একটি ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ শিরোপা

আইসিসি র‍্যাংকিং এর সেরা আট দল নিয়ে ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে মাঠে গড়ালো আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। তালিকার শেষ দল হিসেবে সেই আসরে জায়গা করে নিয়েছিল পাকিস্তান। অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদের নেতৃত্বে এক অবাক কান্ড করে বসলো দ্য আনপ্রেডিক্টেবল পাকিস্তান। সরফরাজ নিজেও বোধহয় ভাবেননি তাঁর হাত ধরে এমন একটা সাফল্যের দেখা পাবে পাকিস্তান।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেই আসরের সবচেয়ে ফেবারিট দল ছিল ইংল্যান্ড। ঘরের মাঠের সুবিধার পাশাপাশি দারুণ একটি দল সাজিয়েছিল দেশটি। এছাড়া ভারত, অস্ট্রেলিয়াও বেশ ভালো ভাবেই ছিল চ্যাম্পিয়ন হবার দৌড়ে। আবার পেস বোলিং কন্ডিশনে নিউজিল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকাকেও এগিয়ে রেখেছিল কেউ কেউ।

এমনকি মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে ক্রিকেট বিশ্বের নতুন পরাশক্তি হয়ে ওঠা বাংলাদেশকেও ছোট করে দেখার উপায় ছিল না। তবে র‍্যাংকিং এর আট নম্বর দলটার হাতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা বোধহয় কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। সেই স্বপ্নকেই সত্যি করেছিল সরফরাজের নেতৃত্বে এক ঝাঁক তরুণ।

সরফরাজের সেই দলে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ছিলেন শুধু ওয়াহাব রিয়াজ, শোয়েব মালিক ও মোহাম্মদ হাফিজ। এছাড়া  তরুণ বাবর আজম কিংবা হাসান আলীদের নিয়েই ইংল্যান্ড যাত্রা করেছিল পাকিস্তান। প্রথম ম্যাচেই বিশাল এক ধাক্কা খায় দলটি। ভারতের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই ১২৪ রানের বিশাল পরাজয় দেখে দলটি। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিদের ব্যাটে চড়ে ৩১৯ রানের বিশাল সংগ্রহ জড়ো করে ভারত। বিপরীতে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৬৪ রানেই গুটিয়ে যায় পাকিস্তান।

তবে এতেই যেন বিপদ থামেনি পাকিস্তানের। অভিজ্ঞ ওয়াহাব রিয়াজ প্রথম ম্যাচেই ইনজুরির কারণে ছিটকে যান টুর্নামেন্ট থেকে। তবে মোহম্মদ আমির, হাসান আলীদের পেস বোলিং এ ভরসা রেখেই সামনে এগিয়ে যায় পাকিস্তান। গ্রুপ পর্বের পরের দুই ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দেয় হাসান আলীরা। সাথে টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালেও জায়গা করে নেয় পাকিস্তান।

যত ম্যাচ যাচ্ছিল পাকিস্তান যেন টুর্নামেন্টে তত পরিণত হয়ে উঠছিল। তবুও সেমিফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছানোর পথটা একেবারেই সহজ ছিল না। তবে হাসান আলী, ইমাদ ওয়াসিমদের নিয়ন্ত্রিত বোলিং এ মাত্র ২১১ রানেই গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড। যদিও শুরুটা ভালোই করেছিলেন জনি বেয়ারস্টো।

তবে, হাসান আলী ৪৩ রানেই ফিরিয়ে দেন এই ব্যাটসম্যানকে। এরপর হাসান আলি ইয়োন মর্গ্যান ও বেন স্টোকসের উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডের ব্যাটিং লাইন আপকে আর দাঁড়াতে দেননি। ফলে সহজেই ২১১ রানের লক্ষ্য টপকে ফাইনালে পৌঁছায় পাকিস্তান।

একটা আন্ডারডগ দল হিসেবে খেলতে এসে টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলে ফেলল দলটি। তবুও ফাইনালের আগের রাতে অধিকাংশ ক্রিকেট বোদ্ধার বাজি ছিল ভারত। বিরাট কোহলি, ধোনি, রোহিত শর্মাদের দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যে সত্যিই কঠিন। এছাড়া টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচে ভারতের কাছে হারের ক্ষত তো ছিলই।

তবে সেই হারের প্রতিশোধ নিতেই যেন সেদিন মাঠে নেমেছিল পাকিস্তান। আজহার আলী ও ফখর জামানের ব্যাটে দুরন্ত শুরু করে দলটি। ফখরের ১০৬ বলে ১১৪ রানের ইনিংসে ভর করে ৩৩৮ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করায়  দলটি। আগের ম্যাচের নায়ক রোহিত শর্মাকে এবার শূন্য রানেই ফিরিয়ে দেন মোহাম্মদ আমির। এরপর হাসান আলী ধোনির উইকেট নিয়ে ভারতের সব আশা ধুলোয় মিশিয়ে দেন। হার্দিক পান্ডিয়া চেষ্টা করেছিলেন, তবে তাতে ভারতের শেষ রক্ষা হয়নি। ১৫৮ রানেই অল আউট হয়ে যায় ভারত।

শেষ অবধি নায়ক বনে যান সেই আমিরই। ইমরান খান ও মোহাম্মদ ইউনুসের পর তৃতীয় পাকিস্তানি অধিনায়ক হিসেবে আইসিসি ইভেন্টের শিরোপা জিতে নেন সরফরাজ আহমেদ। পাকিস্তানেরও সবগুলো আইসিসি ইভেন্ট জয়ের চক্রপূরণ হয়।

হাসান আলী আসরের তাঁর ১৩ তম উইকেট হিসেবে ফেরান জাসপ্রিত বুমরাহকে। আরো একবার বিশ্ব জয়ের আনন্দে মাতে গোটা পাকিস্তান। ক্রিকেট আরেকবার হাসলো তাঁর আনপ্রেডিক্টেবল সন্তানের কাণ্ড দেখে। ইমরান খানের উত্তরসূরিরা আরেকবার জানান দিয়ে গেল তাঁদের ক্রিকেট স্বত্বা। ক্রিকেট বিশ্ব আরেকবার বুঝলো; বিশ্বের যেকোনো কন্ডিশনে, যেকোনো টুর্নামেন্টে পাকিস্তান কিছু একটা ঘটিয়ে দিতে পারে।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link