নজরে নজর

বাপ-বেটার একই পেশায় নিয়োজিত থাকার নজির অসম্ভব কিছুনা। পারিবারিক ব্যবসা হলে তো আর কথাই নেই! প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে পালাবদল হতে থাকে মালিকানা। ব্যাতিক্রম কেবল ক্রীড়াক্ষেত্রে। বাপ-বেটা একই খেলায় খেলোয়াড়ি জীবনে যাপিত করা অনেকখানি দূরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

ক্রিকেটীয় বাস্তবতায় একজন কে খেলোয়াড় হতে পাড়ি দিতে হয় বন্ধুর পথ। বাবার খেলোয়াড়ি জীবনের প্রেম দেখে বন্ধুর পথ সহজেই উতরে গেছেন মুদাসসর নজর। বাবা নজর মোহাম্মদের পর তিনিও পাকিস্তান ক্রিকেটের নিয়মিত সদস্য হয়ে যান ১৯৭৬ সালে। দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন একটানা ১৩ বছর।

ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণ টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে যাত্রা শুরু হয় মুদাসসরের। পাকিস্তান ক্রিকেটের ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতেও বেশি সময় পার করতে হয়নি তাকে। নিজের ব্যাটিং দক্ষতায় মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন ক্রিকেট দুনিয়ায়।

মুদাসসর নজর  ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই নজর কেড়েছেন সবার। তৎকালীন ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন শির উঁচু করে। ব্যাট হাতে রেখেছেন দারুণ ভূমিকা। প্রতিপক্ষের দূর্গে ছিলেন ত্রাসের নাম। লাল ও সাদা উভয় বলের ক্রিকেটেই ছিলেন সমান পারদর্শি।

পাকিস্তান জার্সিতে সর্বপ্রথম খেলতে নামেন ১৯৭৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে। পাকিস্তানের টেস্ট ইতিহাসের ৭৬ তম ক্যাপ তার দখলে। এই ক্যাপের মর্ম বুঝে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টেই ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তুলে নেন শতক। আগমনী বার্তায় নিজের যোগ্যতার সুস্পষ্ট ছাপ রেখে দেন।

দলীয় ব্যবস্থাপকদের কখনোই তাকে নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হয়নি। নিজের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতেন এই ব্যাটসম্যান। সময়ের ব্যবধানে নিজেকে বাইশ গজে বেশ পরিপক্বও প্রমাণ করেছেন। বাবার মত ক্যারিয়ারের পঞ্চম টেস্টে ১৯৮২-৮৩ তে ভারত সফরে ওপেনিংয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সে সিরিজে হায়দ্রাবাদে ভারতের বিপক্ষে তৃতীয় উইকেটে জাভেদ মিঁয়াদাদের সঙ্গে ৪৫১ রানের রেকর্ড জুটি গড়েন।

পাশাপাশি টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সময়ের হিসাবে সবচেয়ে ধীরগতির শতকের রেকর্ডও রয়েছে তার নামের পাশে। ৫৫৭ মিনিট মাঠে অবস্থান করে তিনি শতক আদায় করেন। টেস্ট ক্রিকেটে মাটি কামড়ে মাঠে পড়ে থাকার সর্বোচ্চ সুযোগ কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি সেই শতকে।

পাকিস্তানের ব্যাটিংয়ের প্রাণ ভ্রমরা হতেও বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়নি। তখনকার ক্রিকেটের বাঘা বাঘা ফাস্ট বোলারদের শাসন করেছেন সাবলিলভাবেই। বোলার হিসেবেও ছিলেন কার্যকরি। প্রতিপক্ষের বড় রানে জুটি ভাঙতে অধিনায়কের আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন বহুবার। বল হাতে দুই ফরম্যাট মিলিয়ে শিকার করেছেন ১৭৭ উইকেট।

১৯৮০ সালের মাঝামাঝি তে পাকিস্তান ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম মুখপাত্রের দায়িত্ব পান। পিসিবির কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বিপাকে পড়তে হয় তাঁকে। এক পর্যায়ে তার নাম দল থেকে বাতিলের খাতায় চলে যায়। ১৯৮৯ সালে পাকিস্তান দল থেকে অবসর নিলেও, ঘরোয়া ক্রিকেটে বিচরণ করেছেন ১৯৯৩ পর্যন্ত। সেখানেও তার ব্যাটে ছিলো রানের ফোয়ারা আর ঝুলিতে রয়েছে অসংখ্য উইকেট।

দুই ফরম্যাট মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে রান করেছেন ৬৭৬৭। টেস্টে ব্যাটিং গড় ছিলো ৩৮ এবং ওডিআই তে ২৫। ওয়ানডেতে শতকের দেখা না পেলেও টেস্টে শতক হাঁকিয়েছেন সর্বমোট দশটি, সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছিলো তার অপরাজিত ২৩১ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে। পরিসংখ্যান-ই তাঁর নৈপুণ্যের প্রমাণ দেয়।

আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষে বাংলাদেশ ও কেনিয়া দলের কোচের ভূমিকা পালন করেন। তাঁর কোচিংয়েই ১৯৯০ সালের আইসিসি ট্রফি খেলে বাংলাদেশ দল। ১৯৮২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে ম্যাচ উইনিং বোলিং স্পেলের সম্মাননা স্বরূপ ‘গোল্ডেন আর্ম’ খেতাব জেতেন তিনি।

পাকিস্তান ছাড়াও ক্রিকেট বিশ্বের অন্যান্য দেশে ঘরোয়া আসরে দাপটের সহকারে খেলেছেন। বর্তমানে ইংল্যান্ডের বল্টনে অবস্থান করেন তিনি। পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল) মৌসুমে লাহোর কালান্দার্সের পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। আন্তর্জাতিক ময়দানে কৃতিত্বের সাথে বিচরণ শেষ করলেও, ক্রিকেট থেকে অবসরে যাননি। ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট কাজে নিজেকে জড়িত রেখেছেন ৬৫ ছুঁইছুঁই বয়সেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link