‘ছেলেটা তো দেখছি ফ্রন্টফুট, ব্যাকফুট- দুই ভাবেই দারুণ খেলে।’
কথাটা অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি ক্রিকেটার অ্যালান বোর্ডারের। নাগপুর টেস্টে সেবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ভারতের একাদশে নিয়মিত ওপেনার গৌতম গম্ভীর নেই। আগের ম্যাচে শেন ওয়াটসনকে ধাক্কা দেওয়ার অপরাধে এক ম্যাচ নিষিদ্ধ হলেন তিনি।
তাঁর জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হয়ে দলে ঢুকলেন তামিলনাডু থেকে উঠে আসা ব্যাটার মুরালি বিজয়। নিজের অভিষেক ইনিংসে তেমন আহামরি কিছু করে দেখাতে পারলেন না। ৫৩ বল খেলে সাদামাটা ৩৩ রানের ইনিংস। কিন্তু যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন ততক্ষণে কমেন্ট্রি বক্স থেকে ভেসে আসছিল প্রশংসার সুর।
চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না মুরালি বিজয়ের ব্যাটিং থেকে। অভিষেক ম্যাচেই বল রিড করার এমন ক্ষমতা দেখে মুরালির ব্যাটিংয়ে বেশ মুগ্ধ হলেন অ্যালান বোর্ডার। ফ্রন্টফুট, ব্যাকফুটে তাঁর পায়ের কারুকার্য দেখে প্রশংসা করলেন। ভারতের টেস্ট ক্রিকেটে ভবিষ্যৎ তারকা হতে যাচ্ছেন, মুরালি বিজয়কে নিয়ে এমন ভবিষ্যদ্বাণীও করে ফেললেন তিনি।
না। অ্যালান বোর্ডারের সেই ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক হয়নি। গড়পড়তা এক পরিসংখ্যানেই শেষ হয়েছে মুরালি বিজয়ের ক্যারিয়ার। তবে ভারতের হয়ে যতটা সুযোগ পেয়েছেন তাতে একদম নিংড়ে দিয়েছেন তিনি। ব্যাটের পাশাপাশি ফিল্ডিং দিয়ে রেখেছেন অবদান। তারপরও নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে দিনশেষে কিছুটা আক্ষেপ তো আছেই বটে। প্রতিভার কতটুকু তিনি দিতে পেরেছেন, নিজের সক্ষমতা অনুযায়ী কতটুকু পারফর্ম করতে পেরেছেন- তা নিয়ে রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন।
ক্রিকেটারদের বেড়ে ওঠার কতশত গল্প রয়েছে। মুরালি বিজয়েরও তেমন একটা গল্প আছে। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেট মুরালি বিজয়ের কাছে নেশার এক বিষয়। সব কিছুর ঊর্ধ্বে ক্রিকেট। বাবা মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে পাড়ার ক্রিকেট মাঠে ছুটে চলা ছিল নিত্যদিনের দৃশ্য।
তাতে পড়াশোনাও শিকেয় উঠেছিল। বোর্ড পরীক্ষা এগিয়ে এল। কিন্তু মুরালি বিজয় পরীক্ষার সিলেবাসটাই জানেন না। কী আর করা। মুরালি বিজয় করে বসলেন অদ্ভুত এক কাণ্ড। বাড়ি থেকে পালিয়ে গেলেন।
অবশ্য একটা সময় পর বোর্ড পরীক্ষা ঠিকই দিয়েছিলেন মুরালি বিজয়। তাতে পাশও করেছিলেন। আর সেটাই ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছিল। মুরালি বিজয় কলেজে ভর্তি হলেন। ব্যাট প্যাড আর ক্রিকেট বলের সাথে প্রথম পরিচয় হল।
আগে যা খেলেছেন সবটাই পাড়ার ক্রিকেট। কিন্তু কলেজে এসে পেলেন ক্রিকেটের প্রকৃত স্বাদ। বড্ড দেরিতে শুরু। তারপরও কলেজ ক্রিকেট খেলার সময় ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার ভরত অরূণের চোখে পড়লেন তিনি। আর তাতেই বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পেয়ে যান মুরালি। এরপর তামিলনাডুর হয়ে রঞ্জি ট্রফি। সব কিছুই ঘটলো দ্রুত।
লাইমলাইটে আসতে সময় নিলেন না। মুরালি বিজয়ের উত্থান পর্ব এগোচ্ছিল এক বিদ্যুৎ গতিতে। রঞ্জির এক ম্যাচে অভিনব মুকুন্দকে নিয়ে ৪৬২ রানে এক জুটি গড়ে সবার নজরে এলেন। আর তার কয়েক মাস পরেই সরাসরি জাতীয় দলে সুযোগ পান তিনি। দলে আসলেন ব্যাক আপ ওপেনার হিসেবে। তবে ক্যারিয়ারের শুরুর কয়েক বছরে একাদশে ঠিক সুযোগই মিলছিল না তাঁর। ক্যারিয়ারের প্রথম তিন বছরে খেললেন মাত্র ৩ টি টেস্ট।
তবে ২০১০ সাল থেকে কপাল খুলতে শুরু করে মুরালি বিজয়ের। লাল বলের ক্রিকেটে ভারতের হয়ে নিয়মিত সুযোগ মিলতে শুরু করল। মুরালি বিজয়ও সুযোগ কাজে লাগালেন। ধারাবাহিকভাবে রান করতে শুরু করলেন। বড় ইনিংস খেলাও শুরু করলেন। একটা সময় পর আকাঙ্ক্ষিত সেঞ্চুরির দেখাও পেলেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হওয়া মুরালির ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি আসলো সেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই। চেন্নাইয়ের সে টেস্টে তিনি খেললেন ১৩৯ রানের দুর্দান্ত একটি ইনিংস।
ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটাও সেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। তবে সেঞ্চুরিটা পেলেন প্রায় ৩ বছর পর, ২০১৩ সালে। এবারের ইনিংসটি ১৬৭ রানের। যা তাঁর ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস।
মুরালি বিজয়ের ব্যাটিং দ্যুতি সেখান থেকেই শুরু। ২০১৩ সালে প্রায় ৫০ গড়ে করলেন ৬৪৭ রান। পরের বছরেও রইল ধারাবাহিকতা। ২ সেঞ্চুরি আর ৫ হাফসেঞ্চুরিতে করলেন ৮৫২ রান। এর পরের বছর গুলোতে মুরালি বিজয় রইলেন ঠিকঠাক। ভারতের টেস্ট দলে ততদিনে তাঁর অবস্থান বেশ শক্তপোক্ত।
দারুণ ধারাবাহিকতায় ২০১৭ সালে আইসিসি’র সেরা টেস্ট ব্যাটারের র্যাংকিংয়েও উঠে আসলেন মুরালি বিজয়। সে বছরে খেলা ১০ ইনিংসের তিনটিতেই শতক হাঁকালেন তিনি। কিন্তু এরপরই হঠাৎ ছন্দপতন। ২০১৮ তে এসে খেই হারিয়ে ফেললেন।
ম্যাচের পর ম্যাচ টানা ব্যর্থতায় নিজেকে হারিয়ে খুঁজতে শুরু করলেন মুরালি। সে বছর একটা সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন বটে। কিন্তু সেঞ্চুরি ব্যতীত বাকি ১৪ ইনিংসে ফিরেছেন প্রায় শূন্য হাতেই। আগের বছরে যেখানে তিনি ৫২ গড়ে ব্যাটিং করেছিলেন সেখানে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ১৮ গড়ে শেষ হয় ২০১৮ সাল।
মুরালি বিজয়ের শেষের শুরু হয় সে বছর থেকেই। দল থেকে বাদ পড়লেন। তবে দলে ফেরার চেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। কিন্তু কোনোভাবেই আর ফেরা হল না তাঁর। অঘোষিত ভাবে শেষ হয়ে যায় মুরালি বিজয়ের ৬১ টেস্টের ক্যারিয়ার।
ভারতের রঙিন জার্সিতে তেমন একটা সুযোগ পাননি মুরালি বিজয়। ভারতের হয়ে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে খেলেছেন মাত্র ২৬ টা ম্যাচ। তবে মজার ব্যাপার হল, মুরালি বিজয় এই সীমিত ওভারের ক্রিকেটেই সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার ছিলেন।
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) চেন্নাই সুপার কিংসের ব্যাটিং লাইন আপের অন্যতম ভরসার নাম ছিল মুরালি। ২০১১ আইপিএলের ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন তিনি। এছাড়া, আইপিএলের দ্বিতীয় আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ব্যাটার ছিলেন মুরালি। চেন্নাইয়ের হয়ে আইপিএল ক্যারিয়ারে তাঁর দুটি সেঞ্চুরিও আছে।
ক্যারিয়ার নিয়ে আক্ষেপ অবধারিতভাবেই আছে। তবে মুরালি বিজয়ের বিগত বছর গুলো কেটেছে বেশ হতাশায় আর অভিমানে। ২০২০ এর পর আর আইপিএলের খেলার সুযোগ পেলেন না। সেটা না হোক, অন্তত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিলেন তিনি। কিন্তু জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর ঘরোয়া ক্রিকেটেও তাঁর জন্য দুয়ার বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৯ সালে লিস্ট এ আর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট- দুই ক্রিকেটেই সর্বশেষ ম্যাচ খেলার সুযোগ পান তিনি। শেষ দুই, তিন বছর রীতিমত বসে কাটিয়েছেন তিনি। নিজের প্রিয় অঙ্গন ক্রিকেট, অথচ সেখানে বিচরণ ঘটানোরই সুযোগ পাচ্ছেন না। তাই এক প্রকার হতাশা আর অভিমানে ২০২৩ সালে এসে ভারতের ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন মুরালি বিজয়।
বিসিসিআই-এর অধীনে থাকা ক্রিকেটারদের বাইরের দেশে খেলার ক্ষেত্রে অনাপত্তি পত্র দেওয়া হয় না। মুরালি সেই বলয় থেকেই বেরিয়ে আসতে চাইলেন। নিজেকে আবারো মেলে ধরতে চাইলেন বাইশ গজের ক্রিকেটে। তাই ভারতের সাথে ক্রিকেটের সব সম্পর্ক ছিন্ন করে বিদায় বলে দিলেন তিনি।
ভারতের হয়ে টেস্ট ক্যারিয়ারে ১২ টা সেঞ্চুরিতে ৩৯৮২ রান। সব ফরম্যাট মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪৪৯০ রান। গড়পড়তা, সাদামাটা এক ক্যারিয়ার। এমন পরিসংখ্যানে স্বয়ং মুরালি বিজয়ই বোধহয় তুষ্ট নন। তুষ্ট হবেনই বা কিভাবে?
যে গতিতে তিনি এগোচ্ছিলেন সেই গতি রোধ হয়েছে অনেকটা আকস্মিকভাবেই। এমন হঠাৎ বেয়ে আসা ঝড়টা শেষ দিকে সামলাতে পারলেন না। তাই নিজেই একটা সময় পর হাল ছেড়ে দিলেন। ভারতের ক্রিকেটে মুরালি বিজয় হয়ে গেলেন একরাশ আক্ষেপের এক নাম।