আমার নিশীথরাতের বাদলধারা

সব প্রশ্নের যেমন উত্তর হয় না তেমনি সব বন্ধুত্বের প্রকাশ বাইশগজে দেখা যায় না খালি চোখে। ওয়াসিম আকরাম থেকে গ্লেন ম্যাকগ্রা, মাখায়া এনটিনি থেকে মুরালিধরণ, মুশতাক থেকে ওয়ার্ন, গিলেস্পি থেকে চামিন্দা ভাস- বিশ্বের ত্রাস বোলিং লাইন আপের সামনে ভারতের প্রথম ঢাল ছিল এই দুই বন্ধু। শচীনের নিখুঁত ইনিংস বিল্ড-আপ আর সৌরভের আগ্রাসী অফস্টাম্পে যেকোনো বোলারকে আক্রমণ শুরু করত ভারতের হয়ে প্রথম সংহার।

রাতের বৃষ্টি আসলে স্মৃতিদের একপ্রকার নীরব বিদ্রোহ। রবি ঠাকুর সেই কবে লিখেছিলেন – ‘এসো হে গোপনে, আমার স্বপনলোকে দিশাহারা…’; এই যে রাতের গভীরে মনের সাথে স্মৃতির নীরব সমাপতন, ঘুম ভেঙে জেগে উঠে বারান্দায় গিয়ে ফিরে দেখা ছেলেবেলা, ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠা অবয়ব – লাল হয়ে আসা আকাশের গায়ে লেগে থাকা রূপকথার গল্প- সবকিছু মিলে মিশে ঝরে পড়ে, ঝরে যায় অবিরাম।

সকালে খবরের কাগজের দ্বিতীয় পাতায় খেলার সময়টা দেওয়া থাকত। সকালের স্কুল সেরে ছেলেবেলার দুপুরটা জুড়ে লেগে থাকত একটা অপেক্ষা। ভারতের ম্যাচ। আমাদের সকলের ঘরে ধুলো জমা মাইলো ব্যাট, হরলিক্সের সাথে ফ্রি পাওয়া বল,রঙিন ঘুড়ি, ছেঁড়া প্যাড- আর দুপুর জুড়ে দুটো লোক, দুটো অধ্যায়।

১৩৬ টা একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ৷ ৬৬০৯ রান। ভারতের নীল আকাশে গড়াপেটার কালোমেঘ সরিয়ে দিতে ১৩৬ বার ব্রহ্মাস্ত্র হাতে মাঠে নামতেন শচীন-সৌরভ৷ শচীন টেন্ডুলকার ও সৌরভ গাঙ্গুলি। কলকাতার এক বাংলা দৈনিক নাম দিয়েছিল ভারতের অর্জুন-কৃষ্ণ।

ওপেনিং ছাড়াও আরও ৪০ বার অন্যান্য পজিশনে একসাথে ব্যাটে নেমেছেন বাঙালি তরুণ ও মারাঠা সম্রাট। সর্বসাকুল্যে ১৭৬ ম্যাচে ৮২২৭ রান। শেষবার একসাথে ব্যাট হাতে নামা ২০০৭ সালে। পেরিয়ে গেছে এক যুগ। হ্যাঁ!

১২ টা বছর। বিশ্বের যেকোনো স্পোর্টস ওয়েবসাইট খুললে এক নম্বরে এখনো দুটো নাম জ্বলজ্বল করছে। ওপেনিং জুটিতে সর্বোচ্চ রান, সর্বোচ্চ ম্যাচ, সর্বোচ্চ বাউন্ডারি, সর্বোচ্চ শতরান পার্টনারশিপ – উত্তম কুমারের সেই বিখ্যাত ডায়লগ- ‘দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ…’ – এক যুগ পরেও যে ওপেনিং জুটির রেকর্ডবুক ছুঁতে পারে নি বিশ্বের কোনো ব্যাটসম্যান জুটি।

শচীন আর সৌরভ ভিভ-বোথাম নন, শচীন আর সৌরভ মার্সেলো-রোনালদো কিংবা ‘জাভিয়েস্তা’র মতো আঁকড়ে ধরা বন্ধুত্ব সেভাবে কোনোদিন অনস্ক্রিণ দেখাননি, শচীন বা সৌরভের আত্মজীবনীতেও নেই বন্ধুত্বের বিশেষ উল্লেখ। তবু কেন বন্ধুত্বের কথা এলেই তাঁদের নাম উঠে আসে এক নম্বরে? কেন শচীন বললে পরের শব্দবন্ধটা সৌরভই হয়ে যায় অবচেতনে?

সব প্রশ্নের যেমন উত্তর হয় না তেমনি সব বন্ধুত্বের প্রকাশ বাইশগজে দেখা যায় না খালি চোখে। ওয়াসিম আকরাম থেকে গ্লেন ম্যাকগ্রা, মাখায়া এনটিনি থেকে মুরালিধরণ, মুশতাক থেকে ওয়ার্ন, গিলেস্পি থেকে চামিন্দা ভাস- বিশ্বের ত্রাস বোলিং লাইন আপের সামনে ভারতের প্রথম ঢাল ছিল এই দুই বন্ধু। শচীনের নিখুঁত ইনিংস বিল্ড-আপ আর সৌরভের আগ্রাসী অফস্টাম্পে যেকোনো বোলারকে আক্রমণ শুরু করত ভারতের হয়ে প্রথম সংহার।

নিরানব্বই-এর টালমাটাল ভারতীয় ক্রিকেটের উলঙ্গ কাঠামোকে আড়াল করত দুটো চওড়া ব্যাট। সেই সময়ে হেডেন-গিলক্রিস্ট ছিলেন, ছিলেন ট্রেসকোথিক-হুসেন, ফ্লেমিং-আস্টেল ছিলেন- কিন্তু শচীন-সৌরভ লিগ্যাসির সামনে দাঁড়াতে পারেন নি কেউ, রেকর্ড কিন্তু সে কথাই বলছে।

রেকর্ড যেমন সব কথা বলে না তেমনি ছেলেবেলার স্মৃতি ধুলো জমলেও থেকে যায় সোনালি ফ্রেমের ভেতর। আমাদের বেড়ে ওঠার দুপুরগুলো আরও রঙিন করে দিতেন এই দুজন। বীরেন্দ্র শেবাগ নামক ঝড় আসার আগেই ভারতীয় ক্রিকেটের ইনিংস ওপেনিং-এর খোলনলিচা পালটে দিয়েছিলেন এই দু’জন।

রেকর্ড তৈরীই হয় ভাঙার জন্যে, আজ যে রেকর্ড ১২ বছরেও অটুট তা হয়ত অদূর ভবিষ্যতে ভেঙে দেবেন কেউ, ক্রিকেটের জয় তো এখানেই।কিন্তু নব্বই-এর দশকের আমার মতো একদল ছেলেমেয়ের বুকে রাতের গভীরে লম্বা রান চেজ করতে মাঠে ব্যাট হাতে নামবেন শচীন-সৌরভ।

রাতের আকাশে মেঘের চাদর ভেদ করে ঝরে পড়বে জল, একলা ঘরে চুপি চুপি সুরের রূপে আসবেন আমাদের দুই নায়ক। আরও অনেকদিন পর প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমরা গল্প শুনিয়ে যাব সচিন-সৌরভের, রাত নামলে আবার বৃষ্টি হবে- এই দুই নায়ক দু-উইকেটের মাঝে আবার দৌড়োবেন নব্বই-এর দশকের সকলের কাছে নিশীথ রাতের বাদলধারা হয়ে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...