বাবারাই নাকি সন্তানের সবচেয়ে বড় আদর্শ। বাবার যে পথে আছেন ছেলেও সেই পথে যাবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ছেলের পথ ধরে তার ছেলেরও একই পথের পথিক হওয়াটা খুব সহজ বিষয় নয়। ঐতিহ্য ধরে রেখে সেই অসামান্য কাজটিই করেছেন মালদিনি পরিবার। সারা বিশ্ব যে নামের সাথে বছরের পর বছর ধরে পরিচিত তাঁরা।
এবার দেখা মিলেছে মালদিনি পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের। এদিকে কোচ কার্লো আনচেলত্তির পথ ধরে তার ছেলে ডেভিড আনচেলত্তিও এখন কোচের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে যাচ্ছে ফুটবলের এই শেকড়। সেখানে ছেলে খেললে চলে আসে বাবার নাম, অনেক ক্ষেত্রে আবার তারও বাবার নাম চলে আসে। যেমন করে সিজার মালদিনির পর পাওলো হয়ে এবার এসি মিলানের হয়ে মাঠে নেমেছেন ড্যানিয়েল মালদিনি।
তাতেই একটি ক্লাব তিন প্রজন্মের খেলোয়াড়র খেলার কারণে রচিত হয়েছে নতুন ইতিহাস। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে ইতালির ঐতিহ্যবাহী ক্লাব এসি মিলানের পরিচিতমুখ ছিলেন ডিফেন্ডার সিজার মালদিনি। রোজানেরিওদের হয়ে এক দশকে প্রায় সাড়ে তিনশো ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। এছাড়া ইতালির প্রথম ক্লাব হিসেবে ১৯৬৩ সালে এসি মিলানের ইউরোপিয়ান কাপ জয়ী দলের অধিনায়কও ছিলেন সিজার।
এর ঠিক কুড়ি বছর পর এসি মিলানে মালদিনি পরিবারে রাজত্ব করতে আসেন সিজার মালদিনির ছেলে পাওলো মালদিনি। অনেকে মনে করতে পারেন বাবার পরিচয়ে নামি এই ক্লাবে এসেছেন পাওলো। নিজের নৈপুণ্যেই মিলানে ইতিহাস সৃষ্টি করে অবসরে গেছেন সূদর্শন এই ডিফেন্ডার। ক্যারিয়ারের পুরো সময়ই এসি মিলানে কাটিয়ে ক্লাবটির প্রতি পরিবারের ভালভাসার দারুণ এক উদাহরণ তৈরি করে গেছেন।
তাঁর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে এসি মিলানের হয়ে পাঁচটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও সাতটি সিরি ‘আ’সহ অসংখ্য শিরোপা জিতে নিজেকে বানিয়েছেন তর্কসাপেক্ষে ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ডিফেন্ডার। মালদিনি পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের খেলোয়াড় হিসেবে ৪৫০০ দিন পর ইতালিয়ান জায়ান্ট ক্লাবে এবার জায়গা পেয়েছেন দানিয়েল মালদিনি। দাদা ও বাবার পথ অনুসরণ করে মিলানে এরই মধ্যে অভিষেকও হয়ে গেছে ১৯ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডারের। দাবা আর বাবার মতো দানিয়েল ডিফেন্ডার না হয়ে মিডফিল্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন।
ইতালিয়ান সিরি ‘এ’-তে স্প্যাৎসিয়ার বিপক্ষে প্রতিপক্ষের মাঠ চরম নাটকীয়তায় ভরা ম্যাচটি ২-১ গোলে জিতে নেয় স্টেফানে পিওলির শিষ্যরা। ম্যাচটি মিলানের জয়ের চেয়ে বেশি ঐতিহাসিক হয়ে থাকবে পাওলো মালদিনি ছেলে ড্যানিয়েল মালদিনির গোলের কারণে। ম্যাচের ৪৮তম মিনিটে ডিফেন্ডার পিয়েরি কালুলুর ক্রসে দুর্দান্ত হেডে গোল করে দলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন ড্যানিয়েল।
আর তাতেই ক্লাব ফুটবলে লেখা হয়ে যায় নতুন ইতিহাস। ফুটবল ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইতালির শীর্ষ লিগে একই ক্লাবের হয়ে গোল করলেন একই পরিবারের তিন তিনটি প্রজন্ম। গ্যালারিতে বসেই মালদিনি পরিবারের উত্তরসূরীর ইতিহাস সৃষ্টি করা দেখেছেন পাওলো মালদিনি! ইতালিয়ান সিরি ‘আ’তে পাওলো মালদিনি সর্বশেষ গোলটি করেছেন ২০০৮ সালে আতালান্টার বিপক্ষে। আর সবমিলিয়ে ইতালিয়ান লিগে ইল ক্যাপিতানো ৬৬৭ ম্যাচে গোল করেছিলেন ২৯টি।
অন্যদিকে মালদিনির বাবা সিজার ইতালিয়ান লিগে মিলানের হয়ে সর্বশেষ গোলটি করেন ১৯৬১ সালে, কাতালিয়ার বিপক্ষে। সবমিলিয়ে ইতালিয়ান ক্লাবটির হয়ে এই ডিফেন্ডারও ৮টি গোল করেছিলেন। সময়েল হিসাবে ১৩ বছর পর আবারও সিরি ‘আ’তে গোলের দেখা পেল মালদিনি পরিবার! দাদা ও বাবা এসি মিলানের কিংবদন্তি হয়েছেন অনেক আগেই। সে কারণেই দানিয়েল মালদিনির কথা উঠলেই চলে আসে তাদের নাম।
ফুটবলবিশ্বে এবার তার নিজের নামে পরিচিত হওয়ার পালা এই কুশলী মিডফিল্ডারের। ইতালিয়ান ক্লাবটির হয়ে সিরিএ তে প্রথমবারের মতো শুরুর একাদশে সুযোগ পাওয়ার উপলক্ষটা গোল করে রাঙালেন তিনি। বর্তমানে এসি মিলানের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন পাওলো মালদিনি। ছেলের গোলের পর দুহাত উঁচিয়ে উদযাপন করতে দেখা গেছে পাওলোকে। আর নাতির গোলের আনন্দে হয়তো ওপারে স্বর্গে বসে হাততালি দিয়েছেন দাদা সিজারে মালদিনি। মিলানে মালদিনি পরিবারের রাজত্ব শুরু হয় সিজার মালদিনির সময়ে।
১৯৫৪-৬৬ সাল পর্যন্ত সান সিরোতে খেলেছেন সিজার। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ছেলে পাওলো মালদিনিরও ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ডিফেন্ডার হিসেবে। ১৯৮৪-২০০৯ পর্যন্ত টানা ২৫ বছর মিলানের রক্ষণভাগ কি দারুণভাবেই না সামলেছেন তিনি। দিনে দিনে নিজেকে তিনি নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। বিশ্বের সেরা একাদশ সাজালে যে কেউ তার রক্ষণভাগ সামলানোর জন্য পাওলোর নাম রাখবেনই।
দাদা ও বাবার মতো ডিফেন্ডার না হয়ে গোল করার কারিগর হয়েছেন। যাতে করে মিলান অনেকদিন পর পেল আরেকজন বিশ্বস্ত মালদিনিকে। ম্যাচ শেষে জয় দিয়ে পয়েন্ট তালিকার শীর্ষ স্থানে পৌঁছে গেছে দানিয়েলের দল এসি মিলান। চলতি লিগে অনেক ঐতিহ্যের ধারক দলটির সংগ্রহ ৬ ম্যাচে ১৬ পয়েন্ট। আসরে ৫ ম্যাচে ১৫ পয়েন্ট সংগ্রহ করে তার পরেই রয়েছে নাপোলির।
শিরোপাধারী নগর প্রতিদ্বন্ধী ইন্টার মিলানের অর্জন ৬ ম্যাচে ১৪ পয়েন্ট। ম্যাচ শেষে মিলানের ইতালিয়ান কোচ স্টেফানো পিওলি ড্যানিয়েল সম্পর্কে বলেন, ‘ড্যানিয়েল একজন মেধাবি ফুটবলার। তার টেকনিক দিকগুলো বেশ ভালো। খেলাটি সে ভালোভাবে পড়তে পারে এবং সে জানে কিভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে হবে, যা দলটির জন্যঅনেক বেশি প্রাপ্তির হবে।’
বর্তমানে এসি মিলান ক্লাবের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পাওলো মালদিনি দলটির জার্সি গায়ে ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৯০২ ম্যাচ। ১৯৮৮ থেকে ২০০২ পর্যন্ত ইতালি জাতীয় দলের হয়ে ১২৬ ম্যাচ খেলেছেন ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের অন্যতম সেরা লেফট-ব্যাক। অন্যদিকে সিজার মালদিনি ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত স্থায়িত্ব পাওয়া ক্যারিয়ারে এসি মিলানের জার্সি গায়ে খেলেছেন ৪১২ ম্যাচ।
ইতালি জাতীয় দলের হয়েও ১৪ ম্যাচ খেলেছেন এ তারকা ডিফেন্ডার। ১৯৬২ বিশ্বকাপে চমৎপ্রদ নৈপুণ্য দিয়ে অলস্টার দলে জায়গা পান সিজার। পরের বছর মিলানের জার্সি গায়ে ইউরোপিয়ান কাপ শিরোপার স্বাদ নেন চারবারের সিরি আ লিগ শিরোপাজয়ী সিজার। বাবার দেখানো পথে ক্যারিয়ারে পাওলো মালদিনি সিরি আ শিরোপা জিতেছেন ৭ বার। এছাড়া পাঁচবার নিয়েছেন উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপার স্বাদ।
আর ১৯৯৮ বিশ্বকাপে পিতাপুত্র সিজার-পাওলোর কীর্তিময় আবির্ভাবে রচিত হয় নতুন আরেক ইতিহাস। ফ্রান্সে সেবার ইতালি দলের কোচের দায়িত্ব সামলান সিজার আর অধিনায়কের আর্মব্যান্ড ছিল পাওলোর হাতে। সেবারের চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বিদায় নিতে হয় আজ্জুরিদের। ইতিহাস বলছে, বিশ্বকাপে আর কোনো পিতাপুত্রের একসাথে কোচ-অধিনায়ক হওয়ার নজির নেই।
কার্লো আনচেলত্তির পথে ছেলে ডেভিড
মাত্র ২০ বছর বয়সে নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টেনে বাবা কার্লো আনচেলত্তির দেখানো পথে কোচ হবার কাজটি শুরু করেন ডেভিড আনচেলত্তি। রিয়াল মাদ্রিদে নতুন করে যোগদানের পর ছেলেকে সহকারী কোচ বানিয়েছেন। বাবা-ছেলের যুগলবন্দিতে রিয়াল দারুণ শুরু করেছে নতুন মৌসুমে। এর আগে সিজার মালদিনি-পাওলো মালদিনি, পেরিকো আলোনসো-জাবি আলোনসো, মাজিনহো-থিয়োগা আলকান্তারা ও রাফিনহা, পিটার স্মাইকেল-ক্যাসপার স্মাইকেল কোচ হয়েছিলেন।
তারা সম্পর্কে বাবা-চেলে। তবে বাবার পথ ধরে কতজন সফল হয়েছেন সেই তালিকা করতে গেলে বেশ ছোটই হয়ে যাবে তা। কোচের অভাব পূরণ করতেই তো এসে এসেছেন ডেভিড আনচেলত্তি! নামের শেষ অংশটা অনেকের কাছেই চেনা চেনা লাগছে। কোচদের ‘ডন’ হিসেবে খেতাব পাওয়া কার্লো আনচেলত্তির ছেলেই তো এই ডেভিড। ৩২ বছর বয়সী ডেভিড বাবার দেখানো পথে কোচিংকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
বাবা কার্লো যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছে। ৬ বছর পর রিয়াল মাদ্র্রিদের কোচ হয়ে যখন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে ফিরেছেন কার্লো আনচেলত্তি তখন ছেলে ডেভিড হয়েছেন সহকারী কোচ। ইতোমধ্যে ক্লাবটির হয়ে দক্ষতার দারুণ ছাপ রাখতে শুরু করেছেন ডেভিড। বাবা কার্লোকে তো মাঝে মাঝে পরামর্শও দিয়ে যাচ্ছেন তিনি!
বাবা-ছেলের যুগলবন্দীতে নতুন মৌসুমে রিয়াল অপ্রতিরোধ্য হবার পথে দ্রুতলয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। লা লিগায় এখন পর্যন্ত অপরাজিত থাকার পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলা একমাত্র ম্যাচে স্বদেশি ক্লাব ইন্টার মিলানকে হারিয়ে বাবা-চেলে দারুন উপভোগ করছেন দায়িত্বটা। সামনে হয়তো দুজনে মিলে আরো চমক দেখাতে যাচ্ছেন।