আমরা মলয় বাতাসে ভেসে যাব শুধু…

পৃথিবীর প্রাচীনতম নদীমাতৃক সভ্যতার ইতিহাস পড়ানো হত স্কুলে। তখন বুঝিনি। পরে বুঝেছিলাম মেসোপটেমিয়া সভ্যতা একা টাইগ্রিস নদী গড়ে দিতে পারে নি সাথে জুড়ে গিয়েছিল ইউফ্রেটিসের নাম। চৈনিক সভ্যতা একা হোয়াংহো নদী গড়তে পারেনি। সাথে মিশেছিল ইয়াং সিকিয়াং।

কাঠুরের কুঠারের সাথে জোর লড়াই চলে বুড়ো বটগাছের। নাছোড় ঝুরি কেটে গড়ে ওঠে ইমারত। সন্ধ্যায় কাঠুরে এসে বসে সেই কেটে যাওয়া গুঁড়ির তলায়, কাঁদে হয়তো! আমরা বুঝতে পারি না, আমরা বুঝতে পারি না কখন একে একে দুই হয়ে যায় দুই মন- তখন আকাশে আতশবাজির রোশনাই থাকে না, জেগে ওঠে চিরন্তন জ্যোৎস্না।

২০০৪ মিয়ামি মাস্টার্সে বিশ্বের একনম্বর তারকা রজার ফেদেরার যখন এক অখ্যাত ১৭ বছরের স্প্যানিশ তরুণের কাছে স্ট্রেট সেটে হেরে গেলেন তখন কী মনে হয়েছিল তার? পিট সাম্প্রাসের সাথে তাঁর সেই ম্যাচটাই কি ইতিহাস ফিরিয়ে দিল তাকে যেখানে দুর্ধর্ষ সাম্প্রাসকে তিনি উড়িয়ে দিয়েছিলেন ১৯ বছর বয়সে?

২০০৫ ফ্রেঞ্চ ওপেনে আবার ইন্দ্রপতন! ফের সেই স্প্যানিশ ছোকরার কাছে হার টেনিসের মহাতারকার।

থমকে গেলেন রজার ফেদেরার। থামলেন না। তিনি উপলব্ধি করলেন কিছু, মনে মনে হয়ত ভাবলেন – ‘মহাকাব্য লেখার যোগ্য সঙ্গী ঈশ্বর হয়ত পাঠিয়েছেন তাঁর কাছে…’, ফাইনালের পর ফেদেরার গিয়ে কাঁধে হাত রাখলেন তরুণের। ট্রফির ওপর একটা কামড় বসানোর পর মিডিয়ার সামনে স্প্যানিশ তরুণ কি অবলীলায় বললেন যে, ‘আমি যাই খেলি না কেন ফেদেরারই সেরা!’

মনে মনে হাসলেন ফেড, নিজের কলম আর দোয়াতটার দিকে তাকিয়ে রইলেন, রাফায়েল নাদাল এসে ভাগ করে নিল দোয়াতের কালি, ব্যসদেব-গণেশের কাল্পনিক মহাভারত রচনার চেয়েও রোমাঞ্চকর ভাবে শুরু হল টেনিসের রূপকথা লেখার মহড়া।

তারপর? একটু একটু করে পেরোল অনেকগুলো বছর৷ টেনিস বিশ্ব দেখল দুই টেনিস সম্রাটের রাজত্ব। ছেলেবেলা তুলনা টানলে মাস্টারমশাই বলতেন ‘ঊনিশ-বিশ’, সংখ্যাটা বাস্তবে এখন হল ২০-২০। গ্র‍্যান্ডস্ল্যামের দুনিয়াতে ম্যাকেনরো-বর্গ-আগাসি-সাম্প্রাস পরবর্তী সময়ে কোনোনেক খেলোয়াড় নয় রাজত্ব করল একটা অধ্যায়, টেনিসের সবচেয়ে বর্ণময় ফেডাল অধ্যায়।

ফেড অম্লান বদনে স্বীকার করেছেন নাদালের লালমাটির আধিপত্যকে। তেমনি উইম্বলডনে ঘাসের সেন্টার কোর্টে এগিয়ে ফেদেরার। ফেডেরার যেখানে অবিসংবাদী নায়ক। সাংবাদিকরা সজেষ ফ্রেঞ্চ ফাইনালের পর নাদালকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘লালমাটিতে ফলাফল আপনার পক্ষে ৬-০, তাহলে সর্বকালের সেরা হিসেবে রজারকে কি পিছনে ফেলে দিলেন?’

নাদালের জবাব ছিল, ‘আমি ১০-০ করলেও টেনিসের সর্বকালের সেরার নাম রজার ফেডেরার-ই থাকবে, যে এই সত্য মানে না সে টেনিসের কিছু জানে বলে আমি মনে করি না।’

সেদিনই হয়ত রোলা গ্যাঁরোয় রূপকথার শেষ অধ্যায় লেখা শুরু করলেন দুজন, দূরে কোথাও বৃষ্টি নামল। বিশ্বের ইতিহাসে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে কি কোনোদিন এভাবে অকপটে একে অপরকে শ্রেষ্ঠ বলতে দেখা গেছে? হয়ত না!

একটার পর একটা ইনজুরি যখন নাদালকে ছিটকে দিচ্ছে পরপর গ্র‍্যান্ডস্ল্যাম থেকে হয়ত রজারের মন খারাপ হত তখন, সার্ভিস করার আগে আর চোখে বিপরীত কোর্টে ওই নাইক ব্যান্ড বাঁধা লম্বা চুলের বন্ধু নেই যে!

রিটার্ন বলটা এত চ্যালেঞ্জিং ভাবে কেউ তো আর ছুঁড়ে দেয় না, কেউ তো একটু স্লো রিটার্ণ হলেই বাঁ হাতে ঝাঁঝালো টপস্পিন মাখিয়ে ফিরিয়ে দেয় না কোর্টে- নাদাল ছাড়া গ্র‍্যান্ডস্ল্যাম জেতার আনন্দ পায় না রাজা। তবু শেষ দু’বছরে হয়তো টেনিসের সর্বাধিনায়ক চাইলেন রূপকথার শেষ অধ্যায়টা লেখা হয়ে যাক তাই ফিরে এল ফেডাল লড়াইগুলো।

আর তো কয়েকটা দিন। তারপরই পৃথিবী ভেঙে যাবে একটা সাদা নেটবরাবর। একদিকে লালমাটির রঙ মেখে পকেট থেকে বল বের করে চুলটা কানের পাশে যত্ন করে রাখবেন নাদাল, অন্যদিকে সবুজ সেন্টার কোর্টে বন্ধুর সার্ভিসের অপেক্ষা করবে টেনিসের রাজা- দুই বন্ধুর খেলার মাদকতা ছড়িয়ে পড়বে অনন্তে, এই মিডিয়া-প্রেস-ফ্যানের দুনিয়া থেকে বহুদূরে কোনো অচেনা পাখির শহরে দুজনে ভেসে যাবে মলয় বাতাসে।

আর আমরা দুজনের রেখে যাওয়া রূপকথার বইটা পড়তে থাকব, সেই কুসুমের মধু পান করতে থাকব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link