আপনি যখন অধিনায়ক হিসেবে দল নির্বাচনী সভায় ঢুকতেন তখন নাকি আপনার পকেটে দুটো কাগজ থাকতো – একটা আপনার পছন্দের টিম লিস্ট আরেকটা আপনার রেজিগনেশন লেটার। টেবিলের ওপর দুটো পাশাপাশি রাখা থাকতো নাকি! হয় এটা নাও , না হলে ওটা।
এ কাহিনী কতটা সত্যি তা কোনো ক্রিকেট গবেষকই বলতে পারেন। কিন্তু যদি সত্যি নাও হয় তাহলেও এটা ভেবে দেখার যে এত অধিনায়ক থাকা সত্ত্বেও শুধু আপনার নামের সাথেই এমন একটা কাহিনী জড়িয়ে গেল কেন?
কেন গেল তার একটা সহজ উত্তর আমার কাছে আছে। আমার কাছে ক্রিকেট নিয়ে যে রোমান্টিসিজম তার কেন্দ্রবিন্দুতে দুটো লোক থাকবেন। একজন ইমরান খান নিয়াজি আরেকজন ভিভিয়ান আইজ্যাক আলেকজান্ডার রিচার্ডস। তাদের সার্বিক চরিত্রের যে বিস্তৃতি তা ওই নেহায়েৎই ছোট ক্রিকেট মাঠের পরিসরে আঁটে না , ক্রিকেট মাঠ ছাড়িয়েও তা ছড়িয়ে যায় অনেক দূরে।
আপনি যখন প্রথম টেস্ট খেললেন আমি তখনও এ ধরাধামে আসিনি। আর যে বছরে আপনি অবসর নিলেন টেস্ট আর ওয়ান ডে দু ধরনের ক্রিকেট থেকেই, তখন আমার বয়স ঊনিশ, আমি তখন কলেজে। আর যেহেতু আমার গ্রামে টিভি নামের বস্তুটি এসেছিল অনেক পরে তাই আপনাকে খুব বেশি দেখা হয়নি আমার। কিন্তু যেটুকু দেখেছি ওটাই যথেষ্ট ছিল; ছয় ফুট দু ইঞ্চির একটা শরীর লাল বল হাতে উইকেটের দিকে দৌড়ে আসছে, তার ঘাড় পর্যন্ত ছড়িয়ে যাওয়া চুল দৌড়ের সাথে যেন ছন্দ মেলাতো – আহা ! সে দৃশ্য যারা দেখলো না তারা সত্যিই বড় অভাগা।
এখনকার ক্রিকেটে ভালো, ভালো খেলোয়াড়ের কোনো অভাব নেই , কিন্তু অভাব আছে চরিত্রের – এমন চরিত্র যার ইমেজটাই হবে লার্জার দ্যান লাইফ। যাকে আপনি ভালোবাসতে পারেন অথবা ঘৃণাও করতে পারেন কিন্তু কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারেন না । আপনার ওই দৌড়ে আসা বা ভিভের ওই নিস্পৃহ ভাবে চুইঙগাম চিবোতে , চিবোতে ,ব্যাট ঘোরানো – আহা! ক্রিকেট নামের খেলাটা তো ওইজন্যই প্রাণের এত কাছের।
গড়পড়তা সাধারণ মানুষ সকালে দুটো নাকে – মুখে গুঁজে ট্রেনে, বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে দৌড়োয় , দুপুরে বৌয়ের বানিয়ে দেওয়া রুটি আলুর তরকারি বা মুড়ি চানাচুর চিবোয় আর আবার বিকেলে বা সন্ধ্যায় ওই রকমই বাদুড় ঝোলা হয়ে ঘরে ফিরে আসে , হা ক্লান্ত শরীরে। তাঁর জীবনে অনেক দূর, দূর পর্যন্ত কোথাও রোমান্টিসিজম নেই। এবং এইখানেই সে দৈনন্দিন জীবনে আপনার মত কোন চরিত্র কে খোঁজে, যিনি বিশ্বকাপ জিতিয়েই মায়ের নামে ক্যানসার হাসপাতাল বানানোর কাজে নিজেকে সঁপে দেন।
ওটা হয়ে যাবার পরেই পাকিস্তান রাজনীতিকে শুদ্ধিকরণের কাজে নেমে যান রাজনৈতিক দল গড়ে। এবং এখানেই শেষ নয়, ভোটে জিতে প্রধানমন্ত্রীও হয়ে যান! অতি আশাবাদী লেখকও বোধহয় তাঁর নায়ককে দিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি করাতে সাহস পেতেন না। আর আপনি বাস্তবেই ও সব করে দেখিয়ে গেলেন।
অবশ্যই রাজনীতিবিদ ইমরান খান আমার আলোচনার বিষয় নয়। তবুও বলি , তূণীর বাবু ( চক্রবর্তী ) সেদিন সৌরভ গাঙ্গুুলি সম্পর্কে যেমন বলেছিলেন যে অধিনায়ক সৌরভ আপোষহীন আর প্রশাসক সৌরভকে আপোষ করতে হয়েছে – এ গল্পটাও ঠিক তেমনই বোধহয়। কিন্তু ওই যে বললাম, রাজনীতি ঠিক ‘মাই কাপ অব টি’ নয় তাই ওটা থাকুক ।
৮৮ টেস্টে তিন হাজার আটশো সাত রান আর তিনশো বাষট্টি উইকেট আর ১৭৫ ওয়ানডেতে তিন হাজার সাতশো নয় রান আর একশো বিরাশি উইকেট – এইসব শুকনো হিসেব দিয়ে ইমরান খান নিয়াজি নামের লোকটাকে মাপতে যাওয়া নেহায়েৎই বোকামি!
ইমরান খান নামের লোকটা যতটা না অলরাউন্ডার বা অধিনায়ক ছিলেন, তার থেকেও বেশি বোধহয় ক্রিকেট সংস্কারক ছিলেন। তাঁর অধিনায়কত্বে যে পাকিস্তান খেলতে নামতো ভারতের বিরুদ্ধে তাদের শরীরী ভাষাই আলাদা ছিল। এবং ভারত অনেক ক্ষেত্রেই আগেই হেরে বসে থাকতো। বেহালার বাসিন্দা ভারত অধিনায়ক হবার পর যে ছবি অনেকটাই বদলায়। তখন অবশ্য ইমরান খান নামের মহা নক্ষত্র ক্রিকেটের ময়দান থেকে অনেক, অনেক দূরে।
ব্যক্তিগত জীবনে ও একের পর এক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে আর ভেঙে গেছে – জেমিমা , এমা সার্জেন্ট , সিটা হোয়াইট – আসলে ইমরান খান এক প্রহেলিকার নাম যার শেষ গন্তব্য সম্পর্কে তিনি নিজেও খুব নিশ্চিত নন। একের পর এক মাইলস্টোন ছুঁয়েও শান্তি আসছে না মনে। আবারও একটা নতুন কিছু।
ইমরান খান, আপনি আমাদের কাছে দূরের এক গ্রহ যাকে দেখে মুগ্ধ হওয়া যায় , ঘৃণা করা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না কিছুতেই। আমি অবশ্য চোখ বুজলেই দেখি লাল বল হাতে দৌড়ে আসছেন উইকেটের দিকে। একটাই বিশেষণ মনে আসে তখন – ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’।