মার্শাল ল

ক্রিকেট ইতিহাসে বহু ফাস্ট বোলারের আবির্ভাব ঘটেছে এবং আগামী দিনেও ঘটবে। ৪২ বছর ক্রিকেট দেখার, শোনার বা পড়ার পর্বে ইমরান খান, স্যার রিচার্ড হ্যাডলি, মাইকেল হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার, অ্যান্ডি রবার্টস, সরফরাজ নওয়াজ, কোর্টনি ওয়ালস, কার্টলি অ্যামব্রোস, বব উইলিস, ওয়াকার ইউনুস, ওয়াসিম আকরাম, অ্যালান ডোনাল্ড, ব্রেট লি, ডেল স্টেইন, শেন বন্ড, শন টেই, শোয়েব আখতার - এমন কত ফাস্ট বোলারকে দেখা হয়ে গেল। কিন্তু, যাকে নিয়ে মুগ্ধতা আজও কাটেনি তিনি ম্যালকম মার্শাল।

ক্রিকেট ইতিহাসে বহু ফাস্ট বোলারের আবির্ভাব ঘটেছে এবং আগামী দিনেও ঘটবে। ৪২ বছর ক্রিকেট দেখার, শোনার বা পড়ার পর্বে ইমরান খান, স্যার রিচার্ড হ্যাডলি, মাইকেল হোল্ডিং, জোয়েল গার্নার, অ্যান্ডি রবার্টস, সরফরাজ নওয়াজ, কোর্টনি ওয়ালস, কার্টলি অ্যামব্রোস, বব উইলিস, ওয়াকার ইউনুস, ওয়াসিম আকরাম, অ্যালান ডোনাল্ড, ব্রেট লি, ডেল স্টেইন, শেন বন্ড, শন টেই, শোয়েব আখতার – এমন কতো ফাস্ট বোলারকে দেখা হয়ে গেল।

কিন্তু, যাকে নিয়ে মুগ্ধতা আজও কাটেনি তিনি ম্যালকম মার্শাল। বিশ্ব ক্রিকেটে অতীতেও এমন বোলার ছিলেন কিনা তা নিয়ে ধন্দ আছে। অতীতেও ডেনিস লিলি, ফ্রেড ট্রুম্যান, লিন্ডওয়াল, অ্যালান ডেভিডসন, হ্যারল্ড লারউড, হল, অ্যাডকক, হেইন, টাইসন, থমসন, মার্টিনডেল, ম্যাকেঞ্জি এমন কত ফাস্ট বোলার রাজ করে গিয়েছেন।

কিন্তু মার্শাল সকলের থেকে আলাদা। কেন এবং কীভাবে সেটা বোঝার চেষ্টা করা যাক।

প্রথমেই আসে তাঁর অ্যাকশন। কোণাকুনি একটা রান আপ। দ্রুত গতিতে বোলিং ক্রিজের দিকে ধেয়ে আসা। তারপর ছোট্ট জাম্প। তারপর চেষ্ট অন অ্যাকশনে প্রায় রং ফুটেট ডেলিভারি। সাইড অন অ্যাকশনের যুগে একেবারে আলাদা ব্যাপার।

ফাস্ট বোলার মানেই একটা লম্বা শক্তপোক্ত কাঠামোর ব্যাপার মনে আসে। কিন্তু মার্শাল ছয় ফুটের নিচে থাকা খর্বাকৃতি ফাস্ট বোলার ( পড়েছি যে লারউড নাকি ৫’৭” উচ্চতার বোলার ছিলেন)।

মার্শালের তীব্র গতির সাথে ছিল যে কোনো পিচে গুড লেংথের একটু আগে থেকে বল ঠিকরে তোলার ক্ষমতা। কতবার যে ব্যাটসম্যানের বুক, মুখ লক্ষ্য করে কেউটের বিষাক্ত ছোবলের মত লাল গোলা সন্ত্রস্ত ব্যাটসম্যানের ব্যাটে হিংস্র চুম্বন দিয়ে চিতাবাঘের মতো ক্ষিপ্র স্লিপ কর্ডন ( রিচার্ডস, রিচার্ডসন, হার্পার, লয়েড, হুপার – এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায়) বা উইকেটরক্ষকরের দস্তানায় জমা পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বার বার বারংবার।

তীব্র গতিতে বল দুদিকেই স্যুইং বা কাট করানোর ক্ষমতা ছিল মার্শালের। কোনো বিশেষ অস্ত্রের ( গার্নারের ইয়র্কার, লিলির লেগ কাটার, ইমরানের ইনডিপার) ওপর তাঁকে নির্ভর করতে হয় নি। সব অস্ত্র তাঁর তূণীরে রক্ষিত ছিল।

সবচেয়ে ঘাতক অস্ত্র ছিল স্কিডিং বাউন্সার। স্বল্প উচ্চতার বোলার হওয়ায় আর তাঁর বিশেষ ডেলিভারী অ্যাকশনের জন্য ব্যাটসম্যান বুঝে উঠতে পারতেন না যে বাউন্সার আসছে আর এটাই তাঁকে সবচেয়ে ভয়ানক ফাস্ট বোলারে পরিণত করেছিলো। মার্শালের হাত থেকে নিক্ষিপ্ত লাল গোলার বিষাক্ত চুম্বনের প্রাপ্তির অভিজ্ঞতা হয় নি এমন ব্যাটসম্যান আটের দশকে প্রায় ছিল না। সবচেয়ে বেশী ব্যাটসম্যান আহত হয়েছেন তাঁর বলে আর সেটাও মাত্র ১০ বছরের পর্বে।

মার্শাল যে সময় দলে আসেন সে সময় ( ১৯৭৮-৭৯ এর ভারত সফরে তাঁর প্রথম শ্রেণী খেলারও অভিজ্ঞতা ছিল না আর তাই এটা আলোচ্য নয়) দলে গার্নার, হোল্ডিং, রবার্টসের মতো গ্রেটরা রাজত্ব করছেন আর শেষ পর্বে ওয়ালস, অ্যামব্রোস, বিশপের মত বড় মাপের ফাস্ট বোলারের সাথে তিনি খেলেছেন। কিন্তু আটের দশকটা তবুও মার্শাল যুগ। অশ্বমেধের ঘোড়া নিয়ে দৌড়ানো বিশ্বজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজের ওই পেস ব্যাটারির যুগে তিনিই সম্রাট। অঘোষিত মার্শাল ল তিনি জারী করে দিয়েছিলেন যেন।

যে দলে একটা স্পেল বল করে যাওয়ার পরে পরের স্পেল আর পাওয়া যাবে কিনা এমন ব্যাপার সেখানে মার্শাল চার স্ট্রাইক বোলারের মাঝে অতি দ্রুত গতিতে প্রায় ৪০০ উইকেট তুলে নিলেন। কীভাবে করলেন সেটাই বিস্ময়ের উদ্রেক করে।

পুরো আটের দশক জুড়ে ( মাঝে কিছু সিরিজ খেলেন নি) তিনি দেশে বিদেশে যে কোনো পিচে তা পাটা হোক বা ফাস্ট, বাউন্সি হোক বা ভাঙা ঘূর্ণি পিচ মার্শাল কাঁড়ি কাঁড়ি উইকেট তুলেছেন প্রতি সিরিজে। ২০+ উইকেট কতগুলি সিরিজে পর পর পেয়েছেন তা কল্পনা করা যায় না।

যে ম্যাচের থেকে ছবিটি নেওয়া সেটি ১৯৮৮ সালের ইংল্যাণ্ড সফর। সে সিরিজে ৫ টেস্টে ৩৫ উইকেট নিয়েছিলেন মার্শাল। দলে ২০ টেস্ট খেলা ওয়ালশ আর নবাগত অ্যামব্রোস ছিলেন। তারাও তখন কম ছিলেন না। পরবর্তীকালে তাঁরা গ্রেট হন। কিন্তু অনভিজ্ঞ বোলিং জুটিদের খামতি ঢেকে দেন পড়ন্ত বেলার মার্শাল। তাঁর দীপ্যমান প্রকাশে ঢাকা পড়ে যান এঁরা।

১৯৮৯ সালে যখন ভারত আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তখনও নতুন ফাস্ট বোলিং কোয়াট্রেটের মাঝে ( মার্শাল, ওয়ালস, অ্যামব্রোজ ও বিশপ) ঝলমল করছেন মার্শাল। পড়ন্ত বেলাতেও তাঁর খরদীপ্তি প্রতিভাত হচ্ছিলো। দলের সর্বোচ্চ ১৯ উইকেট নিয়েছিলেন চার টেস্টে। তারমধ্যে একটা প্রায় খেলা হয় নি। পোস্ট অফ স্পেনের মরা পিচে আগুন ছুটিয়ে ১১ উইকেট তুলে নেন। তিনটে ইনিংসে পাঁচ উইকেট।

  • ১০

শেষ পর্বে গতি হ্রাস পেয়ে মিডিয়াম পেসার হয়ে গিয়েছিলেন। তবুও সীম মুভমেন্ট আর স্যুইং এর ওপর নিয়ন্ত্রণ কী হারায়? অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৯১ এর ত্রিদেশীয় সিরিজে চমৎকার বল করেন ( তা মার্শালসুলভ না হলেও)। অনেক ক্ষেত্রে সেরা বোলিং পরিসংখ্যান রেখেছেন। দিন ফুরিয়ে এলেও তিনি তো মার্শাল। তাই না!

টেস্টে অবসর নিলেও ১৯৯২ এর বিশ্বকাপ খেলেন। সাফল্য বিশেষ ছিল না। তখন তাঁকে দেখা পীড়াদায়ক হচ্ছিলো। আমার প্রিয়তম ফাস্ট বোলারকে সেটাই শেষ দেখা। কিন্তু অস্ত সূর্যের বিষণ্ণ মাধুরীটাও মুগ্ধ ভক্তের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

  • ১১

ক্রিকেট ইতিহাসে তিনিই শ্রেষ্ঠতম ফাস্ট বোলার কিনা সেটা তাত্ত্বিকরা আলোচনা করবেন। সেটা আমার বিষয় নয়। আমি মুগ্ধ ভক্ত মাত্র। তবে মনে হয় ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তিনি। কারণ যে কোনো পিচে সাফল্য তিনি অর্জন করেছেন। প্লাসিড পিচেও তাঁকে ভীতিপ্রদ মনে হত। বল হাতে দৌড় শুরু করলেই মনে হতো এবার উইকেট পড়বে। চিরশ্রেষ্ঠদের একজন না হলে সেটা অনুভূত হওয়া সম্ভব ছিল না।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...