যে ডাক ফেরানো দায়

ফুটবলের আগের সেই রোমাঞ্চকর দিনগুলি আর নেই। ক্লাব গুলোর কাছে এটা একটা ব্যবসা এবং খেলোয়াড়দের কাশে এটা সুধু মাত্র তাদের পেশা, যে বেশি টাকা দিবে তাদের হয়েই তরা খেলবে, আবেগ নামক কোন কিছুর জায়গা নেই এখানে।

তবে, এই খেলাটি এখনো যে পুরোপুরিভাবে যান্ত্রিক হয়ে যায়নি তা লুইস সুয়ারেজের ন্যাসিওনালে ফিরে যাওয়া থেকে বোঝা যায়।এই দলবদল সকলের মাঝে এই বিশ্বাস ফিরিয়ে এনে যে ‘দ্য বিউটিফুল গেম’ এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি, পুঁজিবাদী এই সমাজে এখনো তার জাদু অতুত রয়েছে।

৩৫ বছর বয়সী আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড় বিশ্বের যে কোনো জায়গায় যেতে পারতেন। যে কোনও ক্লাবের জন্য তিনি একটি মূল্যবান সম্পদ এবং গোলের সামনে যে তিনি এখনো তীক্ষ্ণ গত দুই মৌসুমে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে তিনি তা প্রমান করেছেন। কিন্তু সুয়ারেজ ইউরোপ, এমএলএস এবং মধ্যপ্রাচ্যের বদলে ফিরে গেলেন তার আঁতুরঘরে, উরুগুয়ের ক্লাব ন্যাসিওনালে।

একজন প্রতিশ্রুতিশীল কিন্তু অজানা সম্ভাবনাময় কিশোর হিসেবে ডাচ ক্লাব গ্রোনিঙ্গেনের জন্য ন্যাসিওনাল ছেড়ে যাওয়ার ১৬ বছর পর আবার তিনি সেখানে ফিরে এলেন, এবার অভিজ্ঞ এক বটবৃক্ষ হিসেবে। এই সেই ক্লাব যেখানে তার আজকের তারকা হওয়ার আভাস প্রথম পাওয়া গিয়েছিল। সুয়ারেজ বরাবরই তার মাথার পাশাপাশি তার মন যা বলেছে তিনি সেই সিধান্তই নিয়েছেন।

২০০৬ সালে নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার পিছনে সুয়ারেজের ফুটবলীয় কারণ ছাড়াও অন্য একটি কারণ ছিল। শৈশবের প্রিয়তমা সোফিয়া বালবো তার পরিবারের সাথে কয়েক বছর আগে বার্সেলোনায় চলে গিয়েছিলেন আর তাই এরেডিভিসি তে যাওয়াকে তিনি দেখেছিলেন তাঁর প্রিয়তমার কাছাকাছি যাওয়ার পথ হিসেবে।

১৬ বছর বয়সী সুয়ারেজে, সোফিয়ারা বার্সেলোনায় যাওয়ার সময় তাকে বলেন যে তিনি একজন দুর্দান্ত খেলোয়াড় হতে যাচ্ছেন, তাকে ইউরোপের কোন ক্লাবের কাছে বিক্রি করা হবে এবং তারপরে ইউরোপ এসে তিনি তাকে খুজে বের করবেন। তিনটি সন্তান সহ এই দম্পতি আজ একসাথে থাকেন এবং সুখে শান্তিতে সংসার করছেন।

ন্যাসিওনালে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটি তিনি ব্যক্তিগত চিন্তাধারা প্রভাবিত হয়ে নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। দেড় দশকেরও বেশি সময় ইউরোপে বসবাস করার পর বিশ্বকাপের আগের অন্তত এই চার মাস আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে ফিরে আসার সুযোগ সুয়ারেজ এবং তার তরুণ পরিবারের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ ছিল যা তিনি হাতছাড়া করতে চাননি।

ন্যাসিওনালের আগ্রহের আগে তিনি প্রতিবেশী আর্জেন্টিনার রিভার প্লেটে যোগদানের খুব কাছাকাছি ছিলেন, রিও দে লা প্লাটা থেকে মন্টেভিডিও একটি সংক্ষিপ্ত ফেরি যাত্রা ছিল মাত্র। তবে কোপা লিবার্তাদোরেস থেকে ক্লাবের আশ্চর্যজনক বিদায় তার হৃদয় পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাড়ায়।

অন্যসব কিছুর চেয়েও ন্যাসিওনাল সমর্থকদের দ্বারা পরিচালিত প্রচারণা সম্ভবত সুয়ারেজের উপর প্রভাব ফেলে, যা ক্লাবটিতে তার ফিরে আসার ক্ষেত্রে মোক্ষম ভুমিকা পালন করে।

সামাজিক যোগাযোগ মাদ্ধম টুইটার দেওয়া এক ভিডিওতে সুয়ারেজ বলেন যে বিগত কয়েক দিনে তিনি এবং তার পরিবার ক্লাবটির সমর্থকদের থেকে যে ভালবাসা পেয়েছেন তার জন্য তিনি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাতে চান, সুয়ারেজ আরও বলেন যে তিনি এতে অভিভূত হয়েছেন। একই ভিডিওতে তিনি ন্যাসিওনালে তার আগমন নিশ্চিত করেছেন।

আক্রমণভাগের এই খেলোয়াড় বলেন যে তার কাছে আসা ভিডিও এবং বার্তাগুলি তাকে মুগ্ধ করেছে। তিনি আরও বলেন যে বার্তাগুলি টার হৃদয় স্পর্শ করেছে এবং তাকে তার সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছে। উরুগুয়ে জাতীয় দলের এই ফুটবলার বলেন যে ন্যাসিওনালের হয়ে আবার খেলার সুযোগ ফিরিয়ে দেওয়া তার জন্য সম্ভব ছিল না।

৩৫টি দেশের প্রায় ৫০ মিলিয়ন টুইটার ব্যবহারকারী এই প্রচারণায় অংশ নেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাদ্ধমটিতে তারা #SuarezANacional হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেছিল। একই সাথে হাজার হাজার ন্যাসিওনাল সমর্থক গত বৃহস্পতিবার গ্রান পার্ক সেন্ট্রালে সেরিটোর বিরুদ্ধে ক্লাবের ম্যাচের সময় মাঠে সুয়ারেজের মুখোশ পরেছিল। দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম কট্টর সমর্থকদের মাঝে এই একাত্মতা দেখানো বিস্ময়কর তো বটেই।

সেই রাতে ন্যাসিওনালের পারফরম্যান্স সম্ভবত তাদেরকে সাহায্যই করেছে, উরুগুয়ের ইন্টারমিডিও চ্যাম্পিয়নশিপের গ্রুপ ২ এর শীর্ষে নিজেদের স্থান সুসংহত করতে সেররিটোকে তারা ৫-০ গোলে পরাজিত করেছিল। বুধবারের ফাইনালে লিভারপুলের বিরুদ্ধে জিতে শিরোপা নিজেদের করে নেয় ন্যাসিওনাল। ২০১৭ সালে চালু হওয়া এই টুর্নামেন্টে এটি তাদের চতুর্থ শিরোপা।

এই ন্যাসিওনাল অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্যের সংমিশ্রণে তৈরি শক্তিশালী এক দল। ইন্টারমিডিয়ায় তারা মাত্র ১টি গোল খেয়েছে এবং ১৫টি গোল করেছে। দলটিতে পূর্বে বোকা জুনিয়র্স এবং ইন্ডিপেনডিয়েন্টে খেলা আর্জেন্টাইন ওয়ারহর্স এমানুয়েল গিগলিওত্তির মতো খেলোয়াড় রয়েছে।

বর্তমানে ৯ নম্বর জার্সি পরে খেলা এই খেলোয়াড়ের জার্সির নম্বরের দিকে সুয়ারেজ নি:সন্দেহে তার নজর রাখবেন, কারণ যখন তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বোলসো খেলোয়াড় হিসাবে উপস্থাপন করা হবে তখন নিজের জার্সির পেছনে তিনি সেই নম্বর দেখতে চাইবেন বৈকি।

২৩ বছর বয়সী ব্রায়ান ওকাম্পোর মতো প্রতিভা, যিনি ইতিমধ্যে উরুগুয়ে জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন এবং ২২ বছর বয়সী ফ্রাঙ্কো ফাগুন্ডেজ আক্রমণভাগে তার সম্ভাব্য সতীর্থ হিসেবে খেলবেন। রক্ষণে রয়েছেন ২১ বছর বয়সী নিকোলাস মারিচাল, যাকে ভবিষ্যতে ডিয়েগো লুগানো, ডিয়েগো গডিন এবং জোসে মারিয়া গিমেনেজের মত দুর্দান্ত খেলোয়াড় হবেন বলে মনে করা হয়।

তাই বলাই যায় যে সুয়ারেজ নিছক পারিবারিক যাত্রার জন্য দেশে আসছেন না। ঘরোয়া লিগ শিরপার পাশাপাশি ন্যাসিওনাল কোপা সুদামেরিকানা শিরোপার জেতার জন্যও লড়বে, যেখানে আগস্টের শুরুতে তারা কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের অ্যাটলেটিকো গোইয়ানিয়েন্সের মুখোমুখি হবে।

গোইয়ানিয়েন্সের সাথে ম্যাচটি জিততে পারলে তারা শেষ চারে সাও পাওলো বা সিয়ারার মুখমুখি হবে, যা ১৯৮৯ সালের পর ক্লাবটিকে তাদের প্রথম মহাদেশীয় শিরোপার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে। ওই একই বছরের পর উরুগুয়ের কোন ক্লাব আর আন্তর্জাতিক শিরোপা ঘরে তুলতে পারেনি।

সুয়ারেজ তারপরে তার ছেলেবেলায় ক্লাবের হয়ে ইতিহাস তৈরি করতে চলেছেন তা বলাই যায়। একই সাথে ক্লাব এবং তার সমর্থকদের কাছ থেকে পাওয়া অসাধারন সমর্থনের শোধ তিনি মাঠে তার খেলা দিয়েই দিতে চাইবেন যা ন্যাসিওনাল এবং পুরো উরুগুয়ের ফুটবলকে আনন্দের রাজ্যে পাঠাবে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে এবং আগামী কয়েক মাসকে অনন্দে ভরিয়ে তুলতে যা করা দরকার তার সব কিছু করার সামর্থ্য আছে তার।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link