সিডনি, ২০০৮।
ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার টেস্ট সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে এক চরম অপমানজনক কান্ডের অভিযোগ তোলে অস্ট্রেলিয়া। অনেকেই মনে করেন, ক্রিকেটে যে ‘বর্ণবাদ’ এর বিস্তার, তার সূচনা হয়েছিল এই সিডনিতেই। ম্যাচ চলাকালীন হরভজন সিং অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসকে ‘মাঙ্কি’ (বানর) বলে ডাকেন বলে অভিযোগ করা হয়। অন্তত অস্ট্রেলিয়ানদের তো সেটাই অভিযোগ।
- কী হয়েছিল সেদিন?
এমসিজিতে প্রথম টেস্টে ভারত হেরেছিল বেশ বড় ব্যাবধানেই, অঙ্কের হিসেবে ৩৩৭ রানে। অনিল কুম্বলের দল তাই সিডনির মাঠে নেমেছিল বেশ বড় আশা নিয়েই। কিন্তু বড্ড আশার ম্যাচ শুরু থেকেই বড়সড় বিতর্কই দেখে আসছিল আর তার সূত্রপাত করেছিলেন আম্পায়ার স্টিভ বাকনর।
ম্যাচের শুরু থেকেই বাকনরের দেওয়া বেশ কিছু সিদ্ধান্ত বিতর্কিত মনে হচ্ছিল, যার সবকয়টাই গেছিল অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে – ভারতীয় সমর্থকরা অন্তত এরকম অভিযোগ করছিলেন।
৪৫/২ থাকার সময় রিকি পন্টিংকে উইকেটের পেছনে আউট না দেওয়া, ১৯১/৬ আর ৪২৩/৭ এর সময় এন্ড্রু সাইমন্ডসকে আউট না দেওয়া- বাকনরের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত চলছিল অস্ট্রেলিয়ার পুরো ইনিংসজুড়ে। আর তাতেই অস্ট্রেলিয়া গড়ে ফেলে পাহাড়সম রান- ৪৬৩! যেখানে বিতর্কিত এই সিদ্ধান্তগুলো না হলে অস্ট্রেলিয়াকে ভারত বেঁধে ফেলতে পারত একেবারে ৩০০’র নিচে!
ভারতীয় ক্রিকেটাররা এমনিতেই মেজাজ হারাচ্ছিলেন, সে যুগে তো আর রিভিউ ছিল না যে সিদ্ধান্ত মানতে না পারলে রিভিউ চেয়ে আবেদন করে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলবেন। ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরা তাই ব্যাট হাতেই সব জবাব দেওয়ার জন্যে তৈরি হয়ে নিচ্ছিলেন, বলা ভাল ব্যাট হাতেই জবাব দিচ্ছিলেন।
শচীন টেন্ডুলকার সেঞ্চুরি করলেন, ভিভিএস লক্ষণ সেঞ্চুরি করলেন, সৌরভ গাঙ্গুলি দুর্দান্ত এক হাফ-সেঞ্চুরি হাঁকালেন। ভারত প্রায় লিড নেওয়ার পথেই ছিল। ভারতের জন্যে সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল।
কিন্তু সেটা ততক্ষণ অব্দি, যতক্ষণ না ম্যাচের ১১৬ তম ওভার আসছে!
- ওভার নম্বর ১১৬
ভারতীয় ইনিংসের ১১৬ তম ওভার। পুরো ক্রিকেটবিশ্ব যেন হঠাৎ একটা বড়সড় ধাক্কা খেল। ক্রিকেট পাড়ায় জমে গেল আগামী অন্তত কয়েক মাসের চায়ের আড্ডার টক অব দ্য টপিক ।
ভারতের রান তখন ৪৫১/৭ । ভারতের হয়ে ক্রিজে ছিলেন হরভজন সিং। অস্ট্রেলিয়া ভারতের উইকেট নেওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে উঠছিল। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বল করা ব্রেট লি হরভজনের দিকে একের পর এক গোলা ছুঁড়ে যাচ্ছিলেন। হরভজনও কম যান না, সবকয়টা ডেলিভারিই সামলে নিচ্ছিলেন।
ব্রেট লি’র ওভারের শেষ বলটা খেলার পর উইকেটের অপর পাশে যাচ্ছিলেন হরভজন। মাঝে হঠাৎ দেখা গেল, এন্ড্রু সাইমন্ডসের সাথে হরভজন যেন কোন বাক্যবিনিময় করছেন। প্রথম দেখাতে অবশ্য সেরকম গুরুতর কিছু লাগছিল না, বরং বেশ স্বাভাবিক কথোপথনই মনে হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎই যেন পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠল। হরভজন আর সাইমন্ডসের মধ্যে উত্তাপ বাড়তে লাগল। মাঠে থাকা আম্পায়ার মার্ক বেনসনকেও এগিয়ে আসতে দেখা গেল। মনে হল, তিনি হরভজনকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিচ্ছেন! হরভজনও যেন বেনসনের কথা শুনে আরো ক্ষেপে উঠছেন!
কিন্তু হরভজন আসলে করেছেন টা কি?
হরভজন কি করেছেন জানতে সময় লাগল না। অস্ট্রেলিয়া দল সেটা নিয়ে আম্পায়ারের কাছে নালিশ করেছিল আর এরপর দেখা গেল, হরভজন একেবারে গুরুতর অপরাধ করে ফেলেছেন- রেসিজম! বাংলায় বললে হয়- বর্ণবাদী মন্তব্য।
অস্ট্রেলিয়া দলের ভাষ্যে হরভজন এন্ড্রু সাইমন্ডসের দিকে বর্ণবাদী মন্তব্য ছুঁড়ে দিয়েছিলেন, সাইমন্ডসকে ‘বানর’ ডেকেছিলেন!
মূল ঘটনায় ফিরে আসি। হরভজন আর সাইমন্ডসের উত্তাপ একটুও কমছিল না। আর তখন মাঠে থাকা রিকি পন্টিং আর ম্যাথ্যু হেইডেন এগিয়ে আসেন। হরভজন আর সাইমন্ডসকে সরিয়ে নেন। সেদিন এই ঘটনা ভারতীয় দলের আরেকজন সচক্ষে দেখেছিলেন। তিনি নন-স্ট্রাইক প্রান্তে থাকা ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকার!
- দলীয় প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনার পর দুই দলের প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্ন। মাঠে থাকা হরভজন আর শচীন টেন্ডুলকার দুজনই বলেন যে অস্ট্রেলিয়ানদের উদ্দেশ্যে নাকি কোনরকম বর্ণবাদী মন্তব্যই করা হয়নি। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানরা এটা মানতে একেবারেই নারাজ ছিল। গোটা দলই ভারতের বিপক্ষে প্রেস চার্জ আনতে তৈরি ছিল। পুরো টেস্ট ম্যাচে এই ঘটনা এমন কুৎসিত আকার ধারণ করে যে খেলাশেষে অস্ট্রেলিয়ানরা ভারতীয় খেলোয়াড়দের সাথে করমর্দন করতে অব্দি অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
পরে অবশ্য অ্যাডাম গিলক্রিস্ট বলেছেন, মাঠে করমর্দন না করলেও খেলোয়াড়েরা নাকি পরে ভারতের ড্রেসিং রুমে গিয়ে করমর্দন করে এসেছেন।
আইসিসির ভূমিকা কি ছিল সেই ঘটনায় – সেটা জেনে নেওয়া দরকার এবার।
- ম্যাচ রেফারি
ম্যাচ শেষে ম্যাচের রেফারি মাইক প্রোক্টার নিজের শুনানি জানিয়ে দেন। আইসিসির আচরণবিধির লেভেল-৩ ভাঙায় হরভজনকে তিনি তিন টেস্টের জন্যে নিষেধাজ্ঞা দেন। নিজের শুনানিতে তিনি বলেন, ‘এই সন্দেহে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে হরভজন সিং এন্ড্রু সাইমন্ডসের দিকে ঐ শব্দটা ছুঁড়ে দিয়েছিল যেটা কিনা সাইমন্ডসের জন্যে বর্ণবাদী মন্তব্যের সামিল।’
কিন্তু, ম্যাচ রেফারির এই রায় ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট একদমই মানতে পারেনা। তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা ভাবতে থাকে আর আপিলের আগেই এই রায় উঠিয়ে নেওয়ার জন্যে সফর বাতিলের হুমকি অব্দি দিতে থাকে।
‘মাঙ্কিগেট স্ক্যান্ডাল’ এর ঘটনা এখানেই থেমে গেল না। এই ঘটনা শেষ অব্দি গিয়ে পৌছল অ্যাডিলেডের ফেডারাল কোর্ট বিল্ডিংয়ে। সেখানে সাইমন্ডসের হয়ে সাক্ষ্য দিতে আসেন রিকি পন্টিং, ম্যাথ্যু হেইডেন আর মাইকেল ক্লার্ক। আর হরভজনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন শচীন টেন্ডুলকার। মাঠে ভারতীয় দলের আর কেউ না থাকায় শচীনই ছিলেন হরভজনের একমাত্র সাক্ষী।
- ফেডারাল কোর্টের রায়
ফেডারাল কোর্টের রায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। আইসিসির আপিল কমিশনার জাস্টিন জন হ্যানসেন রায় দেন এটা বলে যে তিনি সাইমন্ডসকে বর্ণবাদী মন্তব্য করার অভিযোগে হরভজনকে ‘দোষী’ হিসেবে খুঁজে পাননি। এরপর তিনি আগের রায়ে দেওয়া তিন টেস্টের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেন আর এর পরিবর্তে হরভজনকে ম্যাচ ফি’র ৫০ শতাংশ জরিমানা করেন।
- সত্যি-মিথ্যে
এই ঘটনার সত্যি-মিথ্যে নিয়ে দুই রকম মন্তব্যই পাওয়া যায়। অ্যাডিলেডের ফেডারাল কোর্ট কেস ডিসমিস করে দিলেও অস্ট্রেলিয়ানরা রায়ের পরই ক্ষোভ জানাতে থাকে, বারবারই দাবি করতে থাকে হরভজন সাইমন্ডসকে বর্ণবাদী মন্তব্য করেছিলেন। পক্ষান্তরে ভারতীয় দলও বারংবার দাবি করতে থাকে হরভজন এরকম কিছুই করেননি। আসলে সেদিন কি হয়েছিল এটা তাই এখন পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে পরিষ্কার নয়।
তবে পরিষ্কারর না হলে কি হবে, বিদ্বেষের বাষ্প বেশ অনেক দূর পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। অনেকদিনই দুই দলের মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে রেষারেষি চলতে থাকে।
এ ঘটনার জন্যে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট তো তাঁর আত্মজীবনী ‘ট্রু কালার্স:মাই লাইফ’ বইয়ে শচীন টেন্ডুলকারকে ‘চরম মিথ্যাবাদী’ও বলেছেন।
- আইপিএল
পুরো ঘটনা শান্ত করতে সবচাইতে বড় ভূমিকা রেখেছিল ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। আইপিএলে যখন হরভজন আর সাইমন্ডস একই ফ্রাঞ্চাইজি মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে খেলার সুযোগ পান তখন পরিস্থিতি এমনিতেই শান্ত হয়ে পড়েল। তবে সাইমন্ডস বারাবারই বলেছেন এই ঘটনা তাকে চরমভাবে প্রভাবিত করেছিল, আর তিনি হরভজনকে ক্ষমা করতে পারেননি! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পেরেছিলেন কি না জানা নেই।
যদিও, হরভজন হয়তো সব ভুলেই গেছেন। সাইমন্ডসের মৃত্যুর পর টুইট করেন, ‘অ্যান্ড্রু সাইমন্ডসের অকাল মৃত্যুর খবরে আমি হতবাক। বড় তাড়াতাড়ি চলে গেল। ওর প্রিয়জন আর পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা রইল। সাইমন্ডসের আত্মার শান্তি কামনা করি।’