মানসম্মত পেস বোলিং অলরাউন্ডার বাংলাদেশের ক্রিকেটে সোনার হরিণের মতই দুর্লভ। একটা সময় জিয়াউর রহমান, ফরহাদ রেজাদের উপর ভরসা রাখলেও তাঁরা পারেননি সেই ভরসার প্রতিদান দিতে। তাই পেস বোলিং অলরাউন্ডারের জন্য বাংলাদেশের হাহাকার বেশ পুরনো। আর এমন ঘাটতি মেটাতেই হয়তো বেড়ে উঠেছেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন।
বয়সভিত্তিক দলগুলোতে থাকাকালীন সময়ে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। বল হাতে পুরোদস্তুর ফাস্ট বোলার আর ব্যাটিংয়েও সাবলীল – দেশজুড়ে আলোচনায় উঠে আসতে খুব একটা দেরি হয় তাঁর। ২০১৬ সালে ঘরের মাঠে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দলের সেরা পারফর্মারদের একজন ছিলেন, পুরস্কার স্বরূপ পরের বছরেই সুযোগ পান জাতীয় দলে।
২০১৭ থেকে ২০২২ সাল, এই পাঁচ বছরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। অফ ফর্মের জন্য দল থেকে বাদও পড়েননি কখনো; নতুন বলে সুইং আর পুরনো বলে নিয়ন্ত্রিত লাইন লেন্থের পাশাপাশি ইয়োর্কার করতে পারার সক্ষমতা তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। এতকিছুর পরেও নিজের ক্যারিয়ারে মাত্র ৬১টি ম্যাচ খেলেছেন ফেনীর এই ক্রিকেটার। মূলত বারবার ইনজুরির কারণে দল থেকে ছিটকে পড়াই এত কম ম্যাচ খেলার জন্য দায়ী।
মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের জীবনে ইনজুরি নিত্যসঙ্গী। সর্বশেষ ২০২১ সালের বিশ্বকাপের মাঝপথে পিঠের ইনজুরিতে পড়েন তিনি। প্রায় এক বছর লেগে যায় ফিরে আসতে; চলতি বছরের এশিয়া কাপ দিয়ে আবারো লাল-সবুজের জার্সি গায়ে জড়ান এই অলরাউন্ডার। কিন্তু পুরনো সেই ক্ষুরধার সাইফের দেখা পাওয়া যায়নি। নিজের মূল কাজ পেস বোলিংয়ে বড্ড ছন্নছাড়া মনে হয় তাঁকে।
লম্বা বিরতি কাটিয়ে জাতীয় দলে ফেরার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিন ম্যাচ খেলেছেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। এই তিন ম্যাচে ব্যাটিং না পেলেও বোলিং করেছেন সবমিলিয়ে ৯ ওভার; কোন উইকেট না পেলেও খরচ করেছেন মোট ৯৩ রান, ইকোনমি ১০.৩৩! তুলনামূলক খর্বশক্তির দল আরব আমিরাতের বিপক্ষে সাত ওভার বোলিং করেছেন প্রায় সাড়ে নয় ইকোনমিতে।
পরিসংখ্যানেই ফুটে উঠেছে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের বিবর্ণতা, তবে সরাসরি খেলা দেখলে সেটি আরো ভালভাবে বোঝা যায়। আসলে পুরোদমে বোলিংটাই করতে পারছেন না তিনি; স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে হাফ-ফিট সাইফকে খেলাচ্ছে টিম ম্যানেজমেন্ট? উত্তর যাইহোক, তরুণ এই ক্রিকেটারের ছন্দহীন বোলিং আর ফিল্ডিংয়ের শ্রী দেখলে সবারই মনে হবে ম্যাচ খেলার জন্য যথেষ্ট ফিট নন তিনি।
সাবেক অধিনায়ক মাশরাফির চোখে ডেথ ওভারে সাইফউদ্দিন দেশের সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বোলার। কিন্তু এখন ঘটছে ঠিক বিপরীত ঘটনা, ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণী ওভারে সাইফউদ্দিন এখন নিজের দলের জন্যই এক আতঙ্ক। এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ১৮ তম ওভারে দিয়েছেন ২২ রান; আরব আমিরাতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে ১৬ এবং ১৯ তম ওভারে যথাক্রমে ১১ এবং ১০ রান খরচ করেছেন। এছাড়া পরের ম্যাচে প্রথম ওভারে মাত্র তিন রান দিলেও শেষ দুই ওভারে আবার দিয়েছেন ২৩ রান।
অন্যদিকে ব্যাট হাতে নিজেকে প্রমাণের খুব বেশি সুযোগ কখনোই পাননা সাইফউদ্দিন। কেননা লোয়ার মিডল অর্ডারে ব্যাট করে থাকেন তিনি সচারচর। চাপ সামলে ধুন্ধুমার ব্যাটিং খুব কম সময়ই উপহার দিতে পেরেছেন ডান-হাতি এই অলরাউন্ডার। নিজেকে ঠিকঠাক প্রস্তুত করতে পারছেন না সাইফউদ্দিন।
প্রথমবারের মত সরাসরি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপে একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডারের গুরুত্ব সবারই জানা আছে। ভারতের হার্দিক পান্ডিয়া, ইংল্যান্ডের বেন স্টোকস কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মার্কাস স্টোয়িনিস সবাই নিজ নিজ দলের এক্স-ফ্যাক্টর। অজি কন্ডিশনে একাই ম্যাচ জেতানোর সামর্থ্য আছে তাদের; অথচ বাংলাদেশের পেস বোলিং অলরাউন্ডার সাইফউদ্দিন এখনো ধুঁকছেন নিজের ফর্ম নিয়ে। বিশ্বকাপের মঞ্চে এমন ধুকতে থাকা একজন খেলোয়াড় নিশ্চয়ই দলের বোঝা বনে যেতে সময় লাগবে না এক মুহূর্ত।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যোগ দেয়ার আগে চারটি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ এবং দুইটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। এই সময়ের মাঝে সাইফউদ্দিন পুরনো ফর্মে ফিরতে পারলে লাভটা বাংলাদেশেরই হবে। তাসকিন আহমেদ, এবাদত হোসেনদের দেখাদেখি সাইফও হয়তো দারুভাবে প্রত্যাবর্তন করবেন – আপাতত তেমনটাই প্রত্যাশা দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের।