নেভিল কার্ডাসকে পুরোনো বলি কী করে!

একটা সময় পাঠকরা খেলা দেখতেন ক্রীড়া সাংবাদিকদের কলমে। যে যুগে ছিল না ৪২ ইঞ্চি এলইডি টিভি, ছিল না পকেটে থাকা স্মার্টফোন যাতে করে দেখা যায় প্রতিটি বল। এখন এসবই আছে, আসলে আছে তারও বেশি কিছু।

খেলার প্রতিটি মুহুর্ত, খেলার আগে-পরে কিংবা মাঝে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ এবং সর্বোপরি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। তাই সেই সময়কার পাঠকরা দিন ভরে অপেক্ষা করতেন একটা ম্যাচ রিপোর্টের জন্য। শুধু ম্যাচ রিপোর্ট দিয়েই তখনকার পাঠকদের মন ভোলানো গেলেও একজন এসেছিলেন তা পাল্টে দিতে।

পাঠকদের নিজে যেচে পরিচয় করিয়ে দিলেন ক্রীড়া সাংবাদিকতার এক নতুন অধ্যায়কে। কালক্রমে যিনি ক্রীড়া সাংবাদিক থেকে হয়ে উঠেছিলেন ক্রীড়া লেখক। যে লেখনি ছুঁয়ে দিয়েছিল,কখনো কখনো পেড়িয়ে গিয়েছিল সাহিত্যের মানদন্ডকেও। তিনি ক্রিকেট সাহিত্যের জনক নেভিল কার্ডাস। পুরো নাম – স্যার জন ফ্রেডেরিক নেভিল কার্ডাস।

আজীবন ধরে চলতে থাকা ম্যাচ রিপোর্টের নীতিমালা পড়িয়েই তাঁকে দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকা পাঠিয়েছিল ম্যাচ কাভার করতে। তবে নেভিল কার্ডাস হয়তো প্রেসবক্সে গিয়েছিলেন নিজের অন্য পরিকল্পনা নিয়েই। অবশ্য তা ভিন্ন পরিকল্পনা থাকাই যে স্বাভাবিক।

এই যে তিনি বিশ্বসেরা ক্রিকেট লেখকদের একজন, শুধু লিখেই নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন ক্রিকেটারদেরও উপরে সেটার কৃতিত্ত্ব যে শুধুই তাঁর। জন্মের পর কখনো নিজের পিতাকে দেখা সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। আমাদের সমাজব্যবস্থার মতে তিনি অবৈধ সন্তান। পড়াশোনা করার সুযোগও সেভাবে কখনো পাননি। তবে নিজেকে সাহিত্যের রস থেকে বঞ্চিত হতে দেননি তিনি।

লাইব্রেরি থেকে সারি সারি বই পড়েছেন। যেহেতু ধরাবাধা নিয়মের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর ছিল না তাই হয়তো নিজেই গড়ে তুলতে পেরেছেন একটি স্টাইল। যেই স্টাইল তিনি রেখে যাবার পর একটা লম্বা সময় ধরে অনুসরণ করে যাবে তাঁর উত্তরসরিরা।

ক্রিকেট খেলাটাকে তিনি লিখতেন একটা উপন্যাসের মত করে। ক্রিকেটাররা সেই উপন্যাসের একেকটি চরিত্র। সেই চরিত্র গুলো তিনি ফুটিয়ে তুলতেন নিখাদ সাহিত্যের ছোঁয়ায়। কখনো কখনো তা মনের মাধুরি মিশিয়েও বটে। প্রিয় ক্রিকেটারদের বানাতের সেই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। এমন সব উপমা তাঁর লিখায় নিয়ে আসতেন যে ক্রিকেটাররাও সেই লিখা পড়ার জন্য আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতেন।

তাঁর কাছে ক্রিকেট ম্যাচটার চেয়ে কখনো কখনো সমুদের কোল ঘেষা একটা স্টেডিয়াম যেখানে হাজার ত্রিশেক লোক খেলা দেখছে সেটাই বড় হয়ে উঠতো। সেসব গল্প ফাদতেন সেই মাঠে উপস্থিত থাকতে না পারা পাঠকদের জন্য। ক্রিকেট নিয়ে তাঁর লেখার অনেকটা অংশেই থাকতো কল্পনা।

একবার কে যেন কার্ডাসকে বলেছিলেন, ‘আপনি যে লিখেছেন, বোলিং মার্কে ফিরে যাওয়ার সময় অমুক বোলার এটা বলেছেন, আসলে তো তা বলেননি।’ কার্ডাস নির্বীকার ভঙ্গিতে উত্তর দেন, ‘বলেনি, তাতে কী! বলা উচিত ছিল।’

নেভিল কার্ডাস জীবদ্দশায় বেশ কিছু বইও লিখে গিয়েছেন। নেভিল কার্ডাসের আত্মজীবনী অটোবায়োগ্রাফি বইটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সাম্প্রতিক কালের সেরা ক্রিকেট–লেখকদের অন্যতম শিল্ড বেরি তাই লিখেছেন, ‘কার্ডাস অবশ্যই ইতিহাসের সেরা ক্রিকেট-লেখক নন, কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে যাঁরা লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে তিনিই সেরা লেখক।’

নেভিল কার্ডাসের বই এখন রীতিমতো দুষ্প্রাপ্য, পুরোনো বইয়ের দোকানই একমাত্র ভরসা। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বইয়ের নাম —গুড ডেইজ, ক্রিকেট অল দ্য ইয়ার, ডেইজ ইন দ্য সান, সেকেন্ড ইনিংস, ক্লোজ অব প্লে, অস্ট্রেলিয়ান সামার।

তবে আধুনিক ক্রিকেটের লেখনিতে তাঁকে অনেকেই হয়তো সেরা মানতে রাজি নন। কেননা শত শত মাইল দূরে বসেও মানুষ খেলার প্রতিটি মুহুর্ত দেখতে পারছে। ফলে এখনকার পাঠকদের কাছে কল্পনার কোনো স্থান নেই। এটিই হয়তো আজকের ক্রীড়া সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সেই চ্যালেঞ্জ পেড়োতে গেলেও অনুসরণীয় সেকেলে নেভিল কার্ডাস।

ক্রিকেট লেখনিকে যেই সাহিত্যের পর্যায়ে তিনি নিয়ে গিয়েছিলেন সেই সাহিত্য তো এখনো সমানভাবে পাঠক প্রিয়। খেলার প্রতিটা বল দেখার পরেও তো পাঠক জানতে চায় খেলার ভিতরের খেলাকে নিয়ে। যেই খেলা নিয়ে লিখতেন আমাদের পথপ্রদর্শক নেভিল কার্ডাস। প্রিয় খেলোয়াড়দের উপন্যাসের নায়ক হিসেবে তো আজকের পাঠকও সমান ভাবে দেখতে চান। তাহলে আধুনিকতার বুলি আওড়ে আমরা নেভিল কার্ডাসকে পুরোনো বলি কী করে!

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link