দলবদলের বাজার বাজিমাত করার জন্য যদি কোন শিরোপা থাকত তবে তা ম্যানচেস্টার সিটির প্রাপ্য। শক্তিশালী দল গঠনের পাশাপাশি কীভাবে খেলোয়াড় বেচা কেনা করতে হয় তা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের শিরোপাধারী এই ক্লাব সকলকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, অন্যান্য ক্লাব গুলো এক্ষেত্র তাঁদের চেয়ে অনেক দূরে রয়েছে।
হাল আমলের ক্রেজ তুখোড় আক্রমণভাগের খেলোয়াড় আর্লিং হাল্যান্ডকে ম্যানচেস্টার সিটি গ্রীষ্মকালীন দলবদলের বাজার শুরু হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই দলে ভিড়িয়েছে। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের প্রতিষ্ঠিত সদস্য ক্যালভিন ফিলিপ্সকেও তারা লিডস ইউনাইটেড থেকে নিজেদের দলে ভেড়ায়।
এই দামী দুই খেলোয়াড়কে কেনার পরও সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী তাদের এই মৌসুমে দলবদলের বাজারে ২৬ মিলিয়ন পাউন্ড মুনাফা হয়েছে। অপরদিকে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড দুই খেলোয়াড়কে দলে আনা এবং খেলোয়াড় বিক্রির পর মাত্র ১০ মিলিয়ন পাউন্ড মুনাফা করেছে এবং এখনো তাদের চাহিদার মূল খেলোয়াড়দের কেনার ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছে।
৪৭.৫মিলিওন পাউন্ডে রাহিম স্টার্লিংকে চেলসিতে, ৪৫ মিলিয়ন পাউন্ডে জেসুস কে আর্সেনালের কাছে তারা বিক্রি করেছে এই মৌসুমে। এই দুই লেনদেন থেকেই দেখা যাচ্ছে যে সিটিজেনরা তাদের খেলোয়াড়দেরকে উল্লেখযোগ্য অর্থের বিনিময়ে অন্যদের কাছে বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছে এবং একই সাথে তাদের বদলি হিসেবে যাদেরকে তারা দলে টেনেছে তাদের জন্য খুবই কম অর্থ খরচ করতে হয়েছে।
লিভারপুল, চেলসি, আর্সেনাল এবং টটেনহাম ২০২২-২৩ মৌসুমের দল বদলের বাজারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থ ব্যয় করেছে কিন্তু খেলোয়াড় বিক্রি করে তারা খরচের টাকা তুলতে পেরেছে স্যামনই। এদিকে দলকে শক্তিশালী করতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কোন সুসঙ্গত পরিকল্পনা আছে কিনা তা পরিস্কার নয়।
ফুটবল পরিচালক চিকি বারগেস্তাইনের অধীনে সিটিজেনরা খেলোয়াড় কেনা বেচা করাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। কখন কাকে কিনতে হবে এবং কাকে বিক্রি করতে হবে তার সুস্পষ্ট পরিকল্পনার ছাপ দেখা গিয়েছে তাদের কর্মকাণ্ডে।
২০০৮ সালে শেখ মনসুর বিন জায়েদ আল নাহিয়ান যখন ম্যানচেস্টার সিটিকে কিনে নেন তৎকালীন সময়ে খেলোয়াড় কেনা বেচার হিসেব শেষে মুনাফার দেখা পাওয়া ছিল আকাশ কুসুম স্বপ্ন। ক্লাবটির তৎকালীন প্রধান নির্বাহী গ্যারি কুক তখন সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলেন দ্রুততার সাথে এমন একটি দল গঠনের জন্য যারা ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে, একে তিনি ‘দ্রুত অধিগ্রহণ কৌশল’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
২০০৮-০৯ মৌসুমে সিটিজেনরা দলবদলের বাজারে খরচ করে ১৩২ মিলিয়ন পাউন্ড যার বিপরীতে খেলোয়াড় বিক্রি করে আয় করে মাত্র ২৮ মিলিয়ন পাউন্ড। পরবর্তী মৌসুমে ১৬৫ মিলিয়ন খরচের বিপরীতে তুলতে পারে মাত্র ৩৬ মিলিয়ন পাউন্ড এবং একই চিত্র সামনের মৌসুমগুলোতেও দেখা যায়।২০১৭-১৮ মৌসুমে তো বাঁধ ভেঙে যায় আগের সব হিসেবে। এই সময় তারা ক্লাব রেকর্ড ২৮৫.৭ মিলিয়ন পাউন্ড খরচের বিপরীতে তুলতে পারে মাত্র ৮২.২ মিলিয়ন পাউন্ড কিন্ত বর্তমান চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
২০২০-২১ মৌসুমে সিটিজেনরা ৫৬৯.৮ মিলিয়ন পাউন্ড আয়ের হিসাব দেখাতে সক্ষম হয়, ফলে প্রথম বারের মত নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চেয়ে বাৎসরিক আয়ে এগিয়ে যায় ।কোভিড -১৯ পরবর্তী সময়ে ফুটবল মাঠে এখন দর্শক সমাগম স্বাভাবিক হয়েছে আর এই কারনেই ধারণা করা হয় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বেশী আয় করা ক্লাব হিসেবে নিজেদের স্থান পুনরুদ্ধার করবে।
এক সময় শুধু শেখ মনসুরের অর্থের উপর নির্ভরশীল সিটিজেনরা এখন নিজের আয়ে নিজের খরচ চালাতে সক্ষম। বিশ্বব্যাপী ম্যানচেস্টার সিটি নিজেদের ব্র্যান্ড হিসেবে দাড় করাতে সক্ষম হয়েছে এবং সময়ের সাথে তা যে আরও বৃদ্ধি পাবে সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
এরই ফলস্বরূপ শেখ মনসুরের যোগাযোগের কারণে পাওয়া স্পন্সর ছাড়াও তারা অন্যান্য চুক্তি থেকে বেশ ভালই আয় করছে তারা। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বিশাল চুক্তির স্পন্সর পেলেও সাম্প্রতিক সময়ে মাঠে পায়নি কোন সাফল্য যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থাকা বাক্তিরা যদি বিচক্ষণতার সাথে সঠিক সিধান্ত নিতে না পারে তবে শুধু টাকা দিয়ে সাফল্য কেনা যায় না।
২০১২ সালে নিয়োগ পাওয়া প্রধান নির্বাহী ফেরান সরিয়ানো এবং ফুটবল পরিচালক বারগেস্তাইন ম্যানচেস্টার সিটিতে এমন এক মডেল গড়ে তোলেন যা দলবদলের বাজারে সিটিজেনদের বর্তমান সাফল্যের কারণ। তাদের মূল মন্ত্রই হল সেরা ফুটবল প্রতিভাদের চিহ্নিত করা, দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে তাদেরকে দলে ভেড়ানো। সিটিজেনরা বরাবরই সঠিক জায়গায় সঠিক লোকদের নিয়োগ দিয়েছ, যার সর্বশেষ উদাহরণ ম্যানেজার হিসেবে পেপ গার্দিওলাকে দলে আনা।
চুক্তিতে থাকা একটি ধারাকে সক্রিয় করে মাত্র ৫১ মিলিয়ন পাউন্ডে আর্লিং হালান্ডকে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড থেকে নিজেদের দলে ভেড়ায় সিটিজেনরা। এক্ষেত্রে তারা হাল্যান্ডকে পেতে মরিয়া অপর প্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদকে হারায়। ২১ বছর বয়সী আক্রমণ ভাগের এই খেলোয়াড় নি:সন্দেহে সিটিজেনদের হয়ে আগামী ১০ বছর খেলতে পারবেন যা তার খরচের হিসাব কে বছরে মাত্র ৫.১ মিলিয়ন পাউন্ডে নিয়ে যাবে।
২৬ বছর বয়সী মাঝমাঠের খেলোয়াড় ক্যালভিন ফিলিপ্স ,আরেক চমকপ্রদ বিনিয়োগই বটে যার সেরা সময়টা সামনে পরে আছে। ২২ বছর বয়সী জুলিয়ান আলভারেজকে মাত্র ১৪ মিলিয়ন পাউন্ডে দলে ভেড়ায় সিটি। রিভার প্লেটের আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড়কে বর্তমানে দক্ষিণ আমেরিকার সেরা প্রতিভা হিসেবে গণ্য করা হয়, হলান্ডের খবরের কারণে অনেকে হয়তো তা ভুলে গেছে। গত মৌসুমে বুন্দেসলিগায় দুর্দান্ত খেলা স্টেফান ওর্তেগাকে নিজেদের ব্যাকআপ গোলরক্ষক হিসেবে বিনামূল্যে দলে ভেড়ায় তারা।
দল বদলের বাজারে সিটিজেনরা আরও কিছু কেনা বেচা করবে বলেই ধারণা করা হয়। ব্রাইটনের লেফট ব্যাক মার্ক কুকুরেল্লাকে দলে ভেড়াতে আগ্রহী তারা অপরদিকে জিনচেনকোকে আর্সেনালের কাছে প্রায় ৩২ মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে ম্যানচেস্টার সিটি।
আরেক রক্ষণভাগের খেলোয়াড় নাথান একেকেও বিক্রি করে দিতে পারে সিটিজেনরা। ইতিমধ্যে তাদের ২৬ মিলিয়ন পাউন্ডের মুনাফা আছে এবং বাকি বেচা কেনা গুলো ঠিক মত সম্পন্ন হলে সিটিজেনরা এই মৌসুমের গ্রীষ্মকালীন দল বদলের বাজারে প্রায় ৭০ মিলিয়ন পাউন্ডের মুনাফা করবে বলে ধারনা করা হয়।
মাঠের ফুটবলে ম্যানচেস্টার সিটি আগে থেকেই বিজয়ী কিন্তু ‘তেলের টাকা ছাড়া তাঁদের ইঞ্জিন চলে না’ এই কথা বুঝি গায়েব হতে বসলো। ‘নিজের আয়ে খরচ করি’ এটাই বর্তমান ম্যানসিটির চিত্র, বাকিদের জন্য যা মোটেও সুখকর কোন খবর নয়, কারণ মাঠের বাইরে এবং ভিতরের কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতে আরও দুর্বার এক ম্যানচেস্টার সিটির ছবিই তুলে ধরছে।