খনি থেকে খুঁজে আনা নূর

সে হিসেবে লেগ স্পিনারদের খনি বলা যায় আফগানিস্তানকে। সেই খনি থেকে রত্ন খুঁজে আনতে প্রয়োজন জহুরির চোখ। তেমনই এক জহুরির চোখ খুঁজে পেয়েছে নূর।

‘এখনও এক হাজারের বেশি লেগ স্পিনার আছে’ – ঠিক এমন মন্তব্যই রশিদ খান করেছিলেন হার্শা ভোগলের করা এক প্রশ্নের জবাবে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ আফগানিস্তান নতুন করে নিজেদের পরিচয় জানান দেওয়া রাস্তা খুঁজে পেয়েছে। সেটা ক্রিকেট। আর সেই পথ প্রদর্শক হিসেবে রয়েছেন অনেকেই।

তবে বিশ্বের বুকে দাপট দেখিয়ে যাওয়ার সাহসটা জুগিয়েছেন রশিদ খান। আফগানিস্তানের প্রতিটা কিশোরের হয়ত রোল মডেল তিনি। সবাই হয়ত তার মতই একজন বিশ্ব নন্দিত লেগ স্পিনার হতে চায়। তেমন হাজার খানেক কিশোর হয়ত নিজেদের আলো ছড়াতে অপেক্ষমান।

সে হিসেবে লেগ স্পিনারদের খনি বলা যায় আফগানিস্তানকে। সেই খনি থেকে রত্ন খুঁজে আনতে প্রয়োজন জহুরির চোখ। তেমনই এক জহুরির চোখ খুঁজে পেয়েছে নূর। সেই নূরের আলোতে আরও একবার আলোকিত হচ্ছে আফগানদের ক্রিকেট সম্ভাবনা।

নূর আহমেদের বয়সটা কেবল ১৮। এরই মধ্যে তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের মঞ্চে নিজের নামটি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। তবে এই নূর আহমেদের জন্য এই মঞ্চটা তৈরি করে দিয়েছেন অন্য কেউ। মানুষটি গুজরাট টাইটান্সের সহকারী কোচ আশিষ কাপুর। সাবেক ভারতীয় স্পিনারের চোখ খুঁজে নিয়েছে নতুন এক রশিদ খান।

আইপিএলের এই মঞ্চটা খুব সহজেই যে পেয়ে গেছেন নূর আহমেদ, তা নয়। মূল লড়াইটা চালিয়ে গেছেন আশিষ কাপুর। আশিষ কাপুর ২০১৮-২০২১ সময়কালে ছিলেন ভারতের বয়সভিত্তিক দলের নির্বাচক। সেই সময়ে তিনি প্রথম দেখেছিলেন নূর আহমেদকে। ২০১৯ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলতে এসেছিলেন নূর। তখনও তার বয়স হয়নি ১৫।

সেই ১৫ এর গণ্ডি না পেরুনো কিশোর পাঁচ ওয়ানডে ম্যাচে নয় উইকেট বাগিয়েছিলেন। আর তাতেই নূর নজর কাড়েন আশিষের। পরবর্তী সময়েও তিনি নিজের আগমনী বার্তা দিয়েছেন। ২০২১ যুব বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। আর সেই দলের বিপক্ষেও চার উইকেট নিয়েছিলেন নূর আহমেদ। আর তাতেই আশিষের মনে ধরে নূরের বোলিংকে। তিনি নূরের মধ্যে দেখেন ভবিষ্যতের তারকা হওয়ার সকল রসদ।

এরপর তিনি নূরের সেই প্রতিভার কথা সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ ও মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স দলের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। তবে কাজের কাজ হয়নি কিছুই। নূর থেকে যান আড়ালে। কিন্তু আশিষের পছন্দের তালিকায় থাকা এই খেলোয়াড়কে আইপিএলে খেলানোর জন্য এক প্রকার বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি।

তাইতো যখনই তিনি সুযোগ পেয়েছেন নিলামে অংশ নেওয়ার, তখনই তিনি নূরকে তার দলে ডাকার সুযোগটা লুফে নিয়েছেন। এমনকি তিনি গুজরাটের প্রধান কোচ আশিষ নেহেরাকে সাফ জানিয়েছিলেন তার পছন্দের কথা। এ বিষয়ে আশিষ কাপুর বলেন, ‘আমি নেহেরাকে বলেছিলাম, তোমার যাকে ইচ্ছে হয় তুমি দলে নাও। তবে আমাকে একজনকে দলে নেওয়ার সুযোগ দিও। সে নূর আহমেদ।’

তখনও অবধি খুব একটা পরিচিত মুখ ছিল না নূর। আশিষ আরও বলেন, ‘তখনও খুব বেশি মানুষ নূরের সম্পর্কে জানত না। আমার কাছে সে ছিল বাঁ-হাতি রশিদ খান। আপনি যেকোন মূল্যে রশিদ খানকে দলে নেওয়ার পর আরও একজন রশিদ খানকে দলে নেন, যে কিনা বা-হাতি। তাদের মেলবন্ধনটা হবে মারাত্মক।’

এরপরই তাকে ভিত্তিমূল্য ৩০ লাখ রুপিতে কিনে নেয় গুজরাট টাইটান্স। তখনও তার জাতীয় দলের অভিষেক হয়নি। তিনি কেবল দুইটি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলেছেন। পাশাপাশি সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে, মাত্র ১৫ বছরে বয়সে বিগ ব্যাশে অভিষেক হয় তার।

তবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) মত এত সুবিশাল এক মঞ্চে, ততটুকু অভিজ্ঞতা আসলে খুব একটা চোখে পড়ার মত নয়, যদি না খুব বেশি প্রতিভাবান হয়। প্রতিভাবান নূর ছিলেন। আর সেই প্রতিভা কেবল আশিষ কাপুরের চোখেই ধরা পড়েছিল।

আশিষ নিবিড়ভাবে নুরের পরিচর্যা করতে লাগলেন। পুরো একটা মৌসুম তাকে নিয়ে কাজ করেছেন আশিষ কাপুর। মাঝে নূরের বোলিং অ্যাকশন শুধরে দিয়েছেন রশিদ খানও। যেকোন উঠতি বয়সের কিশোরের মত করেই নূর চেষ্টা করতেন রশিদ খানের বোলিং অ্যাকশন নকল করবার। তখনই রশিদ উপদেশ দিয়েছেন। নিজের স্বকীয়তা না হারানোর বার্তা দিয়েছেন। এরপরই বোলিংয়ে আরও ধার বাড়তে থাকে নূরের।

তবুও খুব সহসাই গুজরাটের একাদশে জায়গা হচ্ছিল না তাঁর। প্রধান কোচ কোন ভাবেই সন্তুষ্ট নন। দুইজন একই ধাঁচের বিদেশি খেলোয়াড়কে খেলানো একটু মুশকিলই বটে। তবে জুয়াটা খেলেই ফেললেন আশিষ কাপুর। তিনি বোঝালেন ভারতের মাটিতে পেসারদের চাইতে স্পিনাররাই কার্যকর হবে বেশি। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।

রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে ইম্প্যাক্ট খেলোয়াড় হিসেবে হাজির নূর। সে ম্যাচে ২৯ রান খরচায় নিয়েছিলেন এক উইকেট। খানিকটা নির্ভরতা জুগিয়ে পরের ম্যাচেই একাদশে হাজির নূর আহমেদ। লখনৌ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে চার ওভারে ১৮ রান দিয়ে নেন ২ উইকেট। ব্যাস! প্রতিভার তরী তখন খুঁজে নিয়েছে প্রমাণের মঞ্চ।

যে রশিদ খানকে নকল করবেন বলেই ক্রিকেট বল হাতে তুলে নেওয়া, সেই রশিদ খানের সাথে জুটি বেঁধে তিনি কাঁপন ধরিয়ে দিতে লাগলেন প্রতিপক্ষের মনে। আর চারিদিকে বন্দনা হতে লাগলো তাকে নিয়ে। আলো ঝলমলে একটা পৃথিবীর দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছেন নূর আহমেদ। অথচ বয়টা কুড়ি থেকেও বছর খানেক দূরে।

সফলতার পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে যখন নূর পেছন ফিরে তাকাবেন, তখন নিশ্চয়ই একগাল হাসি মাখা আশিষ কাপুরের মুখখানাই দেখবেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...