২০১৬ সালের জুলাই মাসের কথা, ফরাসি মিডফিল্ডার পল পগবা তখন তোড়জোড় করছিলেন জুভেন্টাস ছেড়ে যাওয়ার জন্য। জুভেন্টাসের তৎকালীন কোচ মাসিমিলিয়ানো অ্যালেগ্রি অবশ্য সতর্ক করে দিয়েছিলেন৷ পগবাকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, যারাই জুভেন্টাস ছাড়তে চায় তাদের উচিত সবকিছু ভালভাবে বিবেচনা করা।
কিন্তু নিজের ম্যানেজারের কথায় খুব একটা কান দেননি পল পগবা। জুভেন্টাস ছেড়ে ১০৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে চলে আসেন সাবেক ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। তাঁর এজেন্ট মিনো রায়োলার মতে সেটি পগবার জন্য ছিল সঠিক গন্তব্য। কিন্তু পরে বোঝা যায়, ক্যারিয়ারে সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্তে অন্যতম একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পগবা আর রায়োলা।
স্যার অ্যালেক্স ফারগুসনের অবসরের পর থেকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বেশ অগোছালো হয়ে পড়ে৷ জয়ের পথে ফেরার জন্য তাই ম্যান ইউনাইটেডের ডাগ আউটে আনা হয় হোসে মরিনহোকে। কিন্তু তাঁর সাথে শিষ্য পল পগবার সম্পর্ক একেবারেই ভাল ছিল না।
কিন্তু এই অবস্থার কোন সুষ্ঠু সমাধান না করে ক্লাব ম্যানেজমেন্ট পগবার পক্ষ নেয় এবং মরিনহোকে বরখাস্ত করে দেয়। তবে পরবর্তী কোচেরাও পগবার কাছ থেকে সেরাটা বের করে আনতে ব্যর্থ হয়। ২৩ বছর বয়সে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে আসা পগবা নিজের মূল্যবান সময়গুলো অফ ফর্মের মাঝেই কাটিয়ে দেন। শেষপর্যন্ত অর্ধযুগ পর ক্যারিয়ার পুনরুদ্ধার করার জন্য সাবেক ক্লাব জুভেন্টাসে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
অবশ্য জুভেন্টাস আর অতীতে নেই। একসময় ইউরোপে দাপিয়ে বেড়ানো ক্লাবটি এখন ঘরোয়া লিগেও নড়বড়ে। গত কয়েক মৌসুমে মাঝারি মানের ক্লাবগুলোর কাছেও হেরে গিয়েছে তুরিনের বুড়িরা। মূলত মিডফিল্ড শক্তির অবনতি জুভেন্টাসের এই অধঃপতনের জন্য দায়ী। একটাসময় তাদের মধ্যমাঠে পল পগবার সাথে ছিল আন্দ্রে পিরলো, আর্তুরো ভিদাল, ক্লাউদি মার্সিসিও এর মত তারকারা।
২০১২/১৩ মৌসুমে পল পগবা যখন ফ্রি ট্রান্সফারে জুভেন্টাসে যোগ দিয়েছিলেন তখন তিনি ছিলেন প্রতিভাবান একজন। এরপর অ্যান্টনি কন্তে তাকে ঘষেমেঝে তৈরি করেছে অন্যতম সেরা হিসেবে। কন্তের মধ্যমাঠের সব ট্যাকটিক্যাল প্ল্যান করা হয়েছিল পগবাকে কেন্দ্র করে। ২০১৫ সালে আন্দ্রে পিরলোর বিদায়ের পর পগবাকে আরো দায়িত্ব দেয়া হয়া। এছাড়া নিজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য পগবার হাতে তুলে দেয়া হয় দশ নম্বর জার্সি।
ওল্ড লেডি ম্যানেজম্যান্টের পরিকল্পনা ছিল পল পগবাকে কেন্দ্র করে নতুন এক মিডফিল্ড তৈরি করবে; কিন্তু ২০১৬ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের অবিশ্বাস্য অংকের অর্থের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি কেউই। ফলে ইতালি ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে আসেন পগবা।
কিন্তু পল পগবা এবং জুভেন্টাস উভয় পক্ষের জন্য এই সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে ক্ষতির কারণ হয়। শেষ ছয় বছরে ইতালিয়ান ক্লাবটির মাঝমাঠ ছিল অস্থিতিশীল। যদিও পগবাকে বিক্রি করে ১০৫ মিলিয়ন ইউরো সঞ্চয় করেছিল জুভেন্টাস। কিন্তু তারা পগবার সঠিক বিকল্প খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়। উল্টো প্রথমে গঞ্জালো হিগুয়েন এবং পরে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে সাইন করিয়ে আক্রমণভাগ শক্ত করে তোলে; ভুলে যায় ভঙ্গুর মিডফিল্ডের কথা।
জুভেন্টাসে থাকাকালীন পল পগবার মাঠের বাইরের কার্যকলাপ নিয়ে খুব একটা বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি। সাবেক জুভেন্টাস তারকা বুফন তাকে দুর্দান্ত সতীর্থ হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। এমনকি পগবাকে বলা হয়েছে, তাঁর চুল কিংবা পোশাক কোন বিষয় নয়। মাঠে যা করবেন সেটি আসল ব্যাপার।
কিন্তু ম্যান ইউনাইটেডে ঠিক বিপরীত অবস্থার শিকার হয়েছেন এই বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলার। তাঁর মাঠের বাইরের চালচলন নিয়ে বিস্তর সমালোচনা শুরু হয়েছিল। তবে এর মূল কারণ পগবার অফ ফর্ম। মাঠে ধারাবাহিকতার অভাবের কারণেই তাঁর ফ্যাশন নিয়ে ভক্তদের মাঝে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে।
সব নাটকীয়তার অবসান ঘটিয়ে পল পগবা শেষপর্যন্ত নিজের সাদা-কালো জার্সিতে ফিরে গিয়েছেন। হয়তো ক্যারিয়ারের এই সময়টা অন্তত ভাল কিছু করার, সেরাটা দেয়ার ইচ্ছে বাস্তবায়ন করতে চাইবেন তিনি। তবে পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। পিরলো, বুফন, চিয়েলিনির মত কিংবদন্তিরা ক্লাব ছেড়েছে। এছাড়া বন্ধু পাউলো দিবালাও যোগ দিয়েছেন রোমাতে।
এই তুরিনেই একটাসময় আন্দ্রে পিরলো, ভিদালদের সাথে জুটি বাঁধা পল পগবাকে আর্থুর, র্যাবিট, ডেনিস জাকারিয়া এবং ম্যানুয়েল লোকেতেলির সাথে নিয়ে গড়তে হবে নতুন দূর্গ। বর্তমান ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মিডফিল্ডের তুলনায় জুভেন্টাসের মিডফিল্ড এগিয়ে তা বলার সুযোগ নেই।
ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আরো একবার ইতালিতে ফিরলেন পল পগবা; মাঝারি মানের জুভেন্টাস স্কোয়াড নিয়ে সেই কাজে কতটা সফল হবেন ফরাসি মিডফিল্ডার? নাকি ছয় বছর আগে যেমন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সর্বনাশ ডেকে এনেছিলেন, তেমনটিই আরেকবার ঘটবে তুরিনে – সব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আপাতত সময়ের অপেক্ষায় থাকতে হবে সমর্থকদের।