পার্মা ও পার্মাল্যাট কেলেঙ্কারি

মিশরের মস্তবড় সব পিরামিডগুলো নিশ্চয়ই বিস্ময়কর। একপ্রান্ত থেকে শুরু হয়ে ক্রমশ চড়াই পেরিয় একেবারে আকাশচুম্বী উচ্চতায় শীর্ষস্থান। আবার সেখান থেকে ঢাল বেয়ে নেমে একেবারে সমতলে মিলিয়ে যাওয়া। বিস্ময়টা এখানে নয়। বিস্ময়টা এর পেছনের কারিগর আর ইঞ্জিনিয়ারিংকে ঘিরে। এমন এক বিস্ময়কর জালিয়াতি ইতালিয়ান ফুটবল ক্লাব পার্মাকে বানিয়েছে অবিকল এক পিরামিড।

এই গল্পের শুরুটা একটা পরিবার থেকে। ইতালির শহর পার্মার একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পার্মাল্যাট রয়েছে এসি পার্মা থেকে পার্মা এফসি হওয়ার পেছনের অনুঘটক হিসেবে। গল্পের ট্রাজিক হিরো ২২ বছর বয়সী ক্যালিস্তো তানজি অথবা পার্মা এফসি। তানজি যখন ২২ বছরের তরুণ ঠিক তখন তাঁর উপর এসে যায় গুরুদায়িত্ব। তাঁর বাবার মৃত্যুতে পারিবারিক ব্যবসার সব দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে।

তিনি সে দায়িত্ব সামলে নেন। নিজের সাথে সাথে ইতালির অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেন নিজের বাবার ফেলে যাওয়া প্রতিষ্ঠানকে। ৪০ বছর সময়ের মধ্যে তিনি পারিবারিক একটা ছোট্ট ব্যবসাকে পরিণত করেন বিশ্বের অন্যতম সুবিশাল ডেইরি কোম্পানিতে। ৮০-৯০ দশক জুড়ে তাঁর কোম্পানি পার্মাল্যাট শাখা-প্রশাখা বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। ইতালির বাণিজ্যিক খাতে একটা রোল মডেলে পরিণত হয় তানজির প্রতিষ্ঠান।

উন্নতির শিকড় ধরে কেবল উপরের দিকেই উঠতে শুরু করেন তিনি। তানজি এবং তাঁর পরিবার তাঁদের নিজেদের কল্পনাতীত ধনী পরিবারে পরিণত হয়। তবে সবটাই ছিল এক মিথ্যের উপর ভিত্তি করে। সবটাই যেন ছিল একটা মরীচিকা। তবে ফুটবলের প্রতি তানজির প্রেম কোন অংশেই ছিল না মরীচিকা। ফুটবল সবসময় তাঁর প্রচণ্ড পছন্দের এবং ভালবাসার এক জায়গা।

তাই তিনি ১৯৯১ সালের দিকে সিদ্ধান্ত নিলেন একটি ফুটবল ক্লাব ক্রয় করবেন। ফুটবল প্রীতি ছাড়াও, ইতালিতে একতা কথার বেশ প্রচলন ছিল, আপনি যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা ফুটবল ক্লাবের মালিক হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি বড় কিছু করে ফেলেছেন ভাবা হবে না। সে চিন্তা থেকেই ফুটবল ক্লাব ক্রয়ের পরিকল্পনা হাতে নেন তানজি। আর নিজের ঘরের ক্লাব কেনার চাইতে বেশি কিছু কিই বা হতে পারে?

কিন্তু সে সময় পার্মা কোন বড় ক্লাব ছিল না। হ্যাঁ, একটা ঐতিহাসিক ক্লাব হিসেবে বিবেচনা করাই যেতে পারত। তবে ফুটবল মাঠের খুব বেশি শক্তিশালী কোন ক্লাব ছিল না পার্মা। তানজি যখন ক্লাবটি নিজের করে নেন তখন সিরি সি আর সিরি বি এর মাঝেই পেন্ডুলামের মত করে বিচরণ করত এসি পার্মা।

তবুও তিনি ক্লাবটির মালিকানা নিজের করে নিলেন। কেননা ক্লাবের তখনকার মালিকের হঠাৎ মৃত্যুতে একেবারে অভিভাবক শূন্য হয়ে যায়। ঠিক সে মুহূর্তে ক্লাবের একটা বড় অংশের শেয়ার কিনে নেন। আর ঠিক ১৯৯২ সালেই ক্লাবটি নিজেদের প্রথম বড় ট্রফি জয় করে তাও আবার জুভেন্টাসকে হারিয়ে। কোপা ইতালিয়া জেতার পাশাপাশি ইউরোপিয়ান সুপার কাপটাও নিজেদের করে নিয়েছিল ক্লাবটি।

তানজি ক্লাবটিকে ইউরোপের সেরা ক্লাব বানাতে একেবারে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। তিনি প্রচুর অর্থ খরচ করছিলেন ক্লাবটিকে পরাশক্তিতে পরিণত করতে কোন কমতি রাখেননি। সে সময়ের তারকা ফুটবলারদের ক্লাবে নিয়ে আসার সব প্রচেষ্টাই করেন তিনি। নিয়েও আসেন ফ্যাবিও ক্যানভেরো, হার্নান ক্রেসপোদের মত তারকা খেলোয়াড়দের নিয়ে আসতে শুরু করেন।

অন্যদিকে ক্লাবের অ্যাকাডেমিও সমানতালে চলতে থাকে। সেখান থেকেও পরবর্তী সময়ে ফুটবলের মহাতারকাদের আগমন ঘটেছে। জিয়ানলুজি বুফন পার্মার অ্যাকাডেমি থেকেই উঠে এসেছেন। ১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মত উয়েফা কাপ জেতে পার্মা জুভেন্টাসকে হারিয়ে। এরপরের মৌসুম তাঁরা সিরি ‘এ’ শেষ করে দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে। তানজির অধীনে একের পর এক সাফল্য এসে ধরা দিতে থাকে। এরপর আবারও কোপা ইতালিয়া কাপ ও উয়েফা কাপ জয় করে পার্মা।

ছোট ক্লাবগুলো খুব ভাল পারফরম করতে শুরু করলে বড় ক্লাবগুলোর একটা নজর পড়ে। সে নজরটা অবশ্য ক্লাবের ভাল খেলোয়াড়দের উপরই বেশি পড়ে। এর ব্যতিক্রম হল না পার্মার ক্ষেত্রেও। ক্রমশ দলের সেরা তারকারা এক এক করে দল ছাড়তে শুরু করেন। পিরামিডের চূড়া থেকে ঢাল ততক্ষণে ধরতে শুরু করে ক্লাবটি। ২০০৩ সালের দিকে ক্লাবটির অর্থের জোগানদাতা কোম্পানিকে ঘিরে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠানটি নাকি রয়েছে বিশাল অঙ্কের ঋণের বোঝা বইছে।

ক্রমশ তা নিয়ে জল ঘোলা হতে থাকে। একে একে ক্যালিস্তো তানজির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আসতে শুরু করে। অধিকাংশই প্রতারণার। জালিয়াতি করেই তিনি নিজেকে করেছেন প্রতিষ্ঠিত। প্রথম দিকে ৩.৯ বিলিয়ন ইউরোর হিসবের গড়মিল পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে জানা যায় সংখ্যাটি আরও বেশি। প্রতারণা আর জাতিয়াতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তানজি, তাঁর পরিবার ও কর্মচারীদের অনেককেই গ্রেফতার করা হয়।

এরপর থেকে পার্মা যেন একটু একটু করে হারিয়ে যেতে শুরু করে। নিজেদের সেই স্বল্প সময়ের সফলতা ও জৌলুশ মলিন হয়ে যায়। অন্যদিকে তানজির স্থান হয় কারাগারে। পার্মা এফসি ও তানজির সাফল্য পুরোটাই ছিল কেবল এক ধুম্রজাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link