পাথিরানা ছাপিয়ে যাবেন স্বয়ং মালিঙ্গাকেও!

তাঁর বোলিং অ্যাকশনে লাসিথ মালিঙ্গার ছাপ! তাই তাঁকে নিয়ে হইচই শুরু হতেও সময় লাগেনি। মাথিশা পাথিরানার জীবনের বাঁক বদল ঘটে গিয়েছে এক আইপিল দিয়েই। তবে যার বোলিং অ্যাকশনের সাথে এত সাদৃশ্যতা, সেই মালিঙ্গা মনে করেন, পাথিরানার এমন দোর্দন্ড প্রতাপ দেখা যাক জাতীয় দলেও। কারন তিনি যে নিজের চেয়েও বড় জায়গায় দেখতে চান পাথিরানাকে!

এবারের আইপিএলে বিদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম সেরা আবিষ্কার শ্রীলঙ্কার মাথিশা পাথিরানা। লঙ্কানদের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যার পায়ের তলার মাটি শক্ত হয়নি, সেই-ই কিনা বিশ্বের সেরা ফ্রাঞ্চাইজি লিগে এসে বোলিং দ্যুতি ছড়ালেন। বড় মঞ্চের অসম সব চাপকে জয় করে ঠিকই পাদপ্রদীপের আলোয় নিজেকে আলোকিত করলেন। 

তবে মাথিশা পাথিরানা নজড় কেড়েছেন অন্য আরেকটি কারণেও। লঙ্কান এ পেসারের বোলিং অ্যাকশনের সাথে প্রায় হুবহু মিল রয়েছে তাঁরই দেশের সাবেক কিংবদন্তি পেসার লাসিথ মালিঙ্গার। যেন মালিঙ্গার এক নতুন সংস্করণের আবির্ভাব ঘটেছে এবারের আইপিলে। 

চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে এখন পর্যন্ত ১০ ম্যাচে ১৫ উইকেট নিয়েছেন পাথিরানা। আর এই পাথিরানার মাঝেই লঙ্কান ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ দেখছেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। তবে লাল বলের ক্রিকেট থেকে এ পেসারকে এক প্রকার দূরেই থাকতে বলেছেন তিনি।

অবশ্য স্বয়ং লাসিথ মালিঙ্গা মনে করেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সবার আগে টেস্টকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিৎ। সম্প্রতি ইএসপিএনক্রিকইনফোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পাথিরানাকে নিয়ে নিজের বিস্তর ভাবনা জানিয়েছেন সাবেক এ লঙ্কান পেসার। 

এ সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে পাথিরানার সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের গল্পও। ২০২০ সালের দিককার কথা। মাহেলা জয়াবর্ধনে তখন শ্রীলঙ্কা দলের পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সেই সময়েই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলে আসা মাথিশা পাথিরানা চোখে পড়েন মাহেলার। একদম মালিঙ্গার মতো অ্যাকশনে বোলিং করেন বলে, মাহেলার আলাদা নজরে পড়তেও সময় লাগলো না। জয়াবর্ধনেও কালক্ষেপণ করলেন না। 

সঙ্গে সঙ্গে মালিঙ্গাকে ফোন করলেন। উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘মালি! (মালিঙ্গা), ক্যান্ডি থেকে একটা ছেলে এসেছে, একদম তোর মতোই অ্যাকশনে বল করে। ওর বলে গতিও আছে, একই সাথে দুই দিকেই স্বাচ্ছন্দ্যে বল করতে পারে। আমার কাছে তো দারুণ প্রতিভাবান মনে হচ্ছে। তুই কি ওর জন্য কিছু করতে পারবি?’

এরপর মাহেলা জয়াবর্ধনে পাথিরানাকে পাঠালেন মালিঙ্গার কাছে। কিছুদিনের মধ্যেই মালিঙ্গা-পাথিরানা প্রথম সাক্ষাৎ হলো। মালিঙ্গার ভাষ্যমতে, সেদিন ঐ ছেলের আত্মবিশ্বাস দেখে প্রথম দেখাতেই ইতিবাচক মনে হয়েছিল। আর পরামর্শ হিসেবে দিয়েছিলেন, সবার আগে দেশের হয়ে সব ফরম্যাটের খেলার জন্য প্রস্তুত থাকার ব্যাপারে। 

চেন্নাইয়ের হয়ে এবারের আইপিএলে বেশির ভাগ সময়েই পুরাতন বলে বোলিং করেছেন পাথিরানা। মালিঙ্গা অবশ্য চান, পাথিরানা নতুন বলেও তাঁর সক্ষমতা দেখাক। এ জন্য তিনি তাঁর স্বদেশী এই পেসারকে পরামর্শ দিয়েছেন, ইয়র্কারে আরো ধারাবাহিকতা আনার ক্ষেত্রে। এ ছাড়া পাথিরানার বোলিংয়ে বৈচিত্র্যতা যোগ করতে স্লোয়ার রপ্ত করার ব্যাপারেও তাগিদ দিয়েছেন মালিঙ্গা। 

শুধু আইপিএল নয়, পাথিরানার কাছ থেকে মালিঙ্গার চাওয়া, দেশের হয়েও যেন তাঁর এই পারফরম্যান্সের ধারা অব্যাহত থাকে। এ ক্ষেত্রে পাথিরানাকে একটা টিপসও দিয়েছেন মালিঙ্গা। তাঁর মতে, একজন পেসারের সক্ষমতা যাচাই করতে, কোন ফরম্যাটে সে উপযুক্ত হবে তা নির্ধারণ করতে অন্তত ১০ টা টেস্ট খেলা উচিৎ।

এ সময়ে তিনি নিজের ক্যারিয়ার টেনে এনে বলেন, ‘আমি ক্যারিয়ারে ৩০ টা টেস্ট খেলেছি মাত্র। কিন্তু ঐ ৩০ টা টেস্টই আমাকে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে দীর্ঘ সময় খেলার রসদ জুগিয়েছিল। পাথিরানার জন্যও তাই পরামর্শই থাকলো।

পাথিরানা আর মালিঙ্গা— দুজনের বোলিংয়েরই অন্যতম বিশেষত্ব, তাদের রিভার্স সুইং দেওয়ার সহজাত সক্ষমতা। তবে মালিঙ্গা মনে করেন, পাথিরানা তাঁর চেয়েও ভাল রিভার্স সুইং দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। কারণ পাথিরানা বোলিংয়ের সময় আরো নিচুতে হাত রেখে বল করে। যার কারণে তাঁর রিভার্স সুইংয়ের বলগুলো বেশিরভাগ সময়েই ব্যাটারের জন্য খেলা কঠিন হবে। 

চেন্নাইয়ের অধিনায়ক ধোনি এবারের আইপিএলে বেশিরভাগ সময়েই পাথিরানাকে দিয়ে পুরাতন বলে বোলিং করিয়েছেন। এতে ধোনির দুরদর্শিতায় দেখছেন মালিঙ্গা।

তিনি বলেন, ‘ধোনি অভিজ্ঞ অধিনায়ক। তিনি ক্রিকেটটা বোঝেন ভাল। এ জন্য কাকে কোথায় ব্যবহার করতে হয় তা ভাল বোঝেন, জানেন। যেমন দেখুন, পাথিরানা নতুন বোলার। এমন বড় মঞ্চে ও চাপে নুইয়ে পড়তেই পারতো। কিন্তু ধোনি তাঁকে দারুণভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। ওর পটেনশিয়ালটি বের করতে সক্ষম হয়েছে।’

ধোনির অধিনায়কত্বের প্রশংসা করলেও পাথিরানাকে লাল বলের ক্রিকেট না খেলার পরামর্শে কিছুটা বিরোধিতাই করেছেন মালিঙ্গা। তাঁর মতে, একজন ক্রিকেটারকে দেশের হয়ে যেকোনো ফরম্যাটেই খেলার তাগিদ থাকা প্রয়োজন।

এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, ধোনি এটা মজা করে বলেছে। আর যারা টেস্ট ক্রিকেটে একজনকে দেখতে চায় না, এর মানে সেই ক্রিকেটারকে তারা ইনজুরিপ্রবণ মনে করে। যেটা সবসময় ঠিক না। একজন ক্রিকেটারকে শত চ্যালেঞ্জ ডিঙিয়েই যেতে হয়। আমি ২০০৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত টেস্ট খেলেছি। তখন কেউই কিন্তু আমাকে টেস্ট ক্রিকেট ছাড়তে বলেনি। আমি নিজে ছেড়েছি। এরপর ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টিতে দিব্যি খেলে গিয়েছি।’

মাথিশা পাথিরানাকে তবে কোথায় দেখতে চান মালিঙ্গা? মালিঙ্গা চান, পাথিরানা যেন তাঁকেও ছাপিয়ে যায়। এখনও লঙ্কানদের হয়ে টেস্ট না খেলা পাথিরানাকে আগামী টেস্ট সিরিজেই দলে দেখতে চান তিনি। তাঁর মতে, আগামী ৩ বছরে যদি ১৫ টা টেস্ট খেলতে পারে, তাহলে সেটাই ওর সক্ষমতা, ভবিষ্যতের দিক নির্ণয় করে দিবে। 

মাথিশা পাথিরানার বয়স কেবল ২০। দারুণ প্রতিভাধর এই পেসারকে নিয়ে লঙ্কানরা তাই একটা স্বপ্নের বুনন বুনতেই পারে। স্বয়ং মালিঙ্গাও পাথিরানার বোলিংয়ের মধ্যে নিজের ছাপ খুঁজে পেয়ে তাঁকে নিয়ে সম্ভাবনার আকাশে চোখ রাখছেন। 

মালিঙ্গার সেই ভাবনার পথে, পাথিরানা আস্থার প্রতিদান দিতে পারবেন তো? হয়তো পারবেন, নয়তো ব্যর্থ হবেন কিংবা মালিঙ্গাকেও ছাপিয়ে যাবেন। তবে সব সম্ভাব্য গল্প ছাপিয়ে, এই মুহূর্তে বলাই যায়, সময়টা এখন তাঁরই, তাঁকে ঘিরে বাড়তি উন্মাদনা তো তাই অনুমেয়ই। 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...