরেকটু চাপ নিতে পার।’ এটাকে আমি বলতাম ‘গিয়ার’। মাঝেমধ্যে ব্যাটসম্যানেরা ফোর্থ বা ফিফথ গিয়ারে ব্যাট করত,দেখতও না বোলারটা টপ ফর্মে আছে! তরুণ ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে আপনাকে সবসময়ই ধৈর্য্য ধরতে হবে। এই ধৈর্য্যটা তাদেরকে আত্মবিশ্বাস যোগাবে পরের পরিস্থিতিগুলো সামলানোর জন্যে।

‘ভিন্ন ভিন্ন খেলোয়াড়দের ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ট্রিট করতে হয়’ এ ব্যাপারে আপনার কি মত?

আমি প্রত্যেক ইন্ডিভিজুয়াল খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে সৎ থাকতাম, তাদের পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতাম আমি কি চাই। বেশিরভাগ খেলোয়াড়েরাই আমাকে তা এনে দিত। আমি কিন্তু জুনিয়রদের কোনকিছুতে জোর করতাম না। আমি তাদের স্বাধীনতা দিতাম,সাথে রেসপনসিবিলিটিটাও বুঝিয়ে দিতাম। এতে তারা দলে অবদান রাখত।
আবার অধিনায়ক থাকার সময় অনেক সিনিয়র খেলোয়াড় আমার অধীনে ছিল। তাদেরও আমি রেসপনসিবিলিটিটা বুঝিয়ে দিতাম। আপনি যেটা বললেন,এগুলো আসলে দলে কখনও ইস্যু হয়নি। অনেক সময়ই সিনিয়ররা জুনিয়রদের ট্রাকে ওঠাতে সাহায্য করেছে।

মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের ক্ষেত্রেও কি আপনি এই একই পদ্ধতি অনুসরণ করেন?

ঠিক তাই। আমি মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে দলের পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করি। তবে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা ঘটে, এখানে প্রচুর অভিজ্ঞ খেলোয়াড় আছেন। যে তিন চারজন আছে তরুণ- তারাও আসলে প্রচুর ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলে এসেছে। সে হিসেবে তারা সবাই অনেক পরিণত। তাই তাদের প্রত্যেকের অবদান আমি দলে চাই। কোচ হিসেবে আমি অধিনায়ককে শুধু আইডিয়া শেয়ার করি, কারণ মাঠে দলটা তাকেই সামলাতে হয়। তাই যত বেশি আইডিয়া তাকে দেওয়া যাবে, তার জন্যে প্রসেসটা তত বেশি সহজ হবে।

ওহ, আরেকটা ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হয়। সিদ্ধান্ত যেমনই হোক, সেই সিদ্ধান্তকে যেন দলের সব সদস্য সম্মান করে। অধিনায়কের জন্যে কাজটা কিন্তু মোটেই সহজ নয়। দিনশেষে তাকেই বিশ্লেষণ করতে হয়। তাই দলে এমন একটা পরিবেশ আমি তৈরি করি, যেন সবাই দলীয় সিদ্ধান্তকে সম্মান করে।

‘বড় ইগো’ গুলোকে আপনি কিভাবে সামলান?

আমার কাছে এই ইগোগুলোকে খারাপ মনে হয় না আসলে, এটা থাকা উচিত। এটাই আপনাকে আপনি যা করতে চান তা নিয়ে আপনাকে আরো বেশি নিশ্চয়তা দেবে। সবাইকেই আসলে কিছু না কিছু এমন আচরণ গড়ে তোলা উচিত।

কিন্তু এমন কি কখনও হয়নি যে কারো ইগো দলের উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে গেছে?

সত্যি বলতে, না! ব্যাপারটা আসলে সবার সাথে পেশাদার আচরণ করা, সম্মানের সাথে আচরণ করা। দলে এই সংস্কৃতিটা গড়ে তোলা খুবই জরুরী। আর একবার এই সংস্কৃতিটা তৈরি হয়ে গেলে, যেকোন একজনের পক্ষে এটার বিপক্ষে যাওয়া কঠিন। কারণ তাহলে দলের বাকি খেলোয়াড়দের থেকেই সে আলাদা হয়ে যাবে। কিন্তু যদি আপনি দলের পরিবেশে এই সংস্কৃতিটা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হন, আপনি সমস্যায় পড়বেন। কিন্তু এই সংস্কৃতিটা গড়ে তুললে এরপর সবাইকে তার আওতায় আনা সহজ। এছাড়া আমি সবাইকে পর্যাপ্ত স্বাধীনতাও দেই যাতে তারা মত প্রকাশ করতে পারে।

ধরা যাক, আপনার দলে খুব ট্যালেন্টেড একজন খেলোয়াড় আছে যে কিনা কিছু সময়ের জন্যে পারফর্ম করতে পারছেনা। এই ব্যাপারগুলো কিভাবে সামলান?

আমি আসলে ফর্মে থাকা বা না থাকা এই ব্যাপারটাতে বিশ্বাসই করিনা। মাঝেমাঝে এমনও হয় আপনি ব্যাটের একজন মাঝখানেই বলকে হিট করছেন, কিন্তু বলটা হয়তো গ্যাপে যাচ্ছেনা। সব খেলোয়াড়ই আসলে এসবের মধ্যে দিয়ে যায়। তখন বুঝতে হয়, খেলোয়াড়টি আসলে কি চাইছে। তার এই সমস্যা থেকে উত্তোরণের জন্যে হয়তো কিছু আত্মবিশ্বাস দরকার, কিংবা তার টেকনিক্যালি কিছু পরিবর্তন দরকার, অথবা এমনও হতে পারে তার আসলে কিছুই দরকার না। মাঝেমাঝে এমনও হতে পারে, যে আপনি দুটো খারাপ শট খেলে আউট হলেন, এরপর দুটো ভাল ডেলিভারিতেও আউট হলেন, শেষে দেখা গেল আপনি টানা চার ইনিংসে ব্যার্থ। আপনাকে তখন এই ব্যাপারটা এভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে- হ্যা, আপনি দুটো খারাপ শট খেলেছেন, আপনার এই দুই বলে কাজ করা দরকার। কিন্তু দুটো ভাল ডেলিভারির ব্যাপারে আপনার তো কিছুই করার নেই।

আর এই ব্যাপারগুলো সব খেলোয়াড়কে বোঝানোর প্রসেসটাও আসলে একই হয়না। আপনাকে বুঝতে হবে খেলোয়াড়টি কেমন, সে কিভাবে চিন্তা করে। মনে রাখতে হবে, কোচ হিসেবে তার সাথে আমাকে কথা বলতে হবে সমাধান বের করার জন্যে। মোটেও কোনকিছু তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্যে নয়।

কখনও কি এমন মনে হয়েছে যে ড্রেসিং রুমে লিডার হিসেবে আপনার যতটুকু নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত ছিল ততটুকু নেই?

এরকমটা আসলে হয়নি। সত্যি কথা বলতে, আমি যেটাই করি না কেন আমি সবার প্রতি সৎ থাকার চেষ্টা করি। যেসব খেলোয়াড়েরাই এই এত বছরে আমার অধীনে অন্তত একটা ম্যাচও খেলেছে, তারা এটা জানে। আমাদের কথাবার্তা হয় খুবই সৎ। দলীয় কোন ব্যাপার আমি ব্যাক্তিগতভাবে নিই না। এভাবেই আমি ব্যাপারগুলোর দিকে আগাই। আর এখানে সবাই পেশাদার আর পরিণত। আপনাকে শুধু পারস্পরিক সম্মানের ব্যাপারটাই তৈরি করতে হবে। যদি দলে স্বচ্ছতা থাকে, কোন এজেন্ডা না থাকে, খেলোয়াড়েরা এটা বুঝে। আর তাছাড়াও, যেটাই হোক না কেন- কোচ বা অধিনায়ক যেটাই আমি থাকিনা কেন, আমি সবসময়ই খেলোয়াড়দের ঢাল হিসেবে থাকি। আমি সবসময়ই খেলোয়াড়দের পক্ষে।

অধিনায়ক হিসেবে আর কোচ হিসেবে দায়িত্ব- প্লেয়ার ম্যানেজমেন্টে এই দুই দায়িত্বের তফাৎ কোথায়?

দুটোই সমান। শুধু একটা ব্যাপারে খানিকটা পার্থক্য আছে। কোচ হিসেবে ম্যাচের মাঝে কি হচ্ছে তার ওপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।

আপনি এখন ব্যাবসাতেও হাত দিয়েছেন, অনেক মানবিক কাজ করছেন, বাবা হয়েছেন, এসব অভিজ্ঞতা আপনার কাজে কোন সাহায্য করে কিনা?

দেখুন, আমার কাছে ওটা কোন ‘কাজ’ নয়। আর এটাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমি যখন অন্য কাজ করি, এটা সবকিছুকে ব্যালেন্স করেই করি। কিন্তু, আমি যখন ক্রিকেটে অন্তর্ভুক্ত হই, এটা আমার নিজের সন্তুষ্টি আর আনন্দের জন্যেই। ক্রিকেট আমার কাছে এক ধরণের চ্যালেঞ্জ, কিন্তু কখনওই ‘কাজ’ নয়। আমি এই ব্যাপারে চিন্তাও করি খুব সাধারণভাবে। ভুল কোন কারণে আমি কখনও সিদ্ধান্ত নিই না, তাই ঐ ব্যাপারে আমি নির্ভরশীলও নই।

আর ব্যাবসার ক্ষেত্রে, এটা আমার কাছে নতুন। আমি প্রতিদিনই এখানে কিছু না কিছু শিখি। এটা আমাকে মাটিতে নামিয়ে রাখে। আমি ২০ বছর ধরে ক্রিকেট খেলেছি, এখনও এখানেই অন্তর্ভুক্ত আছি, ক্রিকেটে অনেক কিছু শিখেছি। কিন্তু ব্যাবসাটা আমার কাছে একদম নতুন। এখানে প্রতিদিনই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসে আর তার জন্যে আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে, সব সমস্যার সমাধান আছে। আপনাকে শুধু সেটা খুঁজে বের করতে হবে। ব্যাবসার ক্ষেত্রে, এটা এমন যে আপনাকে সুযোগসন্ধানী হতে হবে, রিস্ক নিতে হবে। সেই রিস্ক মাঝেমাঝে কাজ করবে, মাঝেমাঝে কাজ করবে না। আপনাকে শুধু নিশ্চিত হতে হবে, আপনার প্রসেস আর চিন্তা করার ধরণ ঠিক ছিল। তাহলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন কোনটা আপনার ভুল ছিল আর কোনটা আপনি ঠিক হওয়া সত্ত্বেও কাজ করেনি।

শ্রীলঙ্কা আপনার অধীনে অসাধারণ সব টুর্নামেন্ট খেলেছে। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়েও আপনি দ্রুতই ট্রফি জিতে চলেছেন। এমন কি আলাদা কিছু আছে যেটা টুর্নামেন্টে খেলোয়াড়দের তৈরি রাখতে করেন?

মূল চাবিকাঠিই হল মাইন্ডসেট। কোন ধরণের জটিলতা ছাড়াই তাদের ম্যাচের জন্যে প্রস্তুত রাখতে হবে। আমি নিজে বিশ্বাস করি ক্রিকেট একটি খুব সহজ খেলা- রান আর উইকেটের খেলা! খেলোয়াড়দের এই দুই কাজেই মনোযোগী করে তুলতে হবে। ট্যাকটিকস আর প্লানিং অবশ্যই সাহায্য করে- কিন্তু মূল কাজটা খেলোয়াড়দেরই করতে হয়। আর ব্যাক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, দলের পরিবেশটাই সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ । কোচ হিসেবে আমাকে শুধু একবার এটা তৈরি করে দিতে হবে, এরপর খেলোয়াড়েরা স্বাভাবিক প্রসেসেই খেলবে।

আর টুর্নামেন্টগুলিতে আমাকে নিশ্চিত হতে হবে দলের সবাই একই জোনে আছে কিনা । লম্বা টুর্নামেন্টগুলিতে ‘আপস এন্ড ডাউনস’ থাকবেই, কিন্তু শেষে সবাই যেন ফ্রেশ থাকে আর সামনে আগানোর জন্যে তৈরি থাকে এটাই খেয়াল রাখতে হয়। এটাই তো দরকার হয় ফাইনাল স্প্রিন্টের জন্যে। যেমন ধরুন, ৫ কিমি বা ১০ কিমি ম্যারাথনে, আপনি ল্যাপ্সগুলিতে ধারাবাহিক থাকলেন, কিন্তু যা আপনি চাইছেন তা পেতে শেষ ল্যাপ্সেই যা করার করতে হবে। আর এজন্যে আপনার এমন কিছু খেলোয়াড় দরকার যারা কিনা শান্ত আর সংঘবদ্ধ।

আপনি যখন খেলতেন তখন ‘ডাটা’ এত বড় ব্যাপার ছিল না, যেটা কিনা এখন হয়েছে। টি-টোয়েন্টি ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টগুলিতে আপনি খেলোয়াড়দের ডাটা কিভাবে ব্যাবহার করেন?

আমার মনে হয়, ম্যানেজমেন্টের কাছে কি হচ্ছে আর কোন প্যাটার্নে ডাটা কি হতে পারে তা বুঝতে ডাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটা ঐ ম্যানেজমেন্টের জন্যেই শুধু, এটা খেলোয়াড়দের কোন সাহায্য করেনা। তাদের সাহায্যের জন্যে, আমাকে নিজে তাদের সাথে কথা বলতে হয়। আর এই কথা বলার জন্যে তো আমাকে বুঝতে হয় কি হচ্ছে বা কি প্যাটার্নে হতে পারে। আর তাছাড়া, ডাটা, এনালাইসিস এসব প্রচুর পরিমাণে থাকে, আমাকেও বুঝতে হয় কোনটা ব্যাবহারযোগ্য আর কোনটা নয়।

তবে কিছু খেলোয়াড় আছে, যারা এসব জেনে খেলাটাকে আরো উপভোগ করে, ডাটা কিছু সাহায্যও করে। কিন্তু এ ধরণের খেলোয়াড় কম, বেশিরভাগই নিজেদের খেলা খেলতেই পছন্দ করে। আর কিছু খেলোয়াড় তো আছে ন্যাচারালি গিফটেড, তারা স্বপ্রবৃত্ত হয়েই নিজেদের মত করেই সবকিছু সামলে ফেলে। আমি যখন খেলতাম, আমি এমন খেলোয়াড় ছিলাম।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link