ধিশালের শূন্যতা নিয়ে মাহেলার মহাকাব্যিক যাত্রা

যখনই মাহেলা ব্যাট হাতে নামতেন, স্বয়ং ঈশ্বর নেমে এসেছেন তাঁর কাঁধে হাত রেখে, আর ধিশাল দাঁড়িয়ে আছে প্যাভিলিয়নের ঠিক গেটের পাশে, নি:শব্দ হাসিতে। মাহেলাও জানতেন, ধিশাল আছেন!

খেলাই ছেড়ে দিয়েছিলেন মাহেলা জয়াবর্ধনে। তখন সদ্য কৈশোর পেরিয়েছেন। কারণ জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিটা বয়ে গেছে জীবনে —চুপিচুপি। একটা হাহাকার হয়ে। একটা অসমাপ্ত ইনিংস হয়ে।

ছোট ভাইয়ের নাম ছিল ধিশাল। মাহেলার চেয়ে বছর দেড়েকের ছোট। দস্যিপনায় টগবগে, উচ্ছ্বল। ছোট ভাইয়ের সব খেলাধুলায়, দুষ্টুমিতে মা-বাবা হয়রান, কিন্তু মাহেলার ছিল একটা অদ্ভুত ধৈর্য। দুই ভাইয়ের মধ্যে চরিত্রগত পার্থক্য ছিল বিস্তর — তবুও তাদের সবচেয়ে বড় মিল ছিল ক্রিকেট।

স্কুলের মাঠে ধিশাল খেলতো বড় ভাইয়ের নেতৃত্বে। বাঁ-হাতি স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান। হয়তো সেই বয়সেই তার চোখে ছিল লঙ্কান জার্সি পরার স্বপ্ন। মাহেলা যেমন নি:শব্দে পেছনে দাঁড়িয়ে স্বপ্নপালকে হাত ধরে রেখেছিল।

হঠাৎ একদিন ধিশাল মাঠে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। ডাক্তার জানান, ব্রেন টিউমার। সেই সংবাদ মানে এক রকম বজ্রাঘাত। সরকারি চাকুরে বাবা বাড়ির সব সঞ্চয়, জমি, ধারদেনা করে বিলেত উড়ে গেলেন চিকিৎসার জন্য। কেমোথেরাপি, অস্ত্রোপচার, আশা-নিরাশার দোলাচলে দুলতে দুলতে ধিশাল ফিরে এল শ্রীলঙ্কায়।

কিন্তু, ভাগ্যটা ছিল নিষ্ঠুর। কিছুদিন পর আবার ফিরে এল সেই মরণ ব্যাধি। এবার আর পারল না ছোট ভাই। ১৯৯৫ সালের ৮ মার্চ, ১৬ বছর বয়সেই ধিশাল সব ছেড়ে পাড়ি জমাল অন্য এক জগতে।

ক্রিকেট ব্যাটটা পড়ে থাকল ঘরের এক কোণে। আর দাদা মাহেলা পড়ে থাকলেন নীরব এক শূন্যতার মধ্যে। ধিশালের মৃত্যুর ঠিক দশদিন পর ছিল আন্ত:স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। মাহেলার স্কুল টিমের অধিনায়ক তিনি। কিন্তু, প্র্যাকটিসে যাননি একদিনও।

স্কুলের প্রিন্সিপাল নিজেই বাড়িতে গিয়ে অনুরোধ করলেন—‘ফিরে এসো, মাহেলা।’ কিন্তু মাহেলা ফিরলেন না। কিছু কিছু শোক শব্দ দিয়ে বোঝানো যায় না, বোঝাতে নেই।

তখনই হাজির হলেন ওয়েলাওয়াত্তা মন্দিরের পুরোহিত। যিনি একজন সন্ন্যাসীর মতো নয়, বরং একজন মমতাময় পিতার মতো বললেন, ‘তোমার ভাই চাইতো তুমি ক্রিকেট খেলো। আমি বিশ্বাস করি, ও চায় না তুমি খেলা ছেড়ে দাও। বরং তুমি খেলো ওর জন্য, ওর নামেই খেলো।’

মাহেলা শুয়ে পড়লেন সেদিন রাতে ধিশালের ছবিটা নিয়ে। সেই যে শুরু হল, আজীবন খেললেন ভাইয়ের নামেই। প্রতিটি ম্যাচের আগের রাতে ধিশালের ছবিটা জায়গা করে নিত মাহেলার ঘরের টেবিলে।

ধিশাল হয়তো আর কোনোদিন ব্যাট হাতে নামেনি। কিন্তু মাহেলা জানতেন, প্রতিবার তিনিই ব্যাট হাতে নামার মানে — ধিশাল আবার ফিরে আসা, ধিশালের আবারও ব্যাট হাতে জিতে যাওয়া।

তিনি নিজেই একদিন বলেছিলেন, ‘আমি জানি ধিশাল ক্রিকেট ভালোবাসতো। ওর স্বপ্ন ছিল শ্রীলঙ্কার হয়ে খেলা। আমরাও একসাথে সেই স্বপ্ন দেখতাম। আজ আমি যা করি সবই ওর জন্য। যখন আমি ব্যর্থ হই, বাইশ গজে ওকে অনুভব করি—ও যেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে।’

মাহেলা জয়াবর্ধনের ক্যারিয়ারকে পরিসংখ্যানের দিক থেকে অনেক ভাবেই মহিমান্বিত করা যায়। কিন্তু, তাতে দেখা যায় না ভাইকে হারানোর শোক। স্কোরবোর্ড দেখে কে বলবে,  তার প্রতিটি সেঞ্চুরিতে ছিল ধিশালের অপূর্ণতার প্রতি এক নি:শব্দ শ্রদ্ধা।

যখনই মাহেলা ব্যাট হাতে নামতেন, স্বয়ং ঈশ্বর নেমে এসেছেন তাঁর কাঁধে হাত রেখে, আর ধিশাল দাঁড়িয়ে আছে প্যাভিলিয়নের ঠিক গেটের পাশে, নি:শব্দ হাসিতে। মাহেলাও জানতেন, ধিশাল আছেন!

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link