সে এক বিরল কীর্তির ক্লাব

ফিফা বিশ্বকাপ, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং ব্যালন ডি’অর - শ্রেষ্ঠত্বের এইসব স্বীকৃতি পেতে যেমন প্রয়োজন পারফরম্যান্সের তেমনি কিছুটা ভাগ্যেরও প্রয়োজন বটে।

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল, আর এই ফুটবলের সবচেয়ে কাঙ্খিত অর্জন ফিফা বিশ্বকাপ। যেকোনো ফুটবলারের জন্য এটিই সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ট্রফি। তবে বিশ্বকাপ তো আসে চার বছর পর পর, বাকিটা সময়জুড়ে চলতে থাকা ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিরোপা কিন্তু ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ না। বরং উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগকেই শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হিসেবেই মানা হয় এক্ষেত্রে।

দলীয় অর্জনে পাশাপাশি ফুটবলে আছে ব্যক্তিগত স্বীকৃতিও। ব্যালন ডি-অর, ফিফা দ্য বেস্টসহ কতশত পুরষ্কার রয়েছে ফুটবলারদের জন্য। তবে সবচেয়ে সেরা নি:সন্দেহে ফরাসি ম্যগাজিন কতৃক প্রদত্ত ব্যালন ডি-অর।

ফিফা বিশ্বকাপ, উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং ব্যালন ডি’অর – শ্রেষ্ঠত্বের এইসব স্বীকৃতি পেতে যেমন প্রয়োজন পারফরম্যান্সের তেমনি কিছুটা ভাগ্যেরও প্রয়োজন বটে। কিন্তু কেমন হবে যদি কেউ নিজের ক্যারিয়ারে তিনটিই মাইলফলক ছোঁয়ার অনন্য কীর্তি গড়তে পারেন। অসম্ভব প্রতিভার পাশাপাশি ভাগ্যবান এমন তারকা’র সংখ্যা মাত্র আটজন। আর তাদের নিয়েই আজকের আলোচনা।

  • ববি চার্লটন (ইংল্যান্ড, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)

ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ফুটবলার মানা হয় স্যার বব চার্লটনকে। একইসাথে বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং ব্যালন ডি-অর জেতা প্রথম খেলোয়াড় এই ইংলিশ কিংবদন্তি। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে সোনালী ট্রফি জয়ের স্বাদ পান চার্লটন৷

বিশ্বজয়ে তার অবদানের পুরষ্কার স্বরূপ সেবছরই তিনি জিতেছিলেন মর্যাদার ব্যালন ডি-অর। এর দুইবছর পর রেড ডেভিলদের হয়ে ইউরোপিয়ান কাপ অর্থাৎ আজকের উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগের চ্যাম্পিয়ন হন বব চার্লটন। সাধারণত প্লে-মেকার এবং ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলতেন এই ইউনাইটেড তারকা। নিজের ক্যারিয়ারে সবমিলিয়ে ৯১৩ ম্যাচে ৩০৯ গোল করেছেন তিনি।

  • জার্ড মুলার (জার্মানি, বায়ার্ন মিউনিখ)

বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি গোল করা ফুটবলারদের মধ্যে অন্যতম জার্মানির জার্ড মুলার। ফুটবল ইতিহাসে অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার ভাবা হয় তাকে। ১৯৭০ সালে নিজের অনবদ্য পারফরম্যান্সের ফলে সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ব্যালন ডি-অর জিতেছিলেন জার্ড মুলার।

এরপর ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানির হয়ে বিশ্বজয় করেন তিনি। আবার ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত টানা তিনটি ইউরোপিয়ান কাপ নিজের অর্জনের খাতায় যোগ করেন বায়ার্ন সুপারস্টার। সবমিলিয়ে নিজের ক্যারিয়ারে ১৬টি মেজর ট্রফি জিতেছেন সর্বমোট ৭২২ গোল করা এই স্ট্রাইকার।

  • ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার (জার্মানি, বায়ার্ন মিউনিখ)

ক্লাব এবং জাতীয় দলে জার্ড মুলারের সতীর্থ ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার-ও আছেন এই সংক্ষিপ্ত তালিকায়৷ এবং এই অনন্য ক্লাবের একমাত্র ডিফেন্ডার তিনি। ১৯৭২ এবং ১৯৭৪ সালে দুইবার ব্যালন ডি-অর জিতেছিলেন এই আইকনিক সেন্টারব্যাক।

এছাড়া ১৯৭৪ সালে জার্ড মুলারের সাথে একইসঙ্গে বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছিলেন। এমনকি ক্লাবে এই দুই কিংবদন্তি একইসঙ্গে ১৯৭৪, ১৯৭৫ এবং ১৯৭৬ সালে ইউরোপিয়ান কাপ জেতার আনন্দে সামিল হয়েছিলেন। সব মিলিয়ে নিজের স্মরনীয় এক ক্যারিয়ারে বিশটি শিরোপা জিতেছেন বেকেনবাওয়ার, তাছাড়া ডিফেন্ডার হয়েও ১১২টি গোল আছে তার নামের পাশে।

  • পাওলো রসি (ইতালি, জুভেন্টাস)

আজ্জুরি তারকা পাওলো রসি’র নাম শুনে নি এমন ফুটবল ভক্ত বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। ১৯৮২ সাল একেবারে পয়মন্ত হয়ে এসেছিল এই ফরোয়ার্ডের জন্য। সেবার স্পেনে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়নের ট্রফি জেতার পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন রসি।

এছাড়া সবচেয়ে বেশি গোলও করেছিলেন জুভেন্টাস তারকা। বিশ্বকাপে এমন ঈর্ষনীয় পারফরম্যান্সের পর সেবছরই ব্যালন ডি-অর পুরষ্কার জিতে নেন পাওলো রসি। আর এর তিন বছর জুভেন্টাসের হয়ে ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছিলেন এই ইতালিয়ান ফুটবলার।

  • জিনেদিন জিদান (ফ্রান্স, রিয়াল মাদ্রিদ)

রিয়াল মাদ্রিদের একমাত্র ফুটবলার হিসেবে এই তালিকায় আছেন সর্বকালের সেরা মিডফিল্ডারদের একজন জিনেদিন জিদান। জুভেন্টাস, মাদ্রিদের মত বড় ক্লাবগুলোতে খেলা জিদান নিজেও ছিলেন বড়মাপের খেলোয়াড়। ১৯৯৮ সালে সামনে থেকেই পারফর্ম করে নিজ দেশ ফ্রান্সকে বিশ্বকাপের স্বাদ এনে দিয়েছিলেন জিজু।

একইবছর ব্যালন ডি-অরের পুরষ্কারও উঠেছিল তার হাতে। প্রায় বছর চারেক পর ২০০২ সালে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছিলেন ফরাসি সুপারস্টার। সেই আসরের ফাইনালে করা জিদানের গোলটি এখন পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ইতিহাসের সেরা গোল বটে।

এছাড়া নিজের ক্যারিয়ারে ১৫ টির মত ট্রফি জেতা এই কিংবদন্তি কোচ হিসেবেও বেশ সফল হয়েছেন৷ রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে টানা তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার বিরল কীর্তির অধিকারী তিনি।

  • রিভালদো (ব্রাজিল, এসি মিলান)

ফুটবলের বিশেষ কোন কীর্তির তালিকা করা হবে আর সেখানে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার থাকবেন না তা কখনো হয় না। এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি, অসাধারণ কীর্তি গড়া খেলোয়াড়দের নিয়ে তৈরী তালিকায় ব্রাজিলিয়ান হিসেবে প্রথম  জায়গা পেয়েছেন রিভালদো।

১৯৯৯ সালেই ব্যালন ডি-অর জিতে নিয়েছিলেন রিভালদো, এরপর ২০০২ সালে রোনালদো এবং রোনালদিনহকে সাথে নিয়ে বিশ্বকাপ জিতে নেন তিনি। এর পরের মৌসুমেই এসি মিলানের হয়ে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি

  • রোনালদিনহো (ব্রাজিল, বার্সেলোনা)

রিভালদোর পর দ্বিতীয় ব্রাজিলিয়ান হিসেবে সংক্ষিপ্ত এই তালিকায় যোগ দিয়েছেন রোনালদিনহো। ২০০২ সালে রিভালদোর সতীর্থ হিসেবেই বিশ্বকাপ ট্রফিতে চুমু খেয়েছিলেন দিনহো। এছাড়া ২০০৫ বার্সেলোনার খেলোয়াড় হিসেবে থাকাকালীন ব্যালন ডি-অর পুরষ্কার জিতেছিলেন সদা হাসিখুশি থাকা এই তারকা।

আর এর পরের বছরেই কাতালান ক্লাবটির জার্সিতেই উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের উল্লাসে মাতেন তিনি। মনোমুগ্ধকর ড্রিবলিং আর সৃজনশীলতা প্রদর্শন করা রোনালদিনহো অবশ্য ১৫ বার মেজর কোন শিরোপা উৎসবে অংশ নিয়েছিলেন।

  • রিকার্ডো কাকা (ব্রাজিল, এসি মিলান)

বিশ্বকাপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ আর ব্যালন ডি-অর জিতে এই ব্যতিক্রমী তালিকায় সর্বশেষ জায়গা করে নিয়েছিলেন সাবেক ব্রাজিলিয়ান ফুটবল। যদিও ২০০২ বিশ্বকাপে খেলেতে  কখনো মাঠে নামা হয়নি কাকার তবু বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন তিনি।

এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছরের বিরতি কারিয়ে ২০০৭ সালে উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং পরবর্তী মৌসুমেই ব্যালন ডি-অর পুরষ্কার নিজের করে নিয়েছেন সাবেক রিয়াল খেলোয়াড়।

বর্তমানে খেলছেন এমন ফুটবলারদের মাঝে ব্যালন ডি-অর এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতা খেলোয়াড় শুধু ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসি এবং লুকা মদ্রিচ। এদের তিনজনের সামনেই এবার কাতারে সুযোগ থাকবে বিশ্বকাপ জয়ের মধ্য দিয়ে এই তালিকায় জায়গা করে নিতে। তারা কি আসলেই পারবেন নাকি নতুন সদস্যদের জন্য অপেক্ষা আরো বাড়বে – সেইসব প্রশ্ন তোলা থাক ভবিষ্যতের জন্য।

 

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...