২০১৭ ইউরোতে স্বাগতিক ফ্রান্সকে হারিয়ে শিরোপা জিতে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল পর্তুগাল। প্যারিসের সেই ফাইনালে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো শুরুতেই ইনজুরির কারণে মাঠের বাইরে চলে গেলেও হাল ছাড়েনি পর্তুগাল। অতিরিক্ত সময়ে এডারের গোলে মন ভাঙে ফরাসিদের। কিন্তু পর্তুগীজদের সেই সুসময় বেশিদিন থাকেনি, বিশ্বকাপ এবং ইউরোর পরের দুই আসরেই বিদায় নিতে হয় দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই। তবে এবারের বিশ্বকাপে তারুণ্য এবং অভিজ্ঞতার মিশেলে দারুণ এক দল নিয়ে আসছে পর্তুগাল।
এবারের বিশ্বকাপে আসার পথটা মোটেই সহজ ছিল না রোনালদোদের জন্য। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে সার্বিয়ার কাছে নব্বই মিনিটের গোলে ম্যাচ হেরে প্লে অফ খেলতে হয়েছে। তবে সেখানে তুরস্ক এবং উত্তর মেসেডোনিয়াকে হারিয়ে কাতারের টিকিট পেতে সমস্যা হয়নি তাঁদের। আশ্চর্যজনক কিছু না ঘটলে তাঁদের দলের সেরা তারকা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এবং কোচ ফার্নান্দো সান্তোসের এটাই শেষ বিশ্বকাপ। দলের খেলোয়াড়রা তাই উজ্জীবিত থাকবেন তাঁদের বিদায়টা রাঙিয়ে দিতে।
পর্তুগালে গোল করার মানুষের অভাব না থাকলেও দুশ্চিন্তা রয়ে গিয়েছে গোল আটকানোর জায়গা নিয়ে। গোলবারের নিচে দাঁড়ানোর জন্য অনেকগুলো অপশন থাকলেও তাঁদের কেউই বিশ্বমানের নন। অভিজ্ঞ রুই পেট্রিসিও-ই হয়তো গোলবারের নিচে দাঁড়াবেন, কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে বেড়েছে তাঁর ভুল করার হার। পোর্তোর কিপার দিয়েগো কস্তার মাঝে বিশ্ব সেরা হবার সকল গুণাবলি থাকলেও বড় ম্যাচে খেলার অভিজ্ঞতা না থাকায় তাঁকে বসতে হবে বেঞ্চেই।
ডিফেন্সের মাঝখানে সিটির রুবেন ডিয়াসের সাথে জুটি বাঁধবেন অভিজ্ঞ পেপে। পেপের বয়স নিয়ে খানিকটা দুশ্চিন্তা থাকলেও মাঠের পারফরম্যান্সে তা বোঝার উপায় নেই। পোর্তোর হয়ে এই মৌসুমে আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। এছাড়া তাঁদের বিকল্প হিসেবে বেঞ্চে থাকবেন বেনফিকার আন্তোনিও সিলভা এবং পিএসজির ডানিলো পেরেইরা। রাইটব্যাক হিসেবে জোয়াও ক্যানসেলোর জায়গাটা রোনালদোর মত আনটাচেবল।
আক্রমণের পাশাপাশি রক্ষণ সামলাতেও দারুণ পটু এই ফুলব্যাক। তবে বাঁ প্রান্তের জায়গাটা নিয়ে ভালোই লড়াই হবে নুনো মেন্ডেজ এবং রাফায়েল গুয়েরেরোর মাঝে। দুজনেই আক্রমণাত্নক ফুলব্যাক, রক্ষণের চাইতে আক্রমণে অংশ নিতেই বেশি পছন্দ করেন। এই দুজনের মাঝে একজনকে বেছে নিতে ভালই বেগ পোহাতে হবে কোচ সান্তোসকে।
মাঝমাঠে কুশলী কাউকে খেলানোর চাইতে রক্ষণাত্নক মিডফিল্ডার খেলাতেই বেশি ভালোবাসেন পর্তুগাল কোচ। পর্তুগালের বিশ্বকাপ দলেও তাই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের ছড়াছড়ি। রুবেন নেভেস, উইলিয়াম কারভালহো, জোয়াও পালহিনহার পাশাপাশি সুযোগ পেয়েছেন পিএসজির তরুণ মিডফিল্ডার ভিটিনহা। ফর্ম এবং সামর্থ্য বিবেচনায় নেভেসের সাথে মাঝমাঠে তারই জুটি বাঁধার কথা।
এছাড়া জোয়াও মারিও এবং ওটাভিও’র মত ওয়াইড মিডফিল্ডারের অন্তর্ভুক্তি দলের বৈচিত্র্যতা এবং অপশন বাড়িয়েছে। দু:খজনক বিষয় হল পর্তুগালের ইউরো জয়ের দুই নায়ক আন্দ্রে গোমেজ এবং রেনাতো সানচেজ এবারের দলে সুযোগ পাননি। দুর্দান্ত প্রতিভাবান হিসেবে আগমণ হলেও সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির আড়ালে। তাঁরা দুজন থাকলে নিশ্চিতভাবেই আরও শক্তিশালী হত পর্তুগালের মাঝমাঠ।
বিশ্বসেরা আক্রমণভাগ নিয়ে এবারের বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছে পর্তুগাল। আক্রমণভাগের প্রতিটি পজিশনেই কোচ সান্তোসের হাতে রয়েছে একাধিক ফুটবলার। অন্য দলগুলো যেখানে গোল করার মানুষের জন্য মাথা কুটে মরছে, সেখানে পর্তুগালের গোল করার মানুষের অভাব নেই।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ছাড়াও দলে রয়েছেন বার্নাদো সিলভা, ব্রুনো ফার্নান্দেজ, রাফায়েল লিয়াও, জোয়াও ফেলিক্স, আন্দ্রে সিলভা, গনসালো রামোসদের মত তারকা ফুটবলাররা। কাকে রেখে কাকে খেলানোর মধুর এক সমস্যাতেই পড়বেন সান্তোস। তবে এত তারকা সত্ত্বেও পর্তুগীজদের আক্রমণ যে রোনালদোকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এত এত তারকা থাকা সত্ত্বেও পর্তুগালের সবচেয়ে বড় তারকা বুড়ো রোনালদোই। এই মৌসুমে খুব একটা ভাল ফর্মে না থাকলেও বিশ্বকাপে ভাল করতে মুখিয়ে থাকবেন এই তারকা। মাঠ এবং মাঠের বাইরে দু:সময় কাটানো রোনালদো যে সবকিছুর জবাব দিতে বিশ্বকাপকেই বেছে নেবেন সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও, এই রোনালদোই দলের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট। কারণ, রোনালদো থাকলে তাঁর সাথে দলের বাকিদের মানিয়ে নিতে হয়।
তবে রোনালদো ছাড়াও এই দলে আরেকজন আছেন যিনি একাই ঘুরিয়ে দিতে পারেন ম্যাচের ফলাফল। তিনি ম্যানচেস্টার সিটির মিডফিল্ডার বার্নাদো সিলভা। আক্রমণাত্নক মিডফিল্ডার কিংবা উইঙ্গার দুই পজিশনেই সমান স্বাছন্দ্যে খেলতে জানেন। গোল করার পাশাপাশি গোল করানোতেও তাই জুড়ি মেলা ভার। বিশ্বকাপের আগে রয়েছেন দারুণ ফর্মে, দুই গোল করার পাশাপাশি অবদান রেখেছেন পাঁচটি গোলে।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি পর্তুগালের এই দলে দৃশ্যমান কোনো দুর্বলতা না থাকলেও তাঁদের কোচ ফার্নান্দো সান্তোসের রক্ষণাত্নক মানসিকতাই চিন্তার কারণ। হাতে এত আক্রমণাত্নক ফুটবলার থাকা সত্ত্বেও দলকে তিনি খেলান রক্ষণাত্নক ফুটবল। তাঁর এই মানসিকতাই নক আউট পর্বে বিপদে ফেলতে পারে পর্তুগালকে।
এবারের বিশ্বকাপে ঘানা, উরুগুয়ে এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে একই গ্রুপে রয়েছে পর্তুগাল। গ্রুপ চ্যাম্পিয়নের দৌঁড়ে নিশ্চিতভাবেই তাঁদের প্রধান বাঁধা উরুগুয়েই, তাঁদের কাছে হেরেই চার বছর আগে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছিল পর্তুগাল। তবে দলের সবাই নিজেদের সেরাটা দিতে পারলে ২০০৬ বিশ্বকাপে নিজেদের সেরা সাফল্য ছাপিয়ে যেতে সমস্যা হবে না পর্তুগালের।