বাংলাদেশ ক্রিকেটের আধুনিক যুগের প্রায় শুরুর দিক থেকেই বিদেশি কোচ নিয়োগের ধারা অব্যহৃত রয়েছে। মাঝে মাঝে ভারপ্রাপ্ত কোচের দায়িত্ব পালন করা ছাড়া দেশি কোচদের জাতীয় দলের আশে পাশে দেখা যায়না সে ভাবে। টেস্ট আঙিনায় পথচলার ২১ বছরেও দেশি কোচরা সুযোগ পেয়েছেন খুব সামান্যই। তবে এবার কোচ নিয়োগের এই ধারায় পরিবর্তন চান জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা।
সুযোগ পেয়ে দেশি কোচরা যে ব্যর্থ ছিলেন সেটা বলা যাবে না। আসলে সফলতা ব্যর্থতার মানদন্ডে ফেলার মত সুযোগই দেওয়া হয়নি তাদের। বিদেশি সব কোচও যে সুযোগ পেয়ে সফল ছিলেন বিষয়টা এমনও না। কয়েক জন কোচের হয়তো অনেক সাফল্য রয়েছে। তবে মাশরাফি মনে করেন বেশির ভাগ বিদেশি কোচই দল নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে চলে গেছেন। তাতে ক্ষতি হয়েছে আদতে বাংলাদেশেরই।
আজ (৭ সেপ্টেম্বর) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিজের ব্যক্তিগত প্রোফাইলে দেওয়া এক বিবৃতিতে এসব কথা বলেন মাশরাফি। জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক মনে করেন বাংলাদেশের ক্রিকেট ও ক্রিকেটারেদের সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে অনেক কোচই দায়িত্ব নিয়ে গোছানো দলটাকে আগোছালো করে ফেলেন। এর ফলে অনেক সময় দলের ভিতর বৈষম্য তৈরি হয়।
মাশরাফি বলেন, ‘আমার পয়েন্টটা হলো যে কোচের পছন্দ নির্দিষ্ট কিছু খেলোয়াড় হতেই পারে সেটা সব কোচেরই হয়। অন্যন্য দেশেও হয় এটাই স্বাভাবিক। তবে কখনও সেটা প্রকাশ্যে বুঝতে দেয়না, অনুমান করতে হয়।কারণ দলের সেরা তিন চার জন খেলোয়াড়ই শুধু ম্যাচ জেতায়না। আর জেতালেও আপনি একজনের জন্য আরেক জনকে ছোট করতে পারেন না। দর্শক বা সাংবাদিক অনেক কিছু লিখতেও পারে বলতেও পারে যেটা একদম নরম্যাল ব্যাপার।’
তিনি আরো বলেন, ‘কোচ কে বলা হয় ফাদার অফ দ্য সাইড। সে সবাইকে দেখে রাখবে। প্রয়োজনে কঠোর হবে আবার দলের স্বার্থে যাকে প্রয়োজন তাঁকে ব্যবহার করবে। তাঁর সব কিছুই হতে হবে পজিটিভ কারও প্রতি কঠোর কারও প্রতি নমনিয় এটা একরকমের বৈষ্যম্যতে রুপ নেয় আমাদের দেশে। যা গোছানো দলকে অগোছালো করে ফেলে। এক পর্যায়ে তাঁরা আবার নিজেদের দেশে, না হলে আইপিএল বা আরও ভালো কোন অফার পেয়ে চলে যাবে। কারণ এতো দিনে সে আমাদের দেশের ক্রিকেট কে নিয়ে অনেক এক্সপেরিমেন্ট করে নিজের অভিজ্ঞতা বাড়িয়েছে, নিজের প্রোফাইল ও ভারি করেছে মাঝখান দিয়ে। আর বেতন তো নিয়েছে মাসে ১২/১৫ লাখ টাকা। আর আমাদের কোচ গুলো না খেয়ে মরে। গালি ও দেখি আমাদের কোচরাই হজম করে। আর পরে ওনারা চলে গেলে আমরা পড়ি বিপদে আবার নতুন কোচ নতুন পরীক্ষা নতুন দাবি মেটানো। এভাবেই চলছে বাংলাদেশে কোচদের যাওয়া আসা।’
বিদেশি কোচ নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মাশরাফি। জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক মনে করেন সব সময় বিদেশি হাই প্রোফাইল কোচ নিয়োগ দিতে গিয়েই ভুলটা করে ফেলে বাংলাদেশ। মাশরাফি মনে করেন হাই প্রোফাইল কোচ খুঁজতে গিয়ে করা এই ভুলের কারণেই পরে আর ঐ বিদেশি কোচ কোন কাজে আসে না বাংলাদেশের।
তিনি বলেন, ‘এবার আবার আসি আমার প্রথম লাইনটায়, কোচ নিয়োগের সময় যে নতুন কোচের ইন্টারভিউ নেওয়া হয় সেখানে আসলে তাকে কি প্রশ্ন করা হয়? বা আদেও কি করা হয় কোন প্রশ্ন? নাকি শুধু জানতে চাওয়া হয় তোমার কি করার ইচ্ছা। হয়তো তখন সে কিছু পয়েন্ট তুলে ধরে ওখান থেকে নতুনত্ব কিছু পেলে চিন্তা করে দারুন কোচ কি সুন্দর প্লান এর মতো কোচই হয়না। আমার তো মনে হয় ভুল ওখানেই হয়ে যায়। কারন আমরা মানুষকে বোঝাতে সব সময় হাইপ্রোফাইল কোচ খুঁজি যা পরে আর কোন কাজে আসেনা।’
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে মাশরাফি বলেন, ‘এ যাবত কালে প্রায় ৯/১০ জন কোচের সাথে কাজ করেছি আমি যতটুকু দেখেছি প্রত্যেকটা কোচ তার নিজের মতো করে কাজ শুরু করে। যেটা করাটাও স্বাভাবিক। কারণ এক এক জনের কাজের ধরন এক এক রকম। কিন্তু সব সময় দেখেছি প্রত্যেকটি কোচ তার নিজস্ব একজন বা দুইজন প্রিয় খেলোয়াড় বানিয়ে নেয়, যা পরে সিলেক্টর, ক্যাপ্টেন বা অন্যকেউ তাকে আর কিছুই বুঝাতে পারেনা। বরং সম্পর্ক গুলো জটিল হতে থাকে আর ঐ পছন্দের জন্য সে আবার দুই জনকে এমন অপছন্দ করা শুরু করে যে তাদের আর দেখতেই পারেনা। এক পর্যায়ে এমন জিদ শুরু করে যে প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দিব, এমন কথা প্রকাশ্যেও শুনেছি কয়েকবার কোচের মুখে।’
তবে বিদেশি কোচ নিয়োগের ব্যপারে কোন আপত্তি নেই মাশরাফির। তিনি জানিয়েছেন বেদেশি কোচ যাকে নিয়োগ দেওয়া হবে সে যেনো বাংলাদেশের সব ক্রিকেটার সম্পর্কে যেনে এসে সাক্ষাৎকার দেয়। কারণ সে যেনো বোঝে অতীতে কারা অবদান রেখেছে। অতীতে আমাদের সেরা ক্রিকেটারদের কী ভাবে তৈরি করা হয়েছে।
মাশরাফি বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজন আমাদের ক্রিকেট যে ফলো করে বা আমাদের ম্যাক্সিম্যাম খেলোয়ারদেরকে নিয়ে স্ট্যারডি করে এসে ইন্টারভিউ দিচ্ছে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে নুন্যতম ধারনা নিয়ে আসা।তা না হলে -ও তো বুঝবেই না একজন সাকিব,তামিম, মুশফিক,রিয়াদ তৈরি করতে কতো দিন লেগেছে।বা অতীতে তাদের অবদান কি।একজন মুস্তাফিজ কিভাবে উঠে এসেছে।বার বার বলেছি আবার ও বলছি দলের আগে কখনোই কোন খেলোয়ার হতে পারেনা ভালো না করলে বাদ পড়তেই হবে।’
তবে সব কিছু মিলিয়েই মাশরাফি জাতীয় দলে দেশি কোচদেরই চেয়েছেন। জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক জানিয়েছেন বেদেশি কোচরা আমাদের দেশের ক্রিকেট সম্পর্কে তেমন ধারনা রাখে না। তাঁরা চাকরির জন্য আসে, চাকরি শেষ হলে চলে যায়। তাই মাশরাফি মনে করেন হাই প্রোফাইল নয়, প্রয়োজন দেশি কোচ।
তিনি বলেন, ‘অফ ফর্মে সব খেলোয়াড়ের জীবনেই যায়। বাদ ও পড়ে কিন্তু ম্যানেজমেন্ট থেকে অপমানিত শুধু আমাদের দেশেই বেশি হয়। পারফরম না করলে বাদ দিবেন স্বাভাবিক, আবার তাকে তো সহযোগিতা করতে হবে কিভাবে তাকে ফরমে আনা যায় বা তাকে মেন্টালি কিভাবে সাপোর্ট করা যায়। কোন ভাবেই আপনি বুঝতে দিতে পারেন না যে আপনি তাকে আর আপনার সময়কালে দেখতে চাননা। এটার কারণ একটাই কোন কোচই আমাদের দেশে কাজ করার আগে আমাদের দেশের ক্রিকেট ফলোয়ার না।চাকরির জন্য আসে শেষ হলে চলে যায়। তাই আমার মনে হয় হাই প্রোফাইল নয় আমাদের প্রয়োজন আমাদের কোচ, বাংলাদেশের কোচ। একদম নিজস্ব মতামত আপনাকে মানতে হবে তা বলিনি।’