প্রায় দেড় মাস ক্রিকেট যজ্ঞের পর অবশেষে পর্দা নামলো ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপের। ভারতকে হারিয়ে ষষ্ঠ বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। ঘরের মাঠে ফাইনালে ফেবারিট হিসেবে খেলতে নেমেও শেষ বাঁধাটা পেরোতে পারেনি রোহিত শর্মার দল।
তবে পুরো টুর্নামেন্টে জয়জয়কার ছিল তাদেরই। অবশ্য এবারের বিশ্বকাপ জুড়ে নজর কেড়েছেন অনেকেই। আর তারই প্রেক্ষিতে বৈশ্বিক এ টুর্নামেন্টে পারফর্মেন্স বিবেচনায় এবার সেরা একাদশ বেছে নিয়েছে খেলা ৭১। চলুন দেখে নেওয়া যাক সেই একাদশ।
- রোহিত শর্মা (অধিনায়ক) – ভারত
বিশ্বকাপ শিরোপাটা এখনো অপেক্ষমান বস্তুই রয়ে গেল রোহিত শর্মার জন্য। হয়তো বৈশ্বিক এ শিরোপ জেতার শেষ সুযোগটাও মিস করলেন। তবে ভারতকে সামনে থেকে গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ১ সেঞ্চুরি আর ৩ হাফসেঞ্চুরিতে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৯৭ রান এসেছে তাঁর ব্যাটার থেকে।
শুরুটা যদিও শূন্য দিয়ে হয়েছিল। তবে পরের ম্যাচেই আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলেন ৮৪ বলে ১৩১ রানের ইনিংস। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি এ ওপেনারকে।
পাকিস্তানের বিপক্ষে সর্বোচ্চ ৮৬ রানের পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ৮৭ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস।এরপর দুটি ইনিংস ছাড়া ফাইনাল পর্যন্ত প্রতি ম্যাচেই চল্লিশ পেরিয়েছেন তিনি। আর তাতেই এক আসরে অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটা নিজের করে নিয়েছেন রোহিত।
- ট্রাভিস হেড – অস্ট্রেলিয়া
ইনজুরির কারণে শুরুর অংশে ছিলেন না এই ওপেনার। পুরো টুর্নামেন্টে খেলতে পেরেছেন মাত্র ৬ টি ম্যাচ। আর তাতেই অস্ট্রেলিয়ার হেক্সাজয়ের অনবদ্য চরিত্র বনে গিয়েছেন এ ওপেনার। ২ সেঞ্চুরি আর ১ হাফসেঞ্চুরিতে ৩২৯ রান এসেছে তাঁর ব্যাট থেকে।
ইনজুরি থেকে ফিরে এসে প্রত্যাবর্তন রাঙিয়েছিলেন সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে। এরপর ব্যাট হাতে ৩ ম্যাচ নিজের ছায়া হয়েছিলেন এ অজি ব্যাটার। তবে নিজের চেনা ছন্দে ফিরে এসেছেন মোক্ষম সময়েই। সেমিফাইনালের ৬২ রানের ইনিংস খেলে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা। আর ফাইনালে এসে ঠিক তাঁরই পুনরাবৃত্তি ঘটান এ ব্যাটার। ভারতের বিপক্ষে ফাইনাল জয়ের নায়ক বনে যান ১৩৭ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে।
- কুইন্টন ডি কক (উইকেটরক্ষক) – দক্ষিণ আফ্রিকা
এবারের বিশ্বকাপ দিয়েই ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন ডি কক। তবে শেষটা রাঙিয়েছেন একরকম ইতিহাস গড়েই। টুর্নামেন্টের তৃতীয় সর্বোচ্চ ৫৯৪ রান করেছেন তিনি। এর পাশাপাশি উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে এ বারের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ২০ টি ডিসমিশালের রেকর্ডও তাঁরই।
আর এখানেই অনন্য এক কীর্তি গড়েছেন ডি কক। বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম উইকেটকিপার-ব্যাটার হিসেবে এক আসরে ৫০০ রান ও ২০ ডিসমিসালের রেকর্ড গড়েছেন তিনি।
- বিরাট কোহলি – ভারত
২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতো এবারও তিনি টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক। ৩ সেঞ্চুরি আর ৬ ফিফটিতে রীতিমত রানবন্যা বইয়ে দিয়েছেন এ আসরে। আর তাতে ২০০৩ সালে শচীন টেন্ডুলকারের ৬৭৩ রানের রেকর্ডও এখন অতীত। ৯৫.৬২ গড়ে ৭৬৫ রান এসেছে কোহলির ব্যাট থেকে।
তবে শুধু বিশ্বকাপের এই রেকর্ডকেই শচীনকে পেছনে ফেলেননি কোহলি। সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১১৭ রানের ইনিংসটি ছিল টুর্নামেন্টে কোহলির তৃতীয় ও ওয়ানডেতে ৫০তম শতক। আর এখানেই শচীনের ৪৯ সেঞ্চুরি ওয়ানডে রেকর্ডটি নিজের করে নেন ভারতীয় এ ব্যাটার।
- ড্যারিল মিশেল – নিউজিল্যান্ড
এবারের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের মিডল অর্ডারে প্রাণ হয়ে ছিলেন ড্যারিল মিশেল। ৬৯ গড়ে ৫৫২ রান করেছেন এ ব্যাটার। যার মধ্যে ২ সেঞ্চুরির পাশাপাশি, ২ টি পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংসও ছিল।
যদিও তাঁর দুই সেঞ্চুরির পাওয়ার দিনেই হেরেছে নিউজিল্যান্ড। রাউন্ড রবিন লিগে ভারতের বিপক্ষে ১৩০ রানের পর সেমিফাইনালে ঐ একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ১৩৪ রানের ইনিংস খেলেন তিনি।
- গ্লেন ম্যাক্সওয়েল – অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়া তাদের ষষ্ঠ বিশ্বকাপের জয়সূচক রান পেয়েছিল ম্যাক্সওয়েলের ব্যাট থেকেই। তবে গোটা টুর্নামেন্টে দলের হয়ে দারুণ অবদান রেখেছেন তিনি। ব্যাট হাতে ৬৬.৬৬ গড়ে ৪০০ রানের পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছেন ৬ টি উইকেট।
এর মধ্যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে রান তাড়ায় খেলেছেন রেকর্ড ২০১ রানের অপরাজিত ইনিংস। তার আগে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ৪০ বলে সেঞ্চুরি করে গড়েছেন বিশ্বকাপের দ্রুততম শতকের রেকর্ডও।
- রবীন্দ্র জাদেজা – ভারত
বল হাতে ১৬ উইকেট, সাথে ৪০ গড়ে ১২০ রান করেছেন রবীন্দ্র জাদেজা। তাতেই দুটি রেকর্ড গড়েছেন ভারতের এই অলরাউন্ডার। ভারতীয় স্পিনার হিসেবে এক আসরে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড এখন তাঁর।
তাছাড়া রাউন্ড রবিন লিগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। যুবরাজ সিংয়ের পর যা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাত্র দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি।
- অ্যাডাম জাম্পা – অস্ট্রেলিয়া
এবারের বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৩ উইকেট নিয়েছেন এই লেগস্পিনার। টুর্নামেন্টের শুরুতে তেমন ছন্দে না থাকলেও, ছন্দে ফিরে আসতে সময় নেননি। শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে টানা ৩ ম্যাচে নেন ৪টি করে উইকেট।
এ ছাড়া সিংহভাগ ম্যাচেই প্রতিপক্ষকে চেপে ধরে রেখেছেন মিতব্যায়ী বোলিংয় দিয়ে। রাউন্ড রবিন লিগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার।
- মোহাম্মদ শামি – ভারত
এবারের বিশ্বকাপে শুরুর ৪ ম্যাচে ভারতের একাদশে জায়গাই হয়নি মোহাম্মদ শামি। তবে যখন ফিরেছেন, তখন রীতিমত প্রতিপক্ষের উপর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন। ৭ ম্যাচে ২৪ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী বোলারও হচ্ছেন তিনি।
শুরুটা করেছিলেন ফাইফার দিয়ে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫৪ রানে ৫ উইকেট। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচেও পান ফাইফারের স্বাদ। ১৮ রানে নেন ৫ উইকেট। আর সেমিফাইনালে এসে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৭ উইকেট নিয়ে তো বিশ্বকাপের নকআউট পর্বের ইতিহাসেই সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড গড়েছেন এ পেসার।
- জাসপ্রিত বুমরাহ – ভারত
রান প্রসবার বিশ্বকাপে মাত্র ৪.০৬ ইকোনমি রেটে বোলিং করেছেন জাসপ্রিত বুমরাহ। এর পাশাপাশি নিজের ঝুলিতে যোগ করেছেন ২০ টি উইকেট। ভারতকে ফাইনালে তুলতে রয়েছে এ পেসারের রয়েছে দারুণ অবদান।
এমনকি ফাইনালেও অজিদের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিলেন বুমরাহ। মিশেল মার্শ ও স্টিভেন স্মিথের উইকেট নিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে কোণঠাঁসা করে দিয়েছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত আর হয়ে ওঠেনি। হেড বীরত্বের কাছে হার মানে ভারত।
- জশ হ্যাজলউড – অস্ট্রেলিয়া
এবারের বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার পেসারদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৬ উইকেট পেয়েছেন হ্যাজলউড। অজি এই পেসারের চেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছেন অনেকেই। তবে প্রায় প্রতি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে নতুন বলে ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছেন তিনিই।
এ ছাড়া মাত্র ৪.৮৫ ইকোনমিতে বল করেছেন তিনি। যা প্রতিপক্ষের রান বেঁধে রাখতে অজি বোলিং লাইন আপে দারুণ শক্তি জুগিয়েছে।
- রাচিন রবীন্দ্র (দ্বাদশ সদস্য) – নিউজিল্যান্ড
ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপটাই রাঙিয়েছেন রাচিন রবীন্দ্র। ৬৪.২২ গড়ে ৫৭৮ রান করেছেন এ ব্যাটার। যার মধ্যে শতই ছিল ৩ টা। যা নিউজিল্যান্ডের হয়ে এক আসরে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির আবার নতুন রেকর্ড।
এ ছাড়া অভিষেক বিশ্বকাপে রাচিনের চেয়ে বেশি রান করার রেকর্ড নেই আর কারো ব্যাটারের। এ ছাড়া বয়স ২৫ হওয়ার আগে বিশ্বকাপ খেলতে নেমে শচীনের গড়া সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটাও এখন রাচিনের দখলে।