একালের অতিকায় মূর্তি

ক্যালিস যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন। তাঁর মনো:সংযোগ নষ্ট করতে কৌশল প্রয়োজন হত, স্লেজিং নয়। একবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট চলছে। ফাস্ট বোলার মাইকেল ক্যাস্প্রোউইজ থেকে শুরু করে ক্লোজ-ইন ফিল্ডাররা পর্যন্ত সবাই স্লেজিং শুরু করেন। কিন্তু, ক্যালিসের পক্ষ থেকে কোনোই মৌখিক জবাব আসছিল না। কোনোক্রমেই খ্যাপানো যাচ্ছিল না ক্যালিসকে। এক পর্যায়ে ক্যাস্পারই হতাশ হয়ে বলেন, ‘ইজ দিস ম্যান ডিফ?’

বাতাসে বাতাসে ফুলের সুবাসে,
তোমার সৌরভ ভাসে,
হৃদয় মাঝে নোঙর পেতে
থেকো তুমি সদা হেসে হেসে।

ক্রিকেট নিয়ে যখন আমরা কথা বলি তখন সবচেয়ে বেশি কথা হয়তো ব‍্যাটসম‍্যানদের নিয়েই হয়। অন‍্যদিকে বোলাররা বেশিরভাগ মানুষের পছন্দের হলেও তাদের নিয়ে আলোচনা খুব কমই দেখা যায়। তবে ব‍্যাটসম‍্যানদের থেকে একটু আলোচনা কম হলেও অনেকটাই গুরুত্ব পান অলরাউন্ডাররা। সত্যিই অলরাউন্ডাররা ক্রিকেটের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে ওঠেন সর্বদা, তা অতীতেও হয়েছে, বর্তমানেও হয়, ভবিষ্যতেও যে হবে – তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

আচ্ছা, অলরাউন্ডার বলতে কী বোঝায়? এই নিয়েও কিন্তু তর্ক-বিতর্ক কম হয়নি। সাধারণ ভাবে আমরা এটাই বুঝি যে অলরাউন্ডাররা এমন হন তাঁরা ব‍্যাটিং ও বোলিংয়ে এতোটাও দক্ষ হন যে, যেকোনো একটির ভূমিকাতেই দলে স্থান পেতে পারেন, আর অসাধারণ ফিল্ডার হলে তো সোনায় সোহাগা।

স্বর্ণযুগের দিকে তাকালে বিনু মানকড়, রিচি বেনো, অব্রে ফকনার, কিথ মিলার সহ আরও অনেকেই। সীমিত ওভারের ক্রিকেট আসবার পর রিচার্ড হ‍্যাডলি, ইয়ান বোথাম, কপিল দেব, ইমরান খান সহ আরও অনেকে প্রণস‍্য। কিন্তু বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার যে মহান কিংবদন্তি গ‍্যারি সোবার্স তা মেনে নিতে কারোর আপত্তি নেই।

এখন আবার সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ক্ষুদ্র সংস্করণ আসবার পর অনেকেই অলরাউন্ডার মর্যাদা ভুক্ত ক্রিকেটারদের অলরাউন্ডার আখ্যা দিতে চান না। তার মধ‍্যেও শন পোলক, অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ কিংবা হালের সাকিব আল হাসান বা বেন স্টোকস অবলীলায় যেকোনো যুগেই অসাধারণ অলরাউন্ডার হতে পারতেন তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু, একজন ক্রিকেটার যদি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৫ হাজারের বেশি রান ও ৬০০’র কাছাকাছি আন্তর্জাতিক উইকেট এর মালিক হন তখন তাঁকে যে বিশ্বের সর্বকালের অন‍্যতম সেরা অলরাউন্ডার বললেও অত্যুক্তি হবে না একথা সবাই নিশ্চয়ই বলবেন।

তিনি হলেন জ্যাক হেনরি ক্যালিস। ১৮-১৯ বছর ধরে আন্তর্জাতিক আঙিনায় নীরবে নিজের কাজ করেছেন সুচারুভাবে। না আকষর্ণীয় বা নিজের নজর কেড়ে নেওয়ার মত ব‍্যাক্তিত্ব তিনি কোনোদিন ছিলেন না এবং তা হওয়ার চেষ্টাও করেননি। কিন্তু, অভিষেকেই অস্ট্রেলিয়ার প্রবল স্লেজিং উপেক্ষা করেও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাননি, শতরান করেই ফিরেছিলেন। মান বাঁচানো সেই ইনিংসই জানিয়ে দিয়েছিল তার ধৈর্য্য, দৃঢ়তা, মানসিকতা।

কতদূর যাবেন সেটাও হয়তো বুঝতে পেরেছিল সবাই!

অলরাউন্ডার বলেই নানা সময়,নানা ক্ষেত্রে কিংবদন্তিদের সাথে তুলনা টানা হয়েছে। নিজের সময়ে দেশকে বড় প্রতিযোগিতায় দলকে সাফল্য দিতে না পারার জন‍্যও সমালোচনা শুনতে হয়েছে। কিন্তু, এই মানুষটাই দেশের একমাত্র আইসিসি ট্রফি জয়ের সেমিফাইনালে অসাধারণ সেঞ্চুরি ও ফাইনালে অসাধারণ ৫ উইকেট নিয়েছিলেন। নি:সন্দেহে, জ্যাক ক্যালিস দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা নায়ক।

অর্জন, পরিসংখ্যান? সে তো তথ্যখাতায় রয়ে যাবে। কিন্তু কেবল সংখ্যা দেখে কী শিল্পের বিচার চলে? দিনের শেষে অনেকেই আমরা ক্রিকেটকে নিছক একটা খেলা হিসেবে নয়, শিল্প, নৈপুণ্য, দক্ষতারও বিচার করি। আর সেসব ক্ষেত্রে তিনি নিজেকে সবসময় অনেক উপরে রেখেছেন, নিজের আন্তর্জাতিক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অনেকটা ক্যালিসের অসাধারণ চোখ জুড়ানো কভার ড্রাইভ গুলোর মতোই।

যারা ক্রিকেট ভালবাসে, তাঁরা গতির উদ্দামতা নয়, নীরবতার গভীরতা দেখে আনন্দ পায়। তাঁদের জন্য ক্যালিস সবসময় ‘না ভুলতে পারা সৌরভ’ ছড়িয়ে দিয়েছেন যাতে সব সময় মন ভরে সুবাস নেওয়া গিয়েছে। তিনি হলেন আধুনিক ক্রিকেটের অতিকায় মূর্তি, একালের ক্রিকেট সব্যসাচী।

ক্যালিস যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারতেন। তাঁর মনো:সংযোগ নষ্ট করতে কৌশল প্রয়োজন হত, স্লেজিং নয়। একবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট চলছে। ফাস্ট বোলার মাইকেল ক্যাস্প্রোউইজ থেকে শুরু করে ক্লোজ-ইন ফিল্ডাররা পর্যন্ত সবাই স্লেজিং শুরু করেন। কিন্তু, ক্যালিসের পক্ষ থেকে কোনোই মৌখিক জবাব আসছিল না। কোনোক্রমেই খ্যাপানো যাচ্ছিল না ক্যালিসকে। এক পর্যায়ে ক্যাস্পারই হতাশ হয়ে বলেন, ‘ইজ দিস ম্যান ডিফ?’

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...