২০১৪ সালের কথা। মাশরাফি বিন মুর্তজা অধিনায়ক হিসেবে ফিরে আসার পর থেকে একের পর এক সাফল্যে দেশের ক্রিকেট তখন উত্তাল। ২০১৫ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে কোয়াটার ফাইনাল খেলার ফল মাশরাফির দল ঘরের মাটিতে ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকাকে বলে কয়ে ওয়ানডে সিরিজে হারিয়ে দিল।
সবাই তখন মাশরাফি বন্দনায় ব্যস্ত। সেই সময়েই অনেকটা আমাদের সবার চোখের আড়ালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলেরও এক নতুন অধিনায়কের নাম ঘোষণা করা হলো। পরের বছর ঘরের মাটিতে ওদের বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপে এর আগে বলার মতো কোনো সাফল্য নেই । তাই ঘরের মাটিতে বড় স্বপ্ন নিয়ে ব্যাটিং অলরাউন্ডার মিরাজের হাতে তুলে দেয়া হলো অধিনায়কত্বের দায়িত্ব। বড় ভাই মাশরাফির দেখানো পথেই হাটলেন তিনি। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে নিয়ে গেলেন সেমিফাইনাল অবধি।
সেই টুর্নামেন্টে দলের ব্যাটিং নিউক্লিয়াসের কাজ করেছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। মিডল অর্ডারে নেমে কখনো খেলেছেন বড় পার্টনারশিপ করার লক্ষ্যে। আবার কখনো খেলেছেন দ্রত রান করার জন্য। বিশ্বকাপের ছয় ম্যাচে মিরাজের মোট রান ২৪২। বল হাতেও মিরাজ নিয়েছিলেন মোট ১২ উইকেট। হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়
তবে আমরা তখন তাঁর এই ব্যাটিং দেখে একটুও অবাক হইনি। কেননা আমরা জানতাম মিরাজ কীভাবে বিশ্বকাপের আগে খুলনার মাঠে দিনেরপর দিন ব্যাটিং অনুশীলন করেছেন। আমরা দেখেছিলাম মিরাজের হাতে কত রকমের শট।
বিশেষ করে ব্যাকফুটে তাঁর সাবলীলতা আমাদের সবাইকে তখনই মুগ্ধ করেছিল। মিরাজ তখন সবে ১৭ বছরের এক কিশোর মাত্র। যিনি পরবর্তীকালে কীভাবে যেনো হয়ে যাবেন দলের রাইট আর্ম স্পিনার যিনি ৮ নম্বরে ব্যাটিং করেন।
২০১৬ বিশ্বকাপের এমন পারফরম্যান্সের পর মিরাজের জাতীয় দলে পদার্পণ করাটা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেবছরই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় তাঁর। অভিষেকেই বল হাতে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন আপ চুরমার করে দিয়েছিলেন মিরাজ।
দুই ম্যাচের সেই অভিষেক টেস্ট সিরিজে বল হাতে মিরাজ একাই নিয়েছিলেন ১৯ উইকেট। এই অভিষেকটাই বোধহয় কাল হয়ে দাড়িয়েছিল মিরাজের জন্য। অলরাউন্ডার মিরাজ এক সিরিজেই বনে গেলেন বোলার মিরাজ। সেই থেকে নিয়মিত মিরাজ জাতীয় দলে আছেন তবে তাঁর পুরোটা কী দল পাচ্ছে? তাঁর সেই অন্যতম শক্তির জায়গা ব্যাটিংটা কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো। দল কী কখনো এই নিয়ে একটুও চিন্তিত।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশ হারলেও মিরাজ আবারো প্রমাণ করলেন তিনি একজন অলরাউন্ডার। বোলিং অলরাউন্ডার বা ব্যাটিং অলরাউন্ডার নয়, একবারে জেন্যুইন অলরাউন্ডার। এই সিরিজেও বোলার হয়ে দলের চাহিদা পূরণ করেছেন তিনি। দুই টেস্টে নিয়েছেন মোট ১০টি উইকেট।
তবে নিজের বয়স ভিত্তিক দলের ব্যাটিংটাকে বোধহয় মিস করছিলেন মিরাজ। হয়তো নিজেকেই প্রশ্ন করেছিলেন তাহলে কেনো সেই কিশোর বয়সে ঘন্টার পর ঘন্টা নেটে ব্যাটিং করে যেতাম। যেভাবেই হোক আমরা আবার আমাদের সেই চেনা ব্যাটসম্যান মিরাজকে দেখেছি এই সিরিজে।
প্রথম টেস্টে ৮ এ ব্যাট করতে নেমে করেছেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। দ্বিতীয় টেস্টেও মিরাজ ব্যাটিং করেছেন দলের চাহিদা মিটিয়ে। ম্যাচের পরিস্থিতি বুঝে, একেবারে সলিড ব্যাটসম্যানের মত অথরিটি নিয়েই ব্যাটিংটা করেছেন।
আসলে মিরাজ হচ্ছেন প্রকৃত ‘টিম ম্যান’। দল তাঁর কাছ থেকে যখন যা চেয়েছে মিরাজ তখন ঠিক সেটাই দিয়েছেন। টিম যেদিন বলেছে মিরাজ তুমি শুধু বোলার, মিরাজ সেদিন থেকে এক কথায় বোলার বনে গিয়েছেন। যখন ব্যাটিংয়ে অবদান চেয়েছে সেই অবদান তিনি রেখেছেন। এশিয়া কাপের ফাইনালে ওপেন করেছেন, টেস্টে সাত-আটে নেমে সেঞ্চুরি করেছেন, কখনো চতুর্থ ইনিংসে ম্যাচ জেতানোর জন্য সংগ্রাম করেছেন। এই নিবেদনটা আমাদের সো কল্ড বিগ থিঙদের মধ্যে কোথায়!
এই সিরিজে তিনি বাংলাদেশের চতুর্থ বোলার হিসেবে ১০০ টি টেস্ট উইকেটের মালিক হন। তবে তিনিই দেশে সবচেয়ে দ্রুত এই কীর্তি করেছেন। এর আগে তাইজুল ২৫ ম্যাচে এই কীর্তি করেছিলেন। তবে মিরাজ ১০০ উইকেট নিয়েছেন মাত্র ২৪ টেস্টে। বিশ্বের দ্রুত ১০০ উইকেট পাওয়া স্পিনারদের মধ্যেও তিনি চতুর্থ। তার চেয়ে দ্রুত ১০০ টেস্ট উইকেট পেয়েছেন নিউজিল্যান্ডের ড্যানিয়েল ভেট্টরি, ভারতের হরভজন সিং ও পাকিস্তানের সাকলাইন মুশতাকদের মত গ্রেটরা।
আমরা অনেক তরুণ ক্রিকেটারদেরই বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিগ থিং হিসেবে ধরে নিয়েছি। আশা করেছি, তাঁরা দেশের ক্রিকেটকে লম্বা সময় সার্ভিস দিবেন। লিটন দাস, সৌম্য সরকার, নাজমুল হোসেন শান্তদের ব্যাটিং ক্যালিবার নিয়ে কারো মনে কোনো প্রশ্ন নেই। আমরা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য তাঁরা দেশের ক্রিকেটের বড় সম্পদ। তবে ৪-৫ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার পর দলও নিশ্চয়ই আপনার কাছে কিছু আশা করবে। কিন্তু আমাদের তথাকথিত বিগ থিং রা কী সত্যিই সেই আশা পূরণ করতে পারছেন?
তবেঁ নিয়মিত পারফর্ম করা মিরাজকে আমরা কখনো ওভাবে দেখিনি। মিরাজ হয়তো কোনো স্পেশাল ট্যালেন্ট না। তাঁর অনেক লিমিটেশন আছে, অনেক জায়গায় এখনো কাজ করা বাকি। কিন্তু ব্যাটসম্যান মিরাজকে প্রমাণ করার সুযোগ ও আমরা দিই নিই কখনো।
মিরাজকে যদি দল বলে মিরাজ আজ থেকে তুমি জেন্যুইন অলরাউন্ডার। যাও ব্যাটিং, বোলিং দুটি দিয়েই দলকে জয় এনে দেও, তাহলে মিরাজ হয়তো তাই করবেন। কখনো পারবেন, কখনো বা পারবেন না। কিন্তু, পারার, নিজেকে উজাড় করে দেবার চেষ্টাটা দেখাাবেন। এটাই একজন সত্যিকারের টিম ম্যানের কাজ। বিগ থিঙ কেবল প্রতিভা দিয়েই হয় না, কখনো কখনো ডেডিকেশন দিয়েও হয়।