চাপ জয়ের গল্পে মেসি পিছিয়ে!

ম্যাচের তখন সবে ১০ মিনিট। সৌদি আরবের বিপক্ষে পেনাল্টি পেল আর্জেন্টিনা। আর্জেন্টাইন নাম্বার টেন লিওনেল মেসি দাঁড়িয়ে গেলেন স্পটকিকে। আলতো করে বলটা বাঁ পাশে ছুড়ে দিয়ে গোল করলেন। আর তাতে প্রথম আর্জেন্টাইন ফুটবলার হিসেবে চারটি পৃথক বিশ্বকাপে গোল করার একটি কীর্তিও গড়া হলো।

সতীর্থদের আলিঙ্গনে কেন্দ্রিভূত হলেন তখনই। স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে উঠার প্রথম ধাপটায় সেই চিরায়ত হাসি দিয়েই শুরু করলেন। কিন্তু রেফারি যখন ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজালেন ঠিক তখনটাতেই সব ছিন্নভিন্ন। সতীর্থরা মাটিতে লুটে পড়ে আছে। এক রাজ্য হতাশা আর চোখেমুখে বিষণ্ণতা নিয়ে একাকী মাঠ ছাড়লেন মেসি।

আকাশি নীল জার্সিতে মেসি ঠিক এমনই। সফলতার কেন্দ্রেও তিনিই থাকেন, আবার ব্যর্থতার কেন্দ্রেও মূলহোতা হয়ে যান তিনি। দলগত ব্যর্থতার সমালোচনায় কেন বারবার মেসিকে শুধু একাই বিদ্ধ হতে হয়? ইতিবাচক দিক দিয়ে ভাবলে সেটা অমূলক নয়। কাতার বিশ্বকাপের আগে চার চারটি বিশ্বকাপ খেলেছেন। কিন্তু সব আসরেই তাঁর বিদায় হয়েছে মলিন মুখে মাথা নত হয়ে। ২০১৪ বিশ্বকাপে খুব কাছে গিয়েছিলেন, কিন্তু জার্মানির কাছে হেরে শেষ পর্যন্ত সেই অধরা ট্রফিটি আর স্পর্শ করা হয়নি মেসির।

সেবারের বিশ্বকাপে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হওয়ার কারণে গোল্ডেন বল পেয়েছিলেন বটে। কিন্তু গোল্ডেন বল তো আর কোনো বিশ্বকাপ নয়। প্রশ্ন আসতেই পারে, একটা বিশ্বকাপের জন্য মেসির প্রতি যে চাপটা চাপিয়ে দেওয়া হয় সেই চাপ কি তাঁর সমসাময়িক রোনালদো পান? হয়তো রোনালদো পান না। কিন্তু রোনালদোর দেশটার ইতিহাসে যে কোনো বিশ্বকাপ ট্রফি নেই। যেখানে মেসির দেশের ইতিহাসে রয়েছে দুই দুইটি বিশ্বকাপ ট্রফি।

এখন সেই লিগ্যাসি ধরে রাখতে না পারলে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে মেসি তো থাকবেনই। কারণ তাঁর হাত ধরেই তো আর্জেন্টিনার ফুটবল চলছে এক যুগ পেরিয়ে সতেরটা বছর। ১৭ বছর সময়টা কম না। এমন দীর্ঘ সময়ে একটা বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকতেই পারে সমর্থকরা। কিন্তু সেটা হয়নি। সমর্থকরা আশায় বুক বেঁধেছেন। আর মেসিও বারংবার হতাশা উপহার দিয়েছেন।

মেসি একা কি করবে?- এমন একটা উক্তি নিয়ে সোশ্যাল সাইটগুলোতে ট্রলের বেশ চল আছে। কিন্তু সেটা শুধু হাস্যরসাত্মক অর্থে উড়িয়ে দেওয়ারও কিছু নেই। কারণ ৮৬ এর বিশ্বকাপ তো ম্যারাডোনা বলতে গেলে একাই জিতিয়েছিলেন আর্জেন্টিনাকে। হ্যা এটা ঠিক। ফুটবলের দিন পাল্টেছে। গতি এসেছে। একক নৈপুণ্যে গোটা একটা টুর্নামেন্ট জেতানো এখন বেশ কষ্টসাধ্যই। কিন্তু ফুটবল গ্রেটদের পার্থক্য তো এখানেই তৈরি হয়। অসাধ্যকে সাধন করেই সেই কাতারে যেতে হয়।

বেশিদূর যেতে হবে না, দুই দশক আগের বিশ্বকাপেই ফিরে যাওয়া যাক। ২০০২ এর সে বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছিল ব্রাজিল। সে বিশ্বকাপে রোনালদো একাই ৭ ম্যাচে করেছিলেন ৮ গোল। যদিও ব্রাজিলের সে দলটা বলা হয় সর্বকালের অন্যতম সেরা। কিন্তু তারপরও এক বিশ্বকাপে শুধু কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচ ব্যতীত সব ম্যাচে গোল করাটা চাট্টিখানি কথা নয়। বড় ফুটবলারদের তাই পরিচয় হয় বড় ম্যাচে জ্বলে ওঠার ফলে।

লিওনেল মেসি বোধহয় এখানেই একটু পিছিয়ে। ক্যারিয়ারে শত শত গোল করেছেন। কত শত চাপের মুহূর্ত জয় করেছেন। কিন্তু আর্জেন্টিনার জার্সিতে আসলেই মনে হয় তাঁকে জাগতিক সব চাপ পেয়ে বসে। আর্জেন্টিনার হয়ে ব্যক্তি অর্জনও তাঁর অনেক। মহাদেশিয় ট্রফির সেরা খেলোয়াড়, সেরা গোল স্কোরার, কিংবা বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল- সবই পেয়েছেন। কিন্তু ঐ যে ম্যারাডোনার মতো ঐশ্বরিক তেমন কিছু করতে পারেননি। বারবার এসে থেমে গেছেন কিংবা ব্যর্থ হয়েছেন।

কাতার বিশ্বকাপ মেসির শেষ সুযোগ। শেষের শুরুটা ভাল হয়নি ঠিকই, তবে এমন কঠিন মুহূর্তগুলোতেই তো সব কিছুর পরীক্ষা হয়ে যায়। মেসিকেও এই শেষের পরীক্ষায় উতরে যেতে হবে। আগের বছরেই কোপা জিতেছেন। সেই মধুর স্মৃতিকে অবলম্বন করে মেসিরা অনেক দূর পথের স্বপ্ন দেখতেই পারে। তবে শঙ্কাটা হলো, এর বৈপরীত্য ঘটলে মেসির নামের পাশে ডাহা ফেল ট্যাগলাইনও অকল্পনীয় ভাবে বসে যেতে পারে।

মেসিদের আগামী চ্যালেঞ্জ মেক্সিকো। নিজেদের বিশ্বকাপ মিশন বাঁচিয়ে রাখতে এ ম্যাচটা জিততেই হবে তাদের। বাজে শুরুর পরেও শেষটা রঙিন করার বহু উদাহরণ আছে ইতিহাসে। এখন সেসব ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি করার দিকে চোখ রাখতে হবে মেসিকে। সেটি করতে পারলেই তাঁর আর একাকী প্রস্থান হবে না, আবারো সতীর্থদের আলিঙ্গনে কেন্দ্রিভূত হবেন তিনি। এমনকি প্রশংসা বাণীতেও ঘিরে থাকবে মেসির নাম।

৭৮ এ প্যাসারালা জিতেছিলেন, ৮৬ তে ম্যারাডোনা। ২০২২ এ কি তবে মেসি? তিন যুগ পরে এমন একটা সম্ভাবনার গল্প বাস্তবায়ন করতেই পারেন মেসি। তবে তার জন্য তাঁকে পেরোতে হবে অনেক কঠিন পথ। বিশ্বজয়ের পথটা তো এমনই। সব সময় মসৃণ নয়, বন্ধুর পথ ডিঙ্গিয়েই এগিয়ে যেতে হয় সম্মুখপানে।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link