১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনাকে প্রথম বিশ্ব জয়ের স্বাদ দিয়েছিলেন মারিও কেম্পেস। এরপর ১৯৮৬ সালে তো পুরো বিশ্ব দেখেছে ম্যারাডোনাময় বিশ্বকাপ আসর। পরের টুর্নামেন্টেই আবারো লাতিন আমেরিকার দেশটি পৌঁছে গিয়েছিল ফাইনালে।
কিন্তু, সেবার আর হাতে ওঠেনি সোনালী ট্রফি। এরপর কেটে গিয়েছে তিন দশকের বেশি সময়, কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের সেই মুকুট অধরাই ছিল আলবিসেলেস্তাদের জন্য। কখনো হৃদয় ভেঙেছে ভাগ্যের পরিহাসে কখনো আবার খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স ছিল ছন্নছাড়া।
অবশেষে দু:স্বপ্ন কেটে ভোর হয়েছে; কাতার বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। শুধু নয় নয়, ২০২১ ও ২০২৪ – টানা দুই কোপা আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব জিতেছে আর্জেন্টিনা। ভক্ত-সমর্থকদের বিশ্বকাপ না জেতার আক্ষেপ ঝরেছে আনন্দের অশ্রু হয়ে।
নিজের বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ারকেও পূর্ণতা দিতে পেরেছেন লিওনেল মেসি। ফুটবলের সম্ভাব্য সব অর্জনই ছিল মেসির ঝুলিতে, কিন্তু একটি বিশ্বকাপের অভাব বড্ড কটু লেগেছিল। কিন্তু সেই ঘাটতি এবার পূরণ হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশে সোনালী ট্রফিতে চুমু এঁকে দিয়েছেন আর্জেন্টাইন অধিনায়ক।
বিশ্বকাপের পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই লিওনেল মেসি ছিলেন সেরা ছন্দে। সাত ম্যাচে করেছেন সাত গোল আর তিনটি অ্যাসিস্ট; সতীর্থদের গোল করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন অনেক বারই। দুর্দান্ত পাসিং, ড্রিবলিংয়ে প্রতি ম্যাচেই মেসি মুগ্ধ করেছেন দর্শকদের। আসরের পাঁচ ম্যাচেই প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হয়েছিলেন পিএসজি ফরোয়ার্ড। আর শেষপর্যন্ত ফিফার গোল্ডেন বলও তাঁর হাতে উঠেছে।
ঠিক এমনই একটি জাদুকরি পারফরম্যান্স লিওনেল মেসি দেখিয়েছিলেন ২০১৪ সালে; সেই আসরেও সেরা ফুটবলারের পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি। কিন্তু সে সময় শেষটা সুন্দর হয়নি, জার্মানির বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে মারিও গোৎজের হাতে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল তাঁর।
কিন্তু, এবার আর ভুল করেনি আকাশি-সাদা জার্সির প্রতিনিধিরা। টাইব্রেকারে স্নায়ুর পরীক্ষায় জিতে তৃতীয় তারার মালিক হয়েছে দলটি ৷ অন্য কোন সময়ের কিংবদন্তিদের সাথে তুলনা করলে প্রজন্মের ব্যবধানের অজুহাতে থামিয়ে দেয়া যাবে, কিন্তু আধুনিক ফুটবলের সেরা ফুটবলার কে সেই বিতর্ক হয়তো শেষ হয়ে গিয়েছে।
সাতটি ব্যালন ডি’অর, ছয়টি ইউরোপীয়ান গোল্ডেন বুট, সাতশতের অধিক গোল, ভুরি ভুরি অ্যাসিস্ট আর সম্ভাব্য সব শিরোপা – লিওনেল মেসির ক্যাবিনেটে আছে সবকিছুই। আর কারোই নেই এত সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লিওনেল মেসির ব্যর্থতা তাঁকে অনেকটা সময়ই দমিয়ে রেখেছিল।
গ্রহের সেরা ফুটবলারের বিতর্কে এই একটা জায়গায় ম্লান ছিলেন তিনি। কিন্তু এসব এখন অতীত, ২০২১ সালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপা জিতে আর্জেন্টিনার জার্সিতে প্রথম মেজর শিরোপার স্বাদ পান এই সুপারস্টার। এক সময় জিততে না পারা আর্জেন্টিনাকে আর যেন হারানোই যাচ্ছে না। ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রায় সব বড় ট্রফিই নিজের করে নিচ্ছে তাঁরা।
আর এবার তো গ্রেটনেসের সব মানদন্ডকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন লিওনেল মেসি। ফুটবলের সব দলীয় আর ব্যক্তিগত অর্জন নিজের করে নিয়েছেন তিনি। ঝড় তুলেছেন রেকর্ড বইয়ে, গড়েছেন অতিমানবীয় সব মাইলফলক।
এক বছরেই ৯১ গোল করা বা বিশ্বকাপে দুইটি গোল্ডেন বল জেতার মত এমন সব কীর্তি আছে তাঁর নামের পাশে যা আর কেউ ভাঙ্গতে পারবে কি না সেটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাই এখন অন্তত আত্মবিশ্বাস নিয়েই মেসিকে সর্বকালের সেরা বলা যেতে পারে।
আর লিওনেল মেসির সবচেয়ে বড় দিক নিশ্চয়ই তাঁর মন জুড়ানো খেলার ধরন। পায়ের জাদুতে মানুষকে কাছে টেনেছেন তিনি, বাধ্য করেছেন ফুটবলকে ভালবাসতে। সেসব মানুষ তাঁকেও ভালবাসতে কার্পণ্য করেনি, কারো কাছে ‘মেসি’ ফুটবলের সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছেন। আগামী কয়েক দশকেও হয়তো একই ভাবে বিরাজ করবে লিওনেল মেসির প্রতি মানুষের ভালবাসা।