লাল বলের ঘূর্ণি জাদুকর

অস্ট্রলিয়া ও ইংল্যান্ড একবাক্যে টেস্ট ক্রিকেটের পরাশক্তি। এই দুই দলকে ক্রিকেটের বনেদি ফরম্যাটে হারানোর স্মৃতি নিশ্চয়ই মলিন হয়ে যায়নি। ঘরের মাঠে তাঁদেরকে হারানোর কারিগর ছিল বাংলাদেশের স্পিনাররা। শুধু যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেই দুই ঐতিহাসিক ম্যাচ জয়ে ছিল স্পিনারদের অবদান তা কিন্তু নয়। বিশ্বের প্রায় প্রতিটা টেস্ট খেলুড়ে দলের স্পিনারদের টেস্টে জয়ের পেছনে বরাবরই থাকে দারুণ অবদান। স্পিন সহায়ক পিচ হোক কিংবা না হোক, প্রয়োজনে স্পিনাররা যেমন ব্যাটারের উপর চাপ প্রয়োগ করেছেন ঠিক তেমনি ব্রেকথ্রুও এনে দিয়েছেন দলকে বহুবার।

তবে স্পিনারদের স্বর্গ যে এই উপমহাদেশ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই উপমহাদেশ বিশ্ব ক্রিকেটকে উপহার দিয়েছে অসাধারণ সব স্পিনার। তাছাড়া উপমহাদেশের বাইরের স্পিনাররাও কন্ডিশনের সুবিধা নিয়ে নিজেদের রেকর্ড ও স্কিল সমৃদ্ধ করেছেন। নিজেদের ঘরের মাঠেও সেই স্কিল কাজে লাগিয়ে হয়েছেন বিশ্বসেরা। কোন অংশে কম যান না। টেস্ট ক্রিকেটে স্পিনারদের উইকেট শিকারের গল্প হবে আজ।

  • নাথান লিঁও (অস্ট্রেলিয়া)

অ্যাশেজের মতো একটা মঞ্চে নিজের ক্যারিয়ারের ৪০০ তম উইকেট পাওয়ার আনন্দটা ঠিক কতটুকু তা হয়ত কেবল নাথান লিঁওই বলতে পারেন। কেননা এমন কীর্তি তিনি গড়ে দেখিয়েছেন চলতি অ্যাশেজের প্রথম টেস্ট। প্রথম ইনিংসে উইকেট শূন্য ছিলেন অস্ট্রেলিয়ান এই অফ-স্পিনার। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসের চার উইকেট শিকার করে পৌঁছে যান ৪০০ উইকেটের এলিট ক্লাবে।

নাথান লিঁওর এখন টেস্ট উইকেট সংখ্যা ৪০৩। ১০১ টেস্ট ম্যাচ খেলে প্রায় ৩২ গড়ে তিনি পার করলেন ৪০০ উইকেটের কোটা। এই পদযাত্রায় তিনি ১৮ বার এক ইনিংসে পাঁচ কিংবা তাঁর বেশি উইকেট নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি টেস্টে উইকেট সংখ্যা বিবেচনায় স্পিনারদের তালিকায় রয়েছেন সপ্তম স্থানে। তাছাড়া টেস্টে উইকেট শিকারিদের তালিকার সপ্তাদশ স্থানে অবস্থান করছেন নাথান।

  • হরভজন সিং (ভারত)

ভারতের অভিজ্ঞ স্পিনার হরভজন সিং ছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা স্পিন বোলার। তাঁর প্রাইম টাইমে তিনি ছিলেন দারুণ ভয়ংকর একজন বোলার। যিনি কিনা একাই ধসিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ধারণ করতেন নিজের মাঝে। তাছাড়া হরভজন সিং এবং অনিল কুম্বলের বোলিং জুঁটি যেন ছিল প্রতিপক্ষের ত্রাস। বিশেষ করে লাল বলের ক্রিকেটে। ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ৩২ উইকেট নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন হরভজন।

টেস্ট ক্রিকেটে সর্বাধিক উইকেট শিকারি স্পিনারদের তালিকায় হরভজন সিং রয়েছেন ষষ্ঠ স্থানে। তিনি তাঁর ক্যারিয়ারের টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন ১০৩টি। টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি টানবার আগমুহূর্ত অবধি তাঁর উইকেট সংখ্যা ছিল ৪১৭টি। ৩২.৪৬ গড়ে তিনি উইকেট শিকার করে নিজেকে স্পিনারদের উইকেট শিকারের তালিকায় উপরের দিকেই রেখেছেন।

  • রবিচন্দ্রন অশ্বিন (ভারত)

২০২১ সালে সর্বাধিক উইকেট শিকারি বোলার ভারতের ডান-হাতি অফ স্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন। এই বছরের আট টেস্টে তাঁর উইকেট সংখ্যা ৫২টি। মাত্র ১৬.২৩ গড়ে এত উইকেট নেওয়া অশ্বিন নিসঃন্দেহে বর্তমান সময়ের সেরা বোলারদের একজন। এই বছরে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা ঘরের মাঠের টেস্ট সিরিজে তিনিই ছিলেন সর্বাধিক উইকেট শিকারি।

এখন পর্যন্ত অশ্বিন তাঁর ক্যারিয়ারে টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন ৮১টি। এই ৮১ টেস্টেই তিনি বর্তমানে অবস্থান করছেন সর্বাধিক উইকেট শিকারি স্পিনারদের তালিকার পঞ্চম স্থানে। ক্যারিয়ারের গোধূলি লগ্নে তিনি যে আরো উপরে আরোহণ করবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে ভারতের এই অফ স্পিনারের উইকেট সংখ্যা ৪২৭টি। গড় ২৪.১২। আসন্ন দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে এই ট্যালিতে আরো উইকেট নিশ্চয়ই যোগ হতে চলেছে।

  • রঙ্গনা হেরাথ (শ্রীলঙ্কা)

বাংলাদেশে দলে বর্তমান স্পিন বোলিং কোচ রঙ্গনা হেরাথ রয়েছেন টেস্টে সর্বাধিক উইকেট শিকারি স্পিন বোলারদের এলিট তালিকার চতুর্থ স্থানে। হেরাথ ক্রিকেট ইতিহসের অন্যতম সেরা স্পিনারদের একজন। এ বিষয়ের দ্বিধার কারণ খুব একটা নেই। তবে দুঃখজনক বিষয় শ্রীলঙ্কা তো বটেই বিশ্ব ক্রিকেটের কিংবদন্তি স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরনের সমসাময়িক হওয়া তিনি ততটা মেলে ধরতে পারেননি নিজেকে।

একমাত্র বাঁ-হাতি স্পিন বোলার হিসেবে তিনি পার করেছেন ৪০০ টেস্ট উইকেটের কোটা এবং নিজের নামটি লিখিয়েছেন এলিট বোলারদের তালিকায়। নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের  রঙ্গনা হেরাথ টেস্ট খেলেছেন সর্বোমোট ৯৩টি। ৩৪ বার পাঁচ কিংবা তাঁর বেশি উইকেট নিয়েছেন তিনি এক ইনিংসে। তাছাড়া ২০ বার ইনিংসে চার উইকেট করে নিয়েছেন তিনি। সব মিলিয়ে প্রায় ২৮ গড়ে তাঁর উইকেট সংখ্যা ৪৩৩টি।

  • অনিল কুম্বলে (ভারত)

টেস্টের এক ইনিংসে দশ উইকেট নেওয়া তিন বোলারের একজন ভারতের কিংবদন্তি অনিল কুম্বলে। ভারতের ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা এবং সফল বোলার কুম্বলে বহুবার দলকে একাই জয়ের বন্দরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। বলের উপর তাঁর ছিলে অবিশ্বাস্য রকমের দখল। বল খুব বেশি ঘূর্ণির সৃষ্টি না করলেও তা খেলতে রীতিমত নাকানিচুবানি খেতে হয়েছিল তাঁর সময়কার ব্যাটারদের।

অনিল কুম্বলের সেরা টেস্ট ম্যাচের বোলিং ফিগার ১৪/১৪৯। কুম্বলে তাঁর ক্যারিয়ারের ১৩২ ম্যাচের মধ্যে ৩৫টি ইনিংসে নিয়েছিলেন ফাইফার। মাত্র ২৬.৬৫ গড়ে উইকেট শিকারে তিনি ছিলেন পারদর্শী। দলের প্রয়োজনে ব্রেকথ্রু কিংবা প্রতিপক্ষের ইনিংস গুড়িয়ে দিতে কুম্বলে ছিলেন বেশ পটু। তাইতো টেস্ট ক্যারিয়ারের ৬১৯ উইকেট নিয়ে তিনি রয়েছেন আজকের এলিট তালিকার তৃতীয় স্থানে।

  • শেন ওয়ার্ন (অস্ট্রেলিয়া)

শতাব্দীর সেরা বলের কথা মনে আছে? ইংলিশ ব্যাটার মাইক গ্যাটিংয়ের বিপক্ষে করা অস্ট্রেলিয়ান লেগ-স্পিনার শেন ওয়ার্নের লেগ স্ট্যাম্পের বাইরে পড়া বল টার্ন করে অফ স্ট্যাম্প আঘাত হানা বলের কথা। এতটুকুতেই বোধহয় শেন ওয়ার্নকে সকল বিশেষণে বেঁধে ফেলা যায়। বাউন্সি উইকেটেও ব্যাটারকে স্পিনে কি করে কাবু করতে হয় তা বোধহয় ওয়ার্নের থেকে ভাল আর কারো জানা নেই। ক্রিকেটের কিংবদন্তি ওয়ার্ন মূর্তিমান এক আতংকের নাম ছিল ব্যাটারদের জন্য।

ওয়ার্ন ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তাঁর ক্যারিয়ারে তিনি ৩৭ বার প্রতিপক্ষে পাঁচ কিংবা তাঁর বেশি উইকেট নিয়েছিলেন এক ইনিংসে। আর দশ ম্যাচে দশের অধিক উইকেট নেওয়ার কীর্তিও গড়েছেন ওয়ার্ন। তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারে ওয়ার্ন ম্যাচ খেলেছেন ১৪৫টি। তাতে তাঁর উইকেট সংখ্যা ৭০৮। গড় ছিল ২৫.৪১। তাঁর সমসাময়িক উপমাদেশীয় প্রতিপক্ষকের প্রায় শতক পরিমাণ উইকেটে পিছিয়ে ওয়ার্ন অবস্থান করছেন টেস্টে সর্বাধিক উইকেট শিকারি স্পিন বোলারদের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে।

  • মুত্তিয়া মুরালিধরন (শ্রীলঙ্কা)

স্পিন জাদুকর হিসেবে যদি আখ্যায়িত করা হয় মুত্তিয়া মুরালিধরনকে তাতে বোধহয় আপত্তি করবার যুক্তিযুক্ত কোন কারণ নেই। তাঁর সময়ে তিনি ছিলেন লঙ্কান বোলিং আক্রমণের সবচেয়ে বিধ্বংসী অস্ত্র। ভেরিয়েশনের পসরা সাজিয়ে তিনি বারংবার মুগ্ধ করেছেন বিশ্ব ক্রিকেটকে। তাঁর সামনে দাঁড়ানোটাই যেন ছিল ব্যাটারদের এক দুঃস্বপ্ন। টেস্ট ক্রিকেটের পাশপাশি ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরাদের একজন মুত্তিয়া মুরালিধরন।

তিনি তাঁর ১৩৩ ম্যাচের টেস্ট ক্যারিয়ারে নিয়েছেন ৮০০ উইকেট। স্পিনারদের মধ্যে একমাত্র মুরালিধরন নিজের নামটি লিখিয়েছেন ৮০০ উইকেটের এলিট তালিকায়। ২২.৭১ গড়ে তিনি ঘরে-বাইরে প্রায় সমানতালেই উইকেট শিকারে ছিলেন পারদর্শী। ৪৯৩টি উইকেট নিয়েছেন তিনি ঘরের মাটিতে। অন্যদিকে, ভিনদেশে নেওয়া এই কিংবদন্তির উইকেট সংখ্যা ৩০৭। নিজের ক্যারিয়ারে ৬৭ বার ইনিংসে ফাইফার নেওয়ার বিপরীতে ম্যাচে দশ উইকেট বার তাঁর বেশি নিয়েছেন ২২ বার। মুরালিধরনই আজকের তালিকার শীর্ষে স্থানে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অদূর ভবিষ্যতে তাঁকে এখান থেকে হটিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link