এক স্প্যানিশ বাজপাখি

সেভিয়ার বিপক্ষে দ্বিতীয়ার্ধের ম্যাচ চলছে লস ব্ল্যাঙ্কোসদের। ডি বক্সের বাম দিক থেকে বল বাড়িয়ে দেয়া হল সেভিয়ার উইং ফরোয়ার্ড দিয়েগো পেরোত্তির দিকে। সামনে ফাঁকা পোস্ট। গোল বাঁচাতে হলে দ্রুত গোলপোস্টের অন্য প্রান্তে যেতে হবে গোলরক্ষককে। আর সে কাজটিই তিনি করলেন অবলীলায়।

পুরো ম্যাচে প্রতিপক্ষের এমন আরও কয়েকটি শট দারুণ ক্ষিপ্রতার সাথে ঠেকিয়ে দিলেন তিনি। ম্যাচ শেষে ইংলিশ কিংবদন্তি গোলরক্ষক গর্ডন ব্যাঙ্কস তাঁর গোলকিপিংয়ের দক্ষতার প্রশংসা করে বলেন, ‘যদি এভাবে খেলতে থাকেন, তাহলে ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক হয়ে উঠতে পারবেন তিনি।’

গর্ডন ব্যাঙ্কসের করা সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি করে কিংবদন্তি হয়ে ওঠা এ গোলরক্ষক- ইকার ক্যাসিয়াস ফার্নান্দেজ। স্প্যানিশ ফুটবল ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে নিজের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করা এই গোলরক্ষকের ঝুলিতে জমা পড়েনি এমন ট্রফির খোঁজ পাওয়া দুষ্কর ব্যাপার। ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর- উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে শুরু করে জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ ট্রফি জয়- ২১ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ারে ধরতে গেলে বাদ পড়েনি কিছুই!

মাত্র ৯ বছর বয়সে ক্যাসিয়াস ক্লাব ফুটবলে তাঁর প্রিয় দল রিয়াল মাদ্রিদের একাডেমী দলে যোগ দেন । তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে পরিণত করে ১৯৯৯ সালে রিয়ালের মূল দলে ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেন অ্যাতলেটিকো বিলবাওয়ের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। আর সেই ম্যাচের তিন দিন পর ডাক পড়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে অলিম্পিয়াকোসের বিপক্ষে ম্যাচের একাদশে।

তারপর প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে ধীরে ধীরে জায়গা করে নেন স্পেনের মূল দলে। ২০০০ সালে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তিনি প্রথম ম্যাচ খেলেন সুইডেনের বিপক্ষে, যে ম্যাচটি ড্র হয় ১-১ গোলে। আর পরের ম্যাচে লুক্সেমবার্গের  বিপক্ষে স্পেনের ১-০ গোলের জয়ে অবদান রাখেন তিনি।

গোলরক্ষক হিসেবে ক্যাসিয়াসের খ্যাতি অর্জনের নেপথ্যে ছিল তাঁর আক্রমণাত্মক মানসিকতা। ওয়ান অন ওয়ান পরিস্থিতিতে অসাধারণ দক্ষতায় বল ঠেকিয়ে দেওয়ার কারণে প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতেন তিনি। স্ট্রাইকারদের নেয়া শট দুর্দান্ত ক্ষিপ্রতার সাথে ঠেকিয়ে দেয়ার দক্ষতার জন্য স্প্যানিশ ভাষায় তাঁর নাম হয়ে যায়-‘স্যান ইকার’। গোলকিপিংয়ের অসাধারণ দক্ষতার কারণে গত তিন দশকের তো বটেই, অনেকের চোখে সর্বকালেরও সেরা গোলরক্ষকদের অন্যতম হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাঁকে।

রিয়ালের জার্সি গায়ে ক্যাসিয়াস মাঠ মাতিয়েছিলেন দীর্ঘ ১৬ বছর। অভিষেকের পর থেকে ক্যাসিয়াস রিয়ালের হয়ে ৭২৫ টি ম্যাচ খেলেন। পেশাদার ফুটবলে তিনি প্রথম ট্রফি জেতেন ১৯৯৯/০০ মৌসুমে। ঐ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে ফাইনালে ভ্যালেন্সিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় লস ব্ল্যাঙ্কোসরা। সে আসরে ১২টি ম্যাচে কোচ ভিসেন্তে দেল বস্কের একাদশে জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ২০০১/০২ ও ২০১৩/১৪ মৌসুমে আরও দুইবার রিয়ালের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের শিরোপা জেতার স্বাদ নেন ক্যাসিয়াস। এর মধ্যে ২০১৩/১৪ মৌসুমে রিয়ালের নেতৃত্ব দেন তিনি।

শুধুমাত্র চ্যাম্পিয়নস লিগই নয়, রিয়ালের হয়ে ক্যাসিয়াস তাঁর ঝুলিতে জমা  করেছেন ৫টি ‘লা লিগা চ্যাম্পিয়ন’ খেতাব, ৪টি স্প্যানিশ সুপার কাপের ট্রফি, ৩টি করে ক্লাব বিশ্বকাপ ও ইউরোপিয়ান কাপের ট্রফি এবং ২টি করে কোপা দেল রে, ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ ও ইউরোপিয়ান সুপার কাপের ট্রফি। দলগত রেকর্ডের পাশাপাশি ব্যক্তিগত রেকর্ডেও তিনি ছিলেন সমৃদ্ধ।

চ্যাম্পিয়নস লিগে সর্বাধিক ক্লিন শিটের রেকর্ড এখনও পর্যন্ত তাঁর দখলে। ১৭৭ ম্যাচের ৫৯টিতে ক্লিন শিট রেখে এ রেকর্ড গড়েন তিনি। ২০০৮, ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালের ব্যালন ডি অর পুরস্কারের তালিকায় শীর্ষ  দশে ছিলেন তিনি। ২০০৭ থেকে ২০১২ পর্যন্ত টানা ছয় মৌসুমে উয়েফার বর্ষসেরা দলে জায়গা পান তিনি।  তাঁর পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দলে ভেড়াতে বিভিন্ন লিগের বিভিন্ন দল থেকে অনেক প্রস্তাব আসতে থাকলেও ক্লাব কর্তৃপক্ষ নাকচ করে দিয়েছিল প্রতিবার।

ক্যাসিয়াস স্পেনের জার্সি গায়েও ছিলেন অনবদ্য। স্পেনের সর্বাধিক ক্লিন শিটের মালিক তিনি। তাঁর অধিনায়কত্বে ২০০৮ ও ২০১২ সালে ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয় স্পেন। আর ২০১০ সালে স্পেন প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ট্রফিও জিতে তাঁর অধিনায়কত্বে। ঐ আসরে শ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক হিসেবে গোল্ডেন গ্লাভসের পুরস্কার ওঠে তাঁর হাতে।

জাতীয় দলে অন্তর্ভুক্তির আগেও অবশ্য একাধিকবার শিরোপার স্বাদ পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৭ সালে স্পেনের অনূর্ধ্ব- ১৬ দলের হয়ে ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ নেন। আর দুই বছর পর অনূর্ধ্ব- ২০ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে স্পেন। ক্যাসিয়াস স্পেনের হয়ে দ্বিতীয় সর্বাধিক ১৬৭ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন। এ তালিকায় তাঁর ওপরে আছেন শুধুমাত্র সার্জিও রামোস।

২০১৫ সালে রিয়াল ছেড়ে পর্তুগিজ ক্লাব পোর্তোতে যোগ দেন ক্যাসিয়াস। নতুন গন্তব্যে এসে চার মৌসুম খেলেন তিনি। এর মধ্যে ২০১৭/১৮ মৌসুমে পোর্তোর হয়ে লিগ শিরোপা জেতেন। ২০১৯ সাল পর্যন্ত সেখানেই নিজের ফুটবল ক্যারিয়ার চালিয়ে যান তিনি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০২০ সালে ফুটবলকে বিদায় জানান তিনি।

ফুটবলের প্রতি গভীর আগ্রহ, কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় তাঁকে নিয়ে গিয়েছে কিংবদন্তিদের কাতারে। অসাধারণ ব্যক্তিত্বের কারণে অন্যান্য কিংবদন্তিদের কাছ থেকেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি।  ইতালির সাবেক ও জুভেন্টাসের বর্তমান গোলরক্ষক  জিয়ানলুইজি বুফনের মতে, ‘খারাপ পরিস্থিতিতেও নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত রাখার ব্যক্তিত্বের জন্য আমি তাঁকে অনেক সম্মান করি।’

বার্সা সুপারস্টার লিওনেল মেসির মতে, ‘ইকার লা লিগায় শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের একজন হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রায় সব কিছু অর্জনের জন্যই কিংবদন্তির তকমা পেয়েছে।’

ক্যাসিয়াসের সমসাময়িক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত বেশ ভালোভাবে টিকে আছেন জার্মান গোলরক্ষক ম্যানুয়েল নয়্যার। আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে গোলপোস্ট সামলানোর কাজটি ভালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মনস্তাত্ত্বিক দিক ও খেলার ধরনের দিক দিয়ে ক্যাসিয়াসের সাথে কিছুটা মিল পাওয়া যায় তাঁর। কারও কারও মতে, ক্যাসিয়াসের চেয়ে অধিক কার্যকরী ভূমিকা রাখেন ম্যানুয়েল নয়্যার। সাবেক ডেনিশ গোলরক্ষক পিটার স্মাইকেল তো একবার বলেই দিয়েছিলেন, ‘ক্যাসিয়াসের শীর্ষস্থানটি বেশ ভালোভাবেই নিয়ে নিয়েছেন নয়্যার।’

তবে যা-ই হোক, উদীয়মান গোলরক্ষকদের জন্য আদর্শ হিসেবে যদি কাউকে বিবেচনা করতে হয়, তবে সে জায়গায় ইকার ক্যাসিয়াসকে রাখা যায় চোখ বন্ধ করেই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link