বঞ্চনার উপন্যাস অথবা না হওয়ার ছোট গল্প

ভারতের স্বাধীনতার দিনে জন্মালে হয়তো সালমান রুশদি আপনাকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে পারতেন। কিন্তু তার মাস তিনেক আগে জন্মানোয় ক্রিকেট দেবতার সেই সুযোগ এসে গেল।

শুরুটা করেছিলেন অফস্পিনার হিসেবে। হাওয়ায় যখন এরকম কথা চলছে যে এরাপল্লী প্রসন্ন আর শ্রীনিবাসন ভেঙ্কটরাঘবনের পরে কোনও অফস্পিনার থাকলে সেটা তিনিই, তখনই দুঃসংবাদ এল। চাকিং-এর অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন তিনি। ফিরে আসতে সময় লেগেছিল। তখন তো আর এনসিএ ছিল না, ছিল না কোনও ভালো ক্রীড়া বৈজ্ঞানিক, যিনি ধরিয়ে দেবেন যে কোথায় সমস্যা হচ্ছে। তবু ফিরে এসেছিলেন তিনি, ওপেনিং ব্যাট হয়ে। সচরাচর এরকম ঘটে না। বাংলার ক্রিকেটে তো নয়ই।

সেই কোন জমানায় প্রবীর সেন ভারতের হয়ে উইকেট কিপিং করেছিলেন আর সুঁটে ব্যানার্জি একটা টেস্ট খেলেছিলেন ৩৭ বছর বয়সে। তারপর পঙ্কজ রায় ছিলেন বটে, ভারতের হয়ে অধিনায়কত্বও করেছিলেন। কিন্তু সুব্রত গুহর ৪ টেস্ট ছুঁয়ে বাংলার ক্রিকেট ইতিহাসকে কলমচিরা বঞ্চনার কলমে লিখতেই ভালবাসেন।

বাংলা মানেই, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, চিত্তরঞ্জন, সুভাষ, নজরুল, পঙ্কজ মল্লিক, হেমন্ত, উত্তম, সুচিত্রা। বাংলা মানে নিদেন পক্ষে গোষ্ঠ পাল, শৈলেন মান্না, চুনি, পিকে, বদ্রু ব্যানার্জী হতে পারে। কিন্তু সবুজ গালিচায় সাদা ফুলহাতা শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরে কেউ ক্রিকেট খেলতে নামছে, এ ভাবা বিলাসিতা সর্ব ভারতীয় স্তরে। হোক না সে বার তিনেক রঞ্জি ফাইনাল খেলা দল। কিন্তু চাপে পড়লে ভেঙে পড়ে, খাটে না আর ট্যালেন্ট? সে তো শীতের দুপুরে রোদ চশমা চোখে ইডেন উদ্যানে বসে কমলালেবুর খোসা ছাড়ানোয় আর পতৌদি, জয়সীমা, দুরানিদের চার ছয়ে হাততালি দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ।

তা সেই অলস বাঙালির ঘরে এমন এক ট্যালেন্ট উঠে আসবে যিনি ঋজু, ধীর এবং সঙ্কল্পে অটল সে বুঝতে বুঝতে ১৯৭৩-৭৪এর ইরানি ট্রফি হয়ে গেল। ১৭০ রানের একটা মারকাটারি ইনিংস খেলার পরে পরেই ধরে নেওয়া হল বোম্বের ওই বেঁটে মারাঠির ওপেনিং জুটি এসে গেছে। তারপর ঘরোয়া রঞ্জিতেও সেই ফর্ম ছিল ফলত: সিলন যাত্রা। শ্রীলঙ্কা তখনও টেস্ট স্ট্যাটাস পায়নি।

তবে অশোকা ডিসিল্ভা সহ বেশ কিছু ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজেদের ছাপ রাখছে। বিশ্বকাপে ডাক পাবে তারা পরের বছরেই। ভারতকেও প্রথম বেসরকারি টেস্টে প্রায় সোয়া’শ রানে প্রথম ইনিংসে পিছনে ফেলে দিল। গোপাল বসু নামলেন সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেটের উদীয়মান সূর্য সুনীল মনোহর গাভাস্কার। ১৯৪তে যখন সুনীল আউট হলেন ততক্ষণে ম্যাচ বেঁচে গেছে এবং গোপাল বসুর সেঞ্চুরি হয়ে গেছে। ম্যাচটা বেঁচে গেল। আর তার পরের ম্যাচেও মোটামুটি রান।

এরপর ইংল্যন্ড সফর। ইংল্যন্ড, তিন বছর আগে ওয়াদেকর যেখান থেকে প্রথমবারের জন্য সিরিজ জিতে ফিরেছেন। এবারে অবশ্য গ্রীষ্মের প্রথম ভাগেই সফর, যখন বল নড়ে চড়ে, উইকেট থাকে স্যাঁতস্যাঁতে। ইংল্যন্ডের ৭৪এর সফরকে ‘সামার অফ ৪২’ দিয়ে অভিহিত করা হয়। স্যাঁতস্যাঁতে উইকেটে যেখানে চূড়ান্ত ব্যর্থ হন সারা ব্যাটিং লাইন আপ, তবু টেস্টে চান্স পেলেন না গোপাল। টিম কম্বিনেশনের কারণে ফারুখ ইঞ্জিনিয়র, এমন কি একনাথ সোলকার বা সুধীর নায়েকও ওপেন করে ফেললেন। অবশ্য ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচগুলিতে তেমন ছাপ রাখতে পারেননি তিনি।

এরই মাঝে খেলে ফেলেন একটি একদিনের ম্যাচ। একমাত্র স্পিনার এবং ওয়ান ডাউন ব্যাট। ব্যাটে রান না পেলেও ১১ ওভারে ৩৭ রান দিয়ে ডেভিড লয়েদের উইকেটটি পান তিনি।

তারপর? তারপরের জার্নিটায় বঞ্চনা শব্দটা জোরদার হয় আরও। ল্যাজে গোবরে হয়ে ভারত ফিরে এলে ওয়াদেকর পদত্যাগ করলেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টাইগার পতৌদি অধিনায়ক হলেন আবার। তবে শোনা কথা হল, ট্রেন জার্নির সময় পতৌদির সিগারেট লাইটার দিয়ে জ্বালাতে অস্বীকার করেন গোপাল। তুড়ি মেরে লাইটার চাওয়ায় অপমানিত হন, গর্জে ওঠেন গোপাল। তবে পরে স্বীকার করেছিলেন, খামোখাই ছিল সেই রাগ। এবং পতৌদি যে ওকে মাদ্রাজ টেস্টে দলে না নিয়ে সোলকারকে দিয়ে ওপেন করান, তাতেও রাগ নেই কোনও। সেই টিম কম্বিনেশনের গল্প, চারটে ক্যাচ ধরেছিলেন শর্টলেগে সোলকার।

এই, তারপর কিছু বছর বাংলার হয়ে খেলেন। কিন্তু ফিটনেসের উপর জোর দেবার কথা বলার, জেদের কথা বলার হয়তো কেউ ছিল না। গোপাল বসুও থেকে গেলেন কী হলে কী হতে পারত গল্পে। অবশ্য শরদিন্দু মুখার্জীর আগে প্রথম বাঙালি হিসেবে এক দিবসীয় আন্তর্জাতিক খেলার রেকর্ডটা এখনও গোপাল বসুর নামে রয়ে গেছে।

তখন সুভাষ সরোবরে (আমরা অবশ্য কাদাপাড়া লেকই বলতাম) ইস্ট ক্যালকাটার কোচিং-এ সপ্তাহে তিন দিন যেতাম। আন্ডার থার্টিন সিএবির কোচিং ক্যাম্পে চান্স পেয়েছি। কোচ হিসেবে পেয়েছি এম পি পারমার, রুসি জিজিবয় আর অম্বর রায়কে। ফলে সকাল বিকেল চার ঘন্টা কোচিং-এ হাল্লাক হয়ে পড়ছি।

এই সময় আমাদের ইস্ট ক্যালকাটার নিয়মিত কোচ লাল্টু কাকু একদিন খবর পাঠাল, গোপাল দা আসছে, গোপাল বোস। আমি যেন কোন মতেই মিস না করি। শনিবার সকালে গিয়ে হাজির হলাম। নীল ট্র্যাকস্যুটে হালকা চেহারার এক সৌম্য দর্শন ক্রিকেটার। আজকালের খেলার পাতার দৌলতে ইতিমধ্যেই ক্রিকেট প্রজ্ঞার সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেছে। প্রথম থেকেই খুব সহজে মিশে গেল আমাদের সঙ্গে।

বেশী দিন নয়, এক মাস মত এসেছিলেন। তারপরে বছর তিনেক পরে দেশ প্রিয় পার্কে মিলন সমিতির নেটে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। আমি তখন জর্জ টেলিগ্রাফে খেলি। সে সব তো গেল আমার কথা। আসল কথাটা বলে ফেলি। আমি গোপাল বসুকে বাংলার গ্রেগ চ্যাপেল বলে মনে করি।

অন্য কোন কিছুতে নয়, ক্রিকেট প্রজ্ঞায়। হ্যাঁ, খেলার স্টাইলটা বিশেষত সামনের পায়ে এসে খাড়া হয়ে মিড উইকেট দিয়ে ফ্লিক করাটা একই রকম হতে পারত। কিন্তু একটা তেরো বছরের ছেলেকে, যে এক দু কথায় ঠিক কতটা ফ্লাইট করলে আর ফ্লাইট ভাঙালে ব্যাটসম্যানের অসুবিধে হতে পারে বোঝাতে পারে তার ক্রিকেট প্রজ্ঞা নিয়ে কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।

তখন আমি মূলত বোলার। ব্যাটিংটা নেটে বিশেষ সুযোগ পাই না। গোপাল স্যার এসেই প্রথমে বললেন, ‘যে ধরণের ক্রিকেট আসতে চলেছে, সেখানে মাল্টিডেক্সটারাস হতে হবে। ব্যাটিং বোলিং ফিল্ডিং। খুব জোরে দৌড়তাম না বলে স্লিপ বা গালির ক্যাচিং ইম্প্রুভ করতে বলেছিলেন। যেগুলো এখনও হয়তো এই বয়সে টুকটাক কাজে লেগে যায়। রিফ্লেক্স কী করে বাড়ানো যায় বা ফিজিক্যাল এজিলিটি। ডাইভ দেবার সময় কীভাবে পড়লে চোট লাগবে না। এগুলো সব গোপাল স্যারের ওই ছোট্ট পিরিয়ডের শিক্ষা ছিল।

কোচ হিসেবে যথেষ্ট স্বীকৃতও ছিলেন। বিরাট কোহলিদের অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলের ম্যানেজারও ছিলেন গোপাল বসু। কিন্তু ওই পর্যন্তই। প্রতিভার বিকাশ যে হল না, তার জন্য কারও ওপর কোনও রাগ বোধহয় ছিল না। শুধু অভিমান ছিল, ক্রিকেটের উপর অথবা ছিল না। সেসব কথা এখন আর কি জানা যায়?

উপরের কথাগুলো বলতে গিয়ে হঠাৎ একটা শূন্যতার সৃষ্টি হল। আসলে অর্ধেক জীবন ফেলে এসেছিলাম। সেখান থেকেই কেউ কেউ উঠে আসে ‘আর নেই’ সংবাদ হয়ে। তখন সব মনে পড়ে যায়। কদিন আগে টি জে ব্যানার্জী গেলেন। গোপাল স্যার। আমরাও বোধহয় বুড়ো হচ্ছি। অথবা বারবার করে জেনে যাচ্ছি নশ্বর পৃথিবীতেও কেউ কেউ মনে রাখার মতো আসে। অবিনশ্বর না হলেও তারা পায়ের ছাপ ছেড়ে যায়, একটা দুটো তুলির টানে। রঙিন পায়ের ছাপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link