ব্যাঙ্গালুরু, ২১-২৩ জানুয়ারি, ২০০৫। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে মুখোমুখি ভারত ও ইংল্যান্ড অনুর্ধ-১৯ দল। দু’দলই নেমেছে একঝাঁক তরুণ নিয়ে যাদের ভবিষ্যতের তারকা ধরা হচ্ছে। ভারতে যেমন রবিন উথাপ্পা, শিখর ধাওয়ান, পিনাল শাহ, মনোজ তিওয়ারি, ফৈজ ফজল তেমনই ইংল্যান্ড দলের মঈন আলী, জো ডেনলি। খেলায় প্রাথমিক প্রাধান্য বজায় রাখলেন ভারতীয়রাই।
উথাপ্পার-ধাওয়ানের হাফ সেঞ্চুরি, মনোজের ৪২ ভারতকে চালকের আসনে বসিয়ে দিয়েছে। ব্যাট করতে নেমেও বেশী কিছু করতে পারলো না ইংল্যান্ড, ভারত নিল ২২২ রানের লিড। পরের ইনিংসে ভারত ব্যাট করতে নেমে তুলে ফেলল দ্রুত ২০০। চতুর্থ ইনিংসেও ইংল্যান্ডকে দুরমুশ করে প্রায় ৩০০ রানের জয় পেলো ভারত।
ম্যাচের সেরার পারফরমেন্স দেখলে হয়তো ভাবতে পারেন যে একজনকে খেলায় কোনো জায়গা থেকে সরিয়ে রাখা যায় না তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। আদতেই তাই। পারফরমেন্স হলো ব্যাট হাতে দু’ইনিংস মিলিয়ে ৯২ রান এবং আটটি উইকেট যার মধ্যে একটি পাঁচ উইকেট রয়েছে। দ্বিতীয় ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরি, দ্বিতীয় ইনিংসে পাঁচ উইকেট। মনোজ তিওয়ারিকে ম্যাচ সেরার পুরস্কার দিতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হয়নি।
ব্রিসবেন তিন ফেব্রুয়ারি, ২০০৮। কমনওয়েলথ ব্যাংক সিরিজ এর প্রথম ম্যাচে মুখোমুখি ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া। দুই ওপেনার বীরেন্দ্র শেবাগ এবং শচীন টেন্ডুলকারকে ২৬ রানের মধ্যে হারানোর ধাক্কা সামলেছেন গৌতম গম্ভীর-রোহিত শর্মা। ৬৫ রানের জুটি জনসনের বল গম্ভীরের পা পেতেই শেষ হলো এবং দেখা গেলো অভিষেককারী ব্যাটসম্যানকে। মনে রাখতে হবে সদ্য অস্ট্রেলিয়ায় পা দিয়েছেন তিওয়ারি, ‘জেট ল্যাগ’ কাটেনি তখনও।
নেমেই একটি অসম লড়াই শুরু হলো জনসন-লির সঙ্গে। পনেরো বল কোনোভাবে খেললেন, তার একটি নিশ্চিত বাউন্ডারি বাদিকে ঝাঁপিয়ে বাঁচালেন মাইকেল ক্লার্ক। অত:পর ১৬ তম বলে ব্রেট লির বল ‘রাটলিং দ্য স্ট্যাম্প’ করতেই সাজঘরে ফেরা। ব্যাস, তিন বছরের মতো দাড়ি পড়লো তিওয়ারির আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে।
তার আগের পারফরমেন্স? নিজের দ্বিতীয় ঘরোয়া মৌসুমেই করা ডাবল সেঞ্চুরি, রঞ্জি সেমিফাইনালে কঠিন পরিস্থিতিতে ১৫১, রঞ্জি ফাইনাল এর চতুর্থ ইনিংসের ৯৪ মনে রাখলোনা কেউ। পরিসংখ্যান ঘাটলে বেরোয় তার আন্তর্জাতিক অভিষেকের আগের দুবছরের প্রথম শ্রেণীর গড় যথাক্রমে ৯৯ এবং ৪৯.৫০।
অগত্যা পড়ে গেলো ট্যাগ – ‘ব্রেট লিকে ঠিক খেলতে পারেনা বুঝলেন, আন্তর্জাতিক খেলায় টিকবে না।’ ভারত ‘এ’ দল অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিল ২০১৪-১৫ মৌসুমে। তিন ইনিংসে তার রান ১৪৬ তাও ৪৮ গড়ে! সত্যিই অস্ট্রেলিয়ার পিচে খেলতে জানেনা হয়তো।
যাই হোক। প্রশ্ন হয়তো এটাই যে দ্রাবিড়-শচীন-লক্ষণ সম্বলিত ভারতীয় টেস্ট দলের মিডল অর্ডারে কিভাবে সুযোগ পাবেন মনোজ? তার থেকে ভালো প্রথম শ্রেণীর রেকর্ড রয়েছে দক্ষিণী বদ্রীনাথ বা মুম্বাইকর শর্মাজীর। কিন্তু লিস্ট ‘এ’ রেকর্ড? সেই রেকর্ড বলে ২০০৮-০৯ মৌসুমে মনোজ তিওয়ারির গড় ৫২ এবং পরবর্তী মৌসুমে ৪০ এবং ২০১০-১১ মৌসুমে তা ৬১ ছুয়ে ফেলে।
হয়তো সেই ২০১০-১১ মৌসেুমে গড় তার জন্য ভারতীয় দলের দরজা আবার খুলে দেয়। কিন্তু তা আর কতদিনের জন্য? ওহ, বলা ভালো কটা ইনিংসের জন্য? পরবর্তী দুটি বছর ভারতীয় মিডল অর্ডারে ছয়টি ইনিংস খেলার সুযোগ পান তিনি এবং করে যান ৪৯.৪০ গড়ে ২৪৭ রান যার মধ্যে রয়েছে একটি সেঞ্চুরি, এবং একটি ৬৫ রানের ইনিংস। সেঞ্চুরি আসে ভারতের ১ রানে ২ উইকেট চলে যাওয়ার পরে চার নম্বরে ব্যাট করতে এসে।
পরিসংখ্যান দেখে কি বলবেন? দুটো ইনিংস বাদে কিছু নেই? আমি বলবো দেখুন সমসাময়িক বাকিদের। মহেন্দ্র সিং ধোনি, বিরাট কোহলি এবং সুরেশ রায়নার পরে সেরা নাম কিন্তু ওই হাওড়া তেলকলঘাটের ছেলেটার। ‘সেঞ্চুরি পাওয়ার পরে তাকে বসানোর কারণ কি?’ – এই প্রশ্নে সোচ্চার হয়েছেন অনেকেই, কিন্তু একবার ভাবুন কেন এই রেকর্ড সত্ত্বেও দু বছরে মাত্র ছয়টি ইনিংস পাবেন? যথাযথ উত্তর আসা বড়োই কঠিন।
তাঁর সম্পর্কে বলতে গেলে উঠে আসে অনেক কথা। সমর্থকদের এক এক মত। কেউ বলেন তার মধ্যে রয়েছে প্রভূত সিরিয়াসনেস এর অভাব, কেউ বলেন ‘সোশ্যাল মিডিয়া শো অফ’ বলতে তাঁরা একটাই নাম বোঝেন। আবার কারোর মুখে তার প্রচন্ড প্রতিভাধর হওয়া সত্ত্বেও সুযোগ না পাওয়ার একটা হতাশা তিনি প্রকাশ করেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। তবে তাঁর এই নিজেকে প্রকাশ করা যদি তলিয়ে ভাবেন খুব অপ্রত্যাশিত নয় বলেই মনে হবে।
পারফরম করে গেছেন প্রতি মৌসুমেই, কখনো গড় ৪৬, কখনো ৪৪ আবার বিগত দু’বছরে রয়েছে দুটি ৫০ গড়ে প্রথম শ্রেণী খেলার রেকর্ড। বিগত মৌসুমে আবার করেছেন একটি ট্রিপল সেঞ্চুরি, পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে দু’ইনিংসে যথাক্রমে ৬৫ ও ৭৩ যেখানে র্যাঙ্ক-টার্নার নাস্তানাবুদ করেছিল বাংলা, পাঞ্জাব দু’পক্ষকেই।
আইপিএল ফাইনালে রাইজিং পুনে সুপারজায়ান্টস খেলার অন্যতম স্থপতি হয়েও আজ আক্ষরিক অর্থে যেন প্রাপ্য কিছুই পাননা মনোজ। হয়তো ‘আচরণগত সমস্যা’ এবং অপ্রয়োজনে উইকেট ছুড়ে আসা ঢেকে দেয় সবকিছুকে। নাহলে সমসাময়িকরা কেউ ‘হিটম্যান’, কেউ ‘মিস্টার আইপিএল’, কেউ ভারতীয় ক্রিকেটের ‘গাব্বার’ আবার কেউ সর্বজনবিদিত ‘কিং’ হলেও তার নাম বিকৃত হয়ে ‘মোনজা’ নামই চলে ওই কতিপয় রঞ্জি দর্শকদের মধ্যে।
ভাগ্য এবং ম্যানেজমেন্ট সাথে থাকলে ক্রিকেটীয় জীবন অন্যরকম হতেই পারত। অন্তত আজ যা তার চেয়ে আরো বড়ো কিছু হওয়ার আশা তো ছিলই।