ইয়ান বোথাম তখন খেলা ছেড়ে দিয়েছেন। চুলে পাঁক ধরেছে। বাড়িতে এক সাংবাদিক এসেছে সাক্ষাৎকার নিতে। বোথামের ছোট্ট ছেলেটা তখন ঠিকমত কথাই বলতে পারে না। বোথাম নাকি সেদিনই বলেছিলেন, ‘লিখে রাখো, এই পিচ্চি একদিন এই বুড়োটাকে ছাড়িয়ে যাবে।
শুরুটাও তাই ছিল। হ্যাম্পশায়ারের হয়ে অভিষেকেই পাঁচ উইকেট। এর মধ্যে একজন ছিলেন স্বয়ং মাইক গ্যাটিং। আলোচনার ঝড় তুলেছিল। ব্রিটিশ মিডিয়াও স্বাভাবিক ভাবেই খুঁজে পেয়েছিল নতুন বোথামকে, যার নামও আবার বোথাম। লিয়াম বোথাম। কিন্তু, এর মাঝে কেউ খেয়াল করেনি – আকাশ সমান প্রত্যাশার চাপ জমে গিয়েছিল।
তিনি নাকি ইংল্যান্ডের সেরা অলরাউন্ডারের একজন হতে পারতেন। এমনকি ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি ইয়ান বোথামের মত অলরাউন্ডার হবার সব গুণাবলিই নাকি তাঁর মধ্যে ছিল, এই কথাগুলো বলেছেন স্বয়ং ইয়ান বোথামই। যার কথা বলা হচ্ছিল তিনি লিয়াম বোথাম। মাত্র তিনটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেই যিনি ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। না হলে হয়তো সত্যিই আরেকজন গ্রেট বোথাম পেত ইংল্যান্ডের ক্রিকেট।
ক্রিকেটের কোন মহাতারকার সন্তান হয়ে বেড়ে ওঠাটা সহজ না। তাও আবার যদি সেও বাবার মত ক্রিকেটারই হতে চায়। পুরো ক্রিকেটবিশ্ব তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। আশা করে বাবার মত সেও মহাতারকা হয়ে উঠবে। একদম ছোট বয়স থেকে এই চাপ নেয়াটা সহজ না, এই চাপটা নেয়া যায় না। তাও সেটা যদি হয় ইংল্যান্ড ক্রিকেটের গোল্ডেন বয় স্যার ইয়ান বোথাম।
ইয়ান বোথামের ছেলে লিয়াম বোথাম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭৭ সালের ২৬ আগস্ট। এরপর ছোট বেলায় ক্রিকেট ব্যাট ধরে থাকা লায়ামের এক ছবি দেখেই মানুষের মনে কৌতূহল তাঁকে নিয়ে। লিয়ামও কী বাবার মত মস্ত বড় ক্রিকেটার হবে। ওদিকে ইয়ান বোথাম ও ভিভ রিচার্ডসের বন্ধুত্বের গল্প ক্রিকেট দুনিয়ায় কালজয়ী।
ইয়ান বোথাম একবার বলেছিলেন লায়াম বোথামের গড ফাদার হলেন ভিভ রিচার্ডস। ফলে খুব সহজেই অনুমেয় সেই ছোট্ট বয়স থেকেই লিয়ামের উপর এই প্রত্যাশার চাপ গুলো দেয়া হয়েছে। লায়ামও সাহস দেখিয়েছিলেন। বাবার মতই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ দেখালেন।
রাগবি ও ক্রিকেট দুটোই একসাথে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। একসময় ইংল্যান্ড অনুর্ধব-১৫ দলের হয়েও ডাক পেলেন। বয়সভিত্তিক দলের সেই ম্যাচেও মাঠে সাংবাদিকরা ভিড় করেছিল ইয়ান বোথামের ছেলে খেলছে বলে। ফলে তখন থেকেই আসলে চাপটা অনুভব করতে পারলেন লিয়াম।
তবুও লড়াই করে যাচ্ছিলেন ব্যাট-বল হাতে। লিয়ামের লড়াইটা মানসিকও ছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯ বছরে পা দেয়ার আগেই ইংল্যান্ডের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষিক্ত হলেন। হ্যাম্পশিরের হয়ে নিজের প্রথম ম্যাচও খেলতে হলো মাঠ ভর্তি সাংবাদিকের চাপকে উপেক্ষা করে।
ব্যাট হাতে সেদিন তেমন কিছু করতে পারেননি। তবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের নিজের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই আউট করেন মাইক গ্যাটিংকে। সেদিন বল হাতে ৬৭ রান খরচ করে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। ফলে সেই সময় আলোচনা আরো বেড়ে গিয়েছিল।
ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষজনও তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। মিডিয়াও ছিল সরব। এরপর আরো দুইটি ম্যাচ খেলেছিলেন। কিন্তু তারপর আর এই চাপ সামলাতে পারেননি লিয়াম বোথাম।
মাত্র ২০ বছর বয়সেই সম্ভাবনাময় লিয়ামের ক্যারিয়ার শেষ হয়। ক্রিকেটকে বিদায় জানান। কারণ, তিনি বুঝে ফেলেছিলেন ক্রিকেট খেললে আজীবন বাবার সাথে তুলনা হবে। আর ইয়ান বোথামকে কীর্তিতে তিনি আদৌ ছাড়াতে পারবেন না। বেশ ঘটা করে তাঁর জন্য বিদায়ী ম্যাচ আয়োজন করে হ্যাম্পশায়ার।
মনোযোগ দেন আরেক পছন্দের খেলা রাগবিতে। লিয়ামের এই রাগবিতে চলে যাওয়া নিয়ে ইয়ান বোথাম পরে তাঁর অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছিলেন, ‘আমি লিয়ামকে কখনোই পেশাদার ক্রিকেটের জন্য চাপ দিই নিই। তবে সে চাইলে আমি তাঁকে উপদেশ দিয়েছি, সমর্থন করেছি সাহস দিয়েছি। তবে সে তাঁর জীবনে কী করবে এটা পুরোপুরি তাঁর পছন্দের ব্যাপার।
তবে সিনিয়র বোথাম আক্ষেপ করে এটাও লিখেছিলেন যে, ‘তাঁর মধ্যে বড় ক্রিকেটার হওয়ার সবকিছুই ছিল। তাঁর বাবা যদি অন্য কেউ হতো কিংবা সে যদি অন্য কোন পদবি নিয়ে জন্মাতো তাহলে আমার বিশ্বাস সেও আমার মতো অলরাউন্ডার হতে পারতো। সে অনেকদূর যেতে পারতো।
তবে এসব কিছুই হয়নি। ১৯৯৭ সালে রাগবিতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন লিয়াম বোথাম। ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব ২১ রাগবি দলের হয়েও খেলেছেন। এছাড়া ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে খেলে রাগবিতে বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন। তবে ২০০৫ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে ইনজুরির কারণে রাগবি থেকেও অবসর নেন।
এরপর তাঁর এক বন্ধুর সাথে নিজেদের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর আসে আসল বিপর্যয়। ব্যবসায় বিরাট একটা ধরা খান। রীতিমত দেউলিয়া হয়ে যেতে হয়। অথচ লিয়াম বোথামের বিশ্বক্রিকেটে রাজত্ব করার কথা ছিল। অন্তর স্যার ইয়ান বোথাম তো সেটা বিশ্বাস করেন।
লিয়ামের ছেলে জেমস, জেমস বোথাম। তিনি অবশ্য বাবার খেলাটাকে ছাড়েননি। তিনিও রাগবি খেলেন। তবে, তিনি বদলে ফেলেছেন দেশ। ২০২০ সালে ওয়েলসের হয়ে রাগবির আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় তাঁর!