সাল ১৯৯৮। ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীরা সাধারণত বছরটা মনে রাখেন শচীন টেন্ডুলকারের অতিমানবীয় সাফল্যের জন্য এবং সঙ্গত কারণেই। কিন্তু বছরটা মাইকেল আথারটন নামক এক ভদ্রলোকের জন্যও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ। বছরের শুরুতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সিরিজ হেরে অধিনায়কত্ব থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।
নিজের ফর্মও তথৈবচ। ঠিক তার আগের দু বছর, অর্থাৎ ১৯৯৬ ও ১৯৯৭, তাঁর গড় যথাক্রমে ৩১.২৬ ও ৪১.৫৭। ১৯৯৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর অবধি তাঁর গড় ১৮.০৯। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ টায় অবশ্য দারুন শুরু করেন। অধিনায়কত্বের চাপ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে, প্রথম ইনিংসেই ১০৩। তৃতীয় টেস্টে ম্যাচ বাঁচানো ৮৯। প্রায় সাড়ে ছ ঘন্টা ব্যাট করে। দক্ষিণ আফ্রিকা অবশ্য সিরিজে ততদিনে এগিয়ে রয়েছে ১-০ এবং সেটা আশ্চর্য্যের ব্যাপার না।
দক্ষিণ আফ্রিকা তখন অস্ট্রেলিয়ার পিছনেই, বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা দল। কি ওয়ানডে, কি টেস্ট। কি কি সব খেলোয়াড় তাদের। জ্যাক ক্যালিস উদীয়মান। এছাড়াও ড্যারিল কালিনান, ক্রনিয়ে, গ্যারি কার্স্টেন, শন পোলক এবং সর্বোপরি ডোনাল্ড।
এর সাথে উলমারের মস্তিষ্ক যোগ হয়ে একেবারে মাখো-মাখো ব্যাপার। অস্ট্রেলিয়া যদি সেই সময়ের কলকাতা বিরিয়ানি হয়, দক্ষিণ আফ্রিকা হায়দরাবাদি বিরিয়ানি তো নিশ্চয়। বাকিরা অনেক অনেক পেছনে। এবং ইংল্যান্ডকে ভেজ বিরিয়ানি বললেও বোধহয় ভুল হবে না।
এমন অবস্থায় শুরু হয় ট্রেন্টব্রিজ টেস্ট। যে টেস্টের একটি বিশেষ ঘটনা নিয়ে এই লেখা। ঘটনাটি ঘটেছিলো আজকেরই দিনে, ২৩ বছর আগে। অধিনায়ক ক্রনিয়ের ১২৬ এর ওপর ভর করে দক্ষিণ আফ্রিকা তোলে ৩৭৪। ইংল্যান্ড অবশ্য জবাব খারাপ দেয়নি। মাইকেল আথারটন, মার্ক বুচার ও মার্ক রামপ্রকাশের হাফ সেঞ্চুরি তাদের পৌঁছে দেয় ৩৩৬ রানে।
দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বিতীয় ইনিংসে হুড়মুড় করে ভেঙে পরে অঙ্গস ফ্রেজারের ৫ উইকেটের সামনে। ইংল্যান্ডের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৪৭। তবুও এই রান অনেক। শেষ ইনিংসে ডোনাল্ড, পলকদের সামনে এই রান করতে গেলে কোনো একজনকে বড় ইনিংস খেলতেই হবে। এবং গুচ পরবর্তী ইংল্যান্ডের হয়ে এই কাজটি একজনই করেন, শ্রীযুক্ত মাইকেল আথারটন।
সে যতই ধারাবাহিকতার অভাব থাকুক, কঠিন সময়ে তৎকালীন ইংল্যান্ডে খেলতেন ওই আথারটন। সেই সিরিজেই তো একটি ম্যাচ বাঁচিয়েছিলেন। এর বছর তিনেক আগে জোবার্গে এই ডোনাল্ডকেই রুখে বাঁচিয়েছিলেন একটি নিশ্চিত হারা ম্যাচ।
তৎকালীন তিন সেরা ফাস্ট বোলার – গ্লেন ম্যাকগ্রা, কার্টলি অ্যামব্রোস ও অ্যালান ডোনাল্ড (ওয়াসিম আকরামকে সেরকম খেলেননি আথারটন, কারণ ইংল্যান্ড সেই সময় পাকিস্তানের সাথে খুব কম খেলতো) ত্রয়ীর বিরুদ্ধে আথারটন এর সম্পর্ক টা আশ্চর্য্য। ম্যাকগ্রা ও অ্যামব্রোসদের খদ্দের ছিলেন একরকম। কিন্তু ডোনাল্ড কোনোদিন আথারটনের মাথায় চড়ে বসতে পারেননি। ডোনাল্ড-আথারটন মুখোমুখি সাক্ষ্যাতে, ততদিন অব্দি আথারটন কিন্তু কিছুটা এগিয়ে।
তবে, ডোনাল্ড তো আর ছাড়ার পাত্র নন। অল্প রানের পুঁজি। সামনে চিরশত্রু আথারটন। নায়ক হবার এই সুযোগ তিনি ছেড়ে দেবেন? এবং যেভাবে শুরু করেছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিলো ইংল্যান্ডের গুটিয়ে যাওয়া সময়ের অপেক্ষা। আথারটনের সাথে ডোনাল্ডের ডুয়াল দেখতে দেখতে মনে হতে পারে, হিন্দি ছবির শেষ দৃশ্যের ঝাড়পিট। হিরো চরম মার খাচ্ছেন। সময়ে সময়ে জীবন সংশয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ঠিক মেরে বেরিয়ে গেলেন।
হিরো অবশ্যই আথারটন এবং বলিউডি ঝাড়পিটের সাথে পার্থক্য বলতে, সময়টা অনেক বেশিক্ষন এবং কোনো রিটেক নেই। একবার অবশ্য আথারটন ২৭ রানে আউট ছিলেন। আম্পায়ার দেননি। জীবনে বহু ক্রিকেট দেখেছি।
কিন্তু, কোনো বোলারকে এত ভাল বল করেও উইকেট না পেতে খুব কম বার দেখেছি। আর আথারটনের সাহস। আজকের দিনে আমরা পুজারা এবং তাঁর গায়ে মাথায় বল খেয়েও দাঁড়িয়ে থাকা নিয়ে কত লাফালাফি করি। আথারটন সেদিন যে সাহস ও জেদের পরিচয় দেন, তা ভাষায় বর্ণনা করা মুশকিল।
কেউ বলবেন বন্য সাহস। আমি বলবো শীতল সাহস। ডোনাল্ডের আগুনে দৃষ্টি ও বোলিংয়ে যেকোনো সময়ে পুড়ে যেতে পারেন জেনেও কি অসামান্য ব্যাটিং। আথারটন ৯৮ রানে অপরাজিত থেকে ইংল্যান্ডকে ৮ উইকেটে ম্যাচ জিতিয়ে ফেরেন। একঝলকে স্কোরকার্ড দেখে যে কেউ ইংল্যান্ডের সহজ জয় বলে ভুল করতে পারেন। কিন্তু সত্য তার চেয়ে কয়েক যোজন দূর।
পরের টেস্টে দক্ষিণ আফ্রিকা ২১৯ তাড়া করতে না পেরে হেরে যায়। সিরিজ জলাঞ্জলি যায়। এবং ওই ইংরেজিতে ‘সি’ দিয়ে শব্দটা দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটের টিউমার হয়ে এখনো রয়ে গেছে। তার আগে অস্ট্রেলিয়া সফরে এডিলেড টেস্ট জিততে পারার সহজ সুযোগ হাতছাড়া করার পর থেকেই স্টিভ ওয়াহে এবং অস্ট্রেলিয়রা প্রচার শুরু করে।
ইংল্যান্ড সফরের দুর্বিষহ হার বোধহয় দক্ষিণ আফ্রিকাকে ওই ইংরেজির ‘সি’ দিয়ে শব্দটির পেটেন্ট পাওয়ার ব্যবস্থা আরো পাকা করে। এবং তার পিছনে ওই ডোনাল্ড নামক আগুনকে ট্রেন্টব্রিজে নেভানোর মূল কান্ডারী, শ্রীযুক্ত আথারটনের বেশ কিছুটা হাত ছিল।