বিহারি-অশ্বিন ও কাকাবাবুর গল্প

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম বাংলা সাহিত্যে ‘কাকাবাবু’ লিখেছিলেন। এমন একটি লোক, যাঁর পাণ্ডিত্য অসাধারণ অথচ লোকটির একটা পা নেই। তবু সে কেনিয়া-তানজানিয়া-মাসাইমারা-আন্দামান চলে যায় অক্লেশে। স্রেফ ইচ্ছেশক্তির গল্প, সেটাই অমর হয়ে রয়েছে বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে। এতটাই ইচ্ছেশক্তি, তিনি কখনো হীরে উদ্ধার করেন, আবার তিনিই মাসাইমারার গোটা জঙ্গল হাঁটেন। প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার হাঁটেন ক্রাচ ছাড়া।

এসব শুনলে, ভাবলে লোকে উড়িয়ে দেয় আজকাল। আজকের জেনারেশন কতটা কাকাবাবু পড়েছে আমার জানা নেই। তবে খুব মন দিয়ে পড়লে সেটাকে হাসির খোরাক বানাত। অদ্ভুতুড়ে সব ঘটনা। এসব হয় নাকি বাস্তবে! মা, তুমি বলো গল্প বাস্তব ঘটনা থেকে উঠে আসে। তা এগুলো কোথায় হয়েছে পৃথিবীতে? দেখাও দেখি আমায়! – কতকটা এই সুরই ভেসে আসবে। ব্যঙ্গ, কৌতুক। তামাশা।

বাঙালির আমাশা আর তামাশা দুটিই বড় ভয়ানক। ধরলে ছাড়ে না। তো ঘটনা হল, আজকে দুপুরের পর আপনি যতখুশি বাইরের খাবার খান। পেট খারাপ থাকলেও। কারণ, আজকের দিনটা সেলিব্রেট করার। লড়াইয়ের সেলিব্রেশন। খোঁড়া পা নিয়ে পাল্টা লড়াইয়ের সেলিব্রেশন। ঠিক কী রকম ব্যাপারটা? কিছুই না, স্রেফ ইচ্ছেশক্তি।

 

টিমটা ছোটখাট হাসপাতাল। পরপর পাঁচটা সলিড প্লেয়ার বাইরে। কেন? চোট-আঘাতে জর্জরিত। এমনকি প্রথম ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেওয়া বোলারটা পর্যন্ত দ্বিতীয় ইনিংসে বল-ব্যাট কিছুই করতে পারল না। ডান হাতটা কলাগাছের মত ফুলে গেছে! অর্থাৎ সব মিলিয়ে ছ’খান খেলোয়াড় দলের বাইরে। এমনই অবস্থা, অধিনায়ককে এখনও পর্যন্ত প্রতিটা টেস্টে নতুন খেলোয়াড়কে অভিষেক করাতে হয়েছে।

তারা একেবারেই নিরাশ করেনি। কিন্তু চক্রব্যূহের সামনে আনকোরা নতুন অভিমন্যু আর কতক্ষণ! কোথাও গিয়ে থামতেই হবে। সেটা কদ্দূর? ৩১ রানের তারিফ করার মত ইনিংস বটে, তাতে গোটা চারেক বাউন্ডারিও আছে – তবু ৪০৭ এর হিমালয়ের কাছে ওটা শুশুনিয়া পাহাড়। কিছুই নয়। অর্থাৎ চাই অভিজ্ঞতা। সে জায়গা বরাদ্দ তিন নম্বর ব্যাটের। তা তিনি করলেন ৭৭।

সত্যি অনবদ্য। এরপর টেস্ট ক্রিকেট মহাশয় টোড়ি রাগ ছেড়ে বলিউডে এলেন। ৯৭ রানের ইনিংস খেললেন। ব্যাপারটা হল, জগঝম্পটা এবার বেশ ভাল লাগল। অর্থাৎ সবকিছুই তাল রেখে চলছিল, মুশকিল হল যখন এগুলো সব বন্ধ হয়ে গেল, তখন থেকে … ২৭০/৫। লকডাউনে কলকাতার আকাশের চেয়েও পরিস্কার, ভারত হারছে।

 

সামনে তখন ১৩৭। আর ব্যাটসম্যান নেই নেই। টেলএন্ডারদের ওপর তো আর ভরসা রাখা যায় না। ওগুলোকে সমাজ মিরাকল্ নামে ডাকে। অগত্যা দুই ব্যাটসম্যান শিবরাত্রির সলতের মত টিমটিম করছেন। যাদের একজনের পুরো শরীরে আঘাত। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। অপরজনের হ্যামস্ট্রিংয়ে এতটাই ব্যথা যে দৌড়ে রান নেবেন সে অবস্থাতেই নেই। এতসব জানা ছিল না। তাই একটা উদ্ভট কথা আমার মুখ থেকে বেরিয়েছিল, ‘টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য নষ্ট করছে হনুমা বিহারী।’

এইবার শুরু হল কর্ণের শেষ যুদ্ধ। কিছু পাওয়ার নেই, কিছু দেওয়ার নেই। সব শেষ। শুধু অস্তিত্বের লড়াই, মৃত্যুর আগে মৃত্যুর চেয়ে বড় হওয়ার অদম্য লড়াই। শহীদের রক্ত হবে না ব্যর্থ। উল্টোদিকে স্টার্ক-কামিন্স-হ্যাজেলউড-লিঁও। যেন এক একটা ম্যানইটার! পেলেই থাবা বসাবে। আর তাই করছিলও। অশ্বিন সজোরে পাঁজরে খেলেন ব্যাগি গ্রিন অভ্যর্থনাটা।

ঠিক করে শ্বাস নিতে পারছিল না লোকটা। ক্রিজের অপরপ্রান্তে হনুমা বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি মাঝপিচও দৌড়ে পার হতে অক্ষম। অর্থাৎ ঘিরে ধরো দু’জনকে। শর্ট লেগ, সিলি পয়েন্ট, লেগ গালি, স্লিপ, শর্ট মিড উইকেট – যে যেখানে ছিল সেখান থেকে কাছে চলে এল। তবু তারা বিনা যুদ্ধে নাহি দেয় সূচাগ্র মেদিনী।

৪০ ওভার ব্যাট করল দু’জনে। ঠিক সেসময় কোন ঝাড়ুদার রাস্তা পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত। হনুমার এক একটা ডিফেন্স তাঁকে মনে করাচ্ছে দিনের পর দিন সয়ে যাওয়া বড়বাবুদের অপমানগুলো। চোখ দপ্ করে জ্বলে উঠবে তার এখনি। একই সময় ইন্টারভিউ প্যানেল ৩০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে না পারার জন্য দত্তবাড়ির ছোট ছেলেটাকে চাকরি দিল না।

ফাইল হাতে বেরিয়ে আসতে আসতে মায়ের মুখটা মনে পড়ছিল ওর। অচিরেই চোয়াল শক্ত হল। অশ্বিন কামিন্সের বাউন্সারটা ডিফেন্ড করতেই প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মেট্রোতে সুইসাইড করতে যাওয়া মেয়েটা দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখ তুলে দেখল ওর জন্য লড়াই লেখা আছে। আর একই সময় আরেকটা ছেলে ঘরে বসে খেলাটাই দেখছিল। প্রতিটা বল। ও জীবনকে বড় দোষারোপ করে। প্রতিজ্ঞা করল, আজ থেকে আর দোষ দেবে না। লড়বে, শেষ অবধি।

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরেও এই টেস্ট নিয়ে কথা উঠবে। উঠবেই। অধিনায়ক-সহ টিমের শিরদাঁড়াওয়ালা ব্যাটগুলো বিদায় নেওয়ার পর, গোলাবিদ্ধ শরীর নিয়ে লড়ে যাওয়ার গল্প আমরা শোনাব আমাদের পরের প্রজন্মকে। ওরাও মুগ্ধ হয়ে শুনবে। শুনবেই।

কলেজ স্ট্রিট থেকে বই কেনা, টাকা দিয়ে স্কুল-কলেজে ভর্তি হওয়া যায়, ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া যায়, প্রোমোশন করা যায়। জীবনযুদ্ধের শিক্ষাটা পাওয়া যায় মাটি থেকে, লড়াই থেকে, ক্ষেত্র থেকে। যে শিক্ষাটা আজ সারা সকাল ধরে ক্রমাগত দিয়ে গেলেন হনুমা বিহারি-রবিচন্দ্রন অশ্বিন। আমি সূর্যাস্তের আলো মাখা বিকেলে দাঁড়িয়ে তাঁদের ধন্যবাদ জানাই। এটুকুই করতে পারি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link