প্রথম দিনটা দুই উইকেটে ২৫৬ রান নিয়ে শেষ করে শ্রীলঙ্কা। দ্বিতীয় দিন পুরোটাই বৃষ্টির দখলে। তৃতীয় দিনে ৫২০ রানের বিশাল সংগ্রহে ইনিংস ঘোষণা করেন লংকান দলপতি কুমার সাঙ্গাকারা। এসব তো তখন কেবলই আনুষ্ঠানিকতা! সবাই অপেক্ষার ডালপালা মেলে বসে আছে, কখন জাদুকরী স্পর্শে ৮০০ উইকেট থেকে ‘৮ উইকেটের’ দূরত্ব গুছাবেন মুত্তিয়া মুরালিধরন?
এই টেস্ট দিয়েই সতেরো বছর দশ মাসের বন্ধন ছিন্ন করবেন বলে আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন তিনি। তাইতো অপেক্ষার প্রহর এমন তীব্রতা ধারণ করেছিল।
গল্পটা আট উইকেটের। মিডল স্ট্যাপে ফুলার লেংথ ডেলিভারি। সুইপ করতে গিয়ে বলের লাইন মিস করলেন শচীন টেন্ডুলকার। লেগ বিফোরের জোরালো আবেদনে আঙ্গুল তুলে আম্পায়ার আউটের সংকেত দিলেন। আট উইকেটের এক গল্পে টেস্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলারের শিকার বনলেন টেস্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।
হাজার বছরের সাধনার পূর্ণতা পাওয়া কোন মুহুর্ত! যুবরাজ সিং, মহেন্দ্র সিং ধোনি, প্রজ্ঞান ওঝা হয়ে মুরালিধরনের ক্যারিয়ারের ৬৭তম পাঁচ উইকেটের জালে আটকা পড়েন ভারতের শেষ ব্যাটসম্যান অভিমন্যু মিথুন। স্কোরলাইন বারে ‘ছোট’ করে দেখা যাচ্ছে ‘মুত্তিয়া মুরালিধরন ৭৯৭ উইকেট’!
ছোট করে লেখাটাই বিশালতা ছড়াবে বলে এই নিয়ে এত সাধের আয়োজন!
গল্পটা এবার তিন উইকেটের। ফলো অনে পড়ে আবার ব্যাটিংয়ে নামে ভারত। ক্ল্যাসিক অফ স্পিনারের শার্প টার্নিং এক ডেলিভারিতে ফার্স্ট স্লিপে মাহেলার হাতে মুরালির ৭৯৮ তম উইকেট। এই মাহেলার হাত ছুঁয়েই টেস্ট ক্রিকেটে মুরালির ৮০০ উইকেটের ক্যানভাস রচিত হবে।
গল্পটা এবার দুই উইকেটের। এবার মুরালির দুসরা। অফ স্ট্যাপের অনেকটা বাইরে ওয়াইড ডেলিভারিটা অ্যাঙ্গলিং করে মিডল এবং অফ স্ট্যাপে। সেখান থেকে প্যাডল সুইপ করলেন হরভজন সিং। আগের বলে একই শট খেলতে গিয়ে বেঁচে ফিরেছেন। এবার আর রক্ষে হলো না। বল ব্যাট মিস করে অফ স্ট্যাপের সাথে সাক্ষাতে বেল দুটো মাটিতে গড়িয়ে দেয়। মুরালিধরন ৭৯৯!
গল্পটা এবার এক উইকেটের। রূপকথার গল্পগুলো শিহরণ জাগাতে জাগাতে বোধহয় মুরালিধরনের শেষাংশে এসে মিলিত হয়! যেটার সমাপ্তি ঘটে কিন্তু স্বাদটা চির অম্লান হয়েই থাকে। যেখানে আক্ষেপ নামক কোন শব্দের আনাগোনা থাকে না। আক্ষেপ? এই আক্ষেপের মারপ্যাঁচে ৪ রানের জন্য ডন ব্রাডম্যানের ব্যাটিং গড় ১০০ হয়নি।
৪ রানের জন্যই শেষ টেস্ট ইনিংসে সেঞ্চুরি পাওয়া হয়নি ডনেরই সেঞ্চুরির রেকর্ড ভাঙা সুনীল গাভাস্কারের। সেখানে মুরালিধরনের জন্য ক্রিকেট কোন আক্ষেপের গল্প রাখেনি। মুত্তিয়া মুরালিধরন মানেই গড়মিল এক পাশে সরিয়ে পরিপূর্ণতায় ভরপুর সার্থক কোন জীবনের গল্প।
মুরালিধরনের শেষ এক উইকেটের গল্পে ৮০০ উইকেটের সামনে প্রতিপক্ষের উইকেটও ওই একটিই। শেষ উইকেটে পিচে ইশান্ত শর্মা এবং প্রজ্ঞান ওঁঝা। ভিভিএস লক্ষ্মণের ড্রয়ের যে আবহ সৃষ্টি করেছিলেন, এই মুহূর্তে সেটা হয়তো নেই। কিন্তু উইকেট মাত্র একটি। যেকোনো সময় যে কারো ঝুলিতে আটকা পড়তে পারে। এমন আশংকা একদমই অমূলক নয়। এদিকে উইকেটে দারুণ চনমনে শেষ দুই ব্যাটসম্যান। এমন অবস্থায় আপনি কি ভাবছিলেন? আর হচ্ছে না!
ফার্স্ট স্লিপে মাহেলা জয়াবর্ধনে যখন প্রজ্ঞান ওঝার ক্যাচ নিবেন বোলারের নাম হবে মুত্তিয়া মুরালিধরন। এমন কিছু কি মনে আঁকিবুঁকি দিয়েছিল? না দিলেও, সেই ছবিকে বাস্তবের জগতে নামিয়ে আনলেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। মুরালিধরনের বল গিয়ে তালুবন্দি হয় মাহেলার বিশ্বস্ত তালুতে। এই নিয়ে একই দৃশ্য রেকর্ড ৭৭ বার দেখেছে ক্রিকেট। ৮০০ উইকেটের মাহেন্দ্রক্ষণ! ৮০০ উইকেট! ক্রিকইনফো দেখাচ্ছিল – ‘রোম্যান্স এন্ড ফর মুরালিধরন’।
গলের প্রকৃতিতে বল হাতে একেকটা ম্যারাথন স্কেলের নায়ক ক্রিকেটে মুরালিধরনের রোমান্টিসিজমের শেষ অংশটা মঞ্চায়ণ হয়েছিল।
গলের আকাশে আতশবাজির ঝলকানিতে ছড়িয়ে পড়েছে মুরালিধরনের শ্রেষ্ঠত্ব। গলের বিশাল জায়ান্ট স্ক্রিনে ‘মুরালি ৮০০’ লেখায় মুরালির মুখে চির অমলিন হাসির মতোই ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে দিয়েছিল। মুত্তিয়া মুরালিধরনের শেষাংশের স্ক্রিপ্টটা ক্রিকেট বিধাতা সাজিয়ে রেখেছিলেন এমনই চিরজাগরূপ সাজে। মুত্তিয়া মুরালিধরনও যে এতগুলো বছর ধরে এমনই মায়াবী সাজে সাজিয়ে রেখেছিলেন ক্রিকেটের আঙ্গিনা।
শেষবেলায় হয়তো সেটারই একটুখানি পরিশুদ্ধি।