দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেয়া এক দশ বছরের বালককে নিয়ে তাঁর পরিবার চলে এলো নিউজিল্যান্ডে। তখন কে জানতো এই ছেলেটাই একদিন নিউজিল্যান্ডের টেস্ট ক্রিকেটের নব জাগরণের অন্যতম নায়ক হবেন। কে জানতো বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানদের একজন হবেন তিনি।
খড়কুটো নিয়ে ভাসতে থাকা নিউজিল্যান্ডের টেস্ট দলে এসে দলটার পাঁয়ের নিচে মাটি এনে দিলেন। অত:পর টেস্ট ক্রিকেটে বিশ্বজয় করার দিনে তিনি বিদায় নিলেন নীরবে-নিভৃতে। তবুও ব্র্যাডলি জন ওয়াটলিং, তুমি রবে নীরবে-হৃদয়ে মম।
বিজে ওয়াটলিং এর ক্রিকেট যাত্রাটা শুরু হয়েছিল স্কুল জীবন থেকেই। স্কুলে থাকতেই নানা ট্রফি জিতে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তবে তাঁর জীবনের প্রথম বড় সুযোগ আসে বাংলাদেশে। ওয়াটলিং ক্যারিয়ারের মাঝপথেও তাঁর জন্য আরেকবার ত্রানকর্তা হয়ে আসবে বাংলাদেশ। সেই গল্প বলার আগে বাংলাদেশে তাঁর প্রথম কীর্তির কথা বলে নিই।
২০০৪ সালে বাংলাদেশে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলতে এসে প্রথম ক্রিকেটবিশ্বের নজরে আসেন ওয়াটলিং। সেই আসরে বাজিমাত করার পুরষ্কার হিসেবে পেয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার সুযোগ। অকল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে আট নম্বরে নেমে করেছিলেন ৩৭ রান।
সেই থেকে প্রায় পাঁচ বছরের লম্বা যাত্রা শেষে অবশেষে ডাক পান নিউজিল্যান্ড দলে। পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক টেস্ট ম্যাচেই খেলেছেলিন্ ৬০ রানের অপরাজিত এক ইনিংস। তবে এরপর খুব একটা বড় ইনিংস খেলতে না পারায় দলে নিয়মিত হতে পারছিলেন না।
২০১০ সালে ব্রেন্ডন ম্যাককালাম যখন টেস্টের কিপিং গ্লাভস খুলে রাখতে চাইলেন তখনই নিউজিল্যান্ডের ত্রানকর্তা হয়ে এলেন ওয়াটলিং। ২০১৩ সালে থেকে তাঁকে নিয়মিত কিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলাচ্ছিল নিউজিল্যান্ড। তবে ওই বছর ইংল্যান্ডে ব্যাট হাতে খুব খারাপ সময় পাড় করায় আবার দলে তাঁর জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল।
এরপর বাংলাদেশে পাওয়া জীবনের দ্বিতীয় বড় সুযোগটাকে কাজে লাগান ওয়াটলিং। চট্টগ্রাম টেস্টে সেদিন আট নম্বরে নেমে ১০৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। এরপর আর কখনো ফিরে তাকাননি এই ব্যাটসম্যান। বরং টেস্ট ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ড দলে অপরিহার্য অংশ হিসেবে গড়ে তুলেছেন নিজেকে।
ওয়াটলিং অভিষিক্ত হবার পর বিশ্বক্রিকেটে আর কেউ ছয়-সাত নম্বরে ব্যাটিং করে তাঁর চেয়ে বেশি রান করতে পারেননি। একজন উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর চেয়ে বেশি সেঞ্চুরি আছে মাত্র তিনজনের। এত নিচে ব্যাটিং করেও নিউজিল্যান্ডের অন্যতম রান সংগ্রাহকদের একজন ছিলেন তিনি।
৭৬ টেস্ট ম্যাচের ক্যারিয়ারে ৩৭.৫২ গড়ে করেছেন ৩৭৯১ রান। ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত এই ফরম্যাটে তাঁর ঝুলিতে আছে আটটি সেঞ্চুরি। সবচেয়ে বড় কথা তাঁর এই আটটি সেঞ্চুরিই এসেছে ছয় কিংবা তাঁর নিচে ব্যাট করে।
দেশের বাইরেও ওয়াটলিং এর ব্যাটিং ধাঁর একটুও কমতো না। ঘরের মাঠে তাঁর ব্যাটিং গড় ৩৯.৪১ এবং দেশের বাইরে সেটা ৩৮.৬৪। এমনকি তাঁর আট সেঞ্চুরির চারটিই এসেছে দেশের বাইরে।
এছাড়া যেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শুরুতে খাবি খেয়েছিলেন সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ক্যারিয়ার শেষে তাঁর ব্যাটিং গড় ৫২.৯৩। ২০১৫ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে ১২০ রান করে দলকে জয় এনে দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে ভারতের বিপক্ষে ম্যাককালামের সাথে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে যোগ করেছিলেন ৩৫২ রান। ম্যাককালামের ট্রিপল সেঞ্চুরির সেই ম্যাচে ওয়াটলিং তাঁকে সঙ্গ দিয়েছিলেন ১২৪ রানের এক ইনিংস খেলে।
তবে এইসব পরিসংখ্যানের জন্য আসলে বিজে ওয়াটলিং কে কেউ মনে রাখবেনা। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট যদি একজন মানুষ হতো তাহলে সেটা ওয়াটলিং। কেননা ক্রিকেটের সবচেয়ে অভাগা ও সবচেয়ে আন্ডাররেটেড দলটা নিউজিল্যান্ড। আর নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে আন্ডাররেটেড ক্রিকেটার হলেন ওয়াটলিং।
তবে ওয়াটলিং আজীবন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট ভক্তদের মনে থাকবেন একজন ত্রাণকর্তা হিসেবে। তিনি থাকবেন খাঁদের কিনারা থেকে উঠে আসা কিউইদের গল্পে, তিনি থাকবেন ম্যাককালামের ট্রিপল সেঞ্চুরির দিনে নীরব সৈনিক হিসেবে কিংবা উইকেটের পিছনে ব্ল্যাক ক্যাপদের আস্থার হাত হয়ে।