অত:পর বর্ণাঢ্য এক চরিত্রের মহাপ্রয়াণ। রানি এলিজাবেথ পাড়ি জমালেন ওপারে। রেখে গেলেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মদের সাথে সহস্র স্মৃতি। সে স্মৃতির অংশে খেলার মাঠও বাদ যায় না। অলিম্পিক থেকে শুরু করে ক্রিকেট, ফুটবল সবখানেই কোনো না কোনো সময় উপস্থিতি ছিল রানি এলিজাবেথের।
২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ পৃথিবীর প্রথম বিশ্বকাপ হবে যে পৃথিবীতে রানি এলিজাবেথ থাকবেন না। ১৯৩০ থেকে ২০১৮ বিশ্বকাপ- সব বিশ্বকাপই যে হয়েছে তাঁর জীবদ্দশায়। ১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপটি তো ইংলিশ দলপতি বব মুরের হাতে তিনিই তুলে দিয়েছিলেন।
অলিম্পিকে লারিসা ল্যাটিনিনা থেকে মাইকেল ফেলপস, সব কীর্তিরই সাক্ষী হয়েছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় রানি এলিজাবেথ। এ ছাড়া ক্রিকেটের তীর্থভূমি লর্ডসে প্রথম মহিলা হিসেবে প্রবেশ করাসহ প্রায় শতবর্ষী জীবনের রানি এলিজাবেথ অসংখ্য ক্রীড়া ইভেন্টে উপস্থিত ছিলেন। সে সব উপস্থিতির স্মৃতি রোমন্থন সহ ক্রীড়াঙ্গনে তার অবদানের গল্পগুলো নিয়েই খেলা-৭১ এর আজকের আয়োজন।
- ১৯৬৬ ফুটবল বিশ্বকাপ
ইংল্যান্ড তাঁদের একমাত্র ফুটবল বিশ্বকাপটি জিতেছিল ১৯৬৬ সালে। সেই অনন্য ইতিহাসের সাক্ষী ছিলেন রানি এলিজাবেথ। নিজ হাতে ইংলিশদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন জুলেরিমে ট্রফি।
২০২০ সালে এসে সেই মুহূর্তের ম্মৃতিচারণাও করেছিলেন তিনি। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি নিজেকের খুব ভাগ্যবতী মনে করি এই ভেবে যে, ৫০ বছর আগে বিশ্বকাপটি বব মুরের হাতে তুলে দিতে পেরেছিলাম। এটা অনন্য একটা মুহূর্ত ছিল আমার জন্য।’
- ফুটবলারদের বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করা
রাণী এলিজাবেথ তাঁর শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে বহু ফুটবলারদের বিভিন্ন উপাধিতে সম্মানিত করেছেন। প্রথম ফুটবলার হিসেবে তাঁর কাছ থেকে ‘নাইট’ উপাধি পেয়েছিলেন স্যার স্ট্যানলি ম্যাথিউজ। এরপর একে একে আলফ রামসি, অ্যালেক্স ফার্গুসন, ববি রবসনও কুইনের কাছে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হন।
তাঁর সময়েই রয় হডজসন ‘অর্ডার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ উপাধি পেয়েছিলেন। এ ছাড়া কুইনের হাত দিয়েই ‘সিবিই’, ‘এমবিই’ অ্যাওয়ার্ড সম্মাননায় সম্মানিত হয়েছেন ডেভিড বেকহাম ও গ্যারেথ বেল।
- ওয়েস্ট হাম নাকি আর্সেনাল, কোন দলের সমর্থক ছিলেন কুইন?
রানি এলিজাবেথ এ ব্যাপারে কখনোই প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। তবে ধারণা করা হয় রানি ওয়েস্ট হ্যামের বড় ফ্যান ছিলেন। এই অনুমান আরও বেশি শক্তপোক্ত হয়, ২০০৯ সালে যখন তাঁর পরিবারের একজন ইন্টারভিউতে রানি এলিজাবেথের সাথে হ্যামার্সদের প্রতি গোপন ভালবাসার সম্পর্ক জুড়ে দেয়। মূলত, ওয়েস্ট হ্যামের আরেক নাম ‘দ্য হ্যামার্স’।
তবে রানি এলিজাবেথের প্রিয় ক্লাবের তালিকায় আরেক ইংলিশ দল আর্সেনালের নামও জুড়ে দেওয়া হয়। কারণ ২০০৭ সালে বাকিংহাম প্যালেসে রানি এলিজাবেথ একবার পুরো আর্সেনাল স্কোয়াডকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সে আমন্ত্রণের খবর ব্রিটিশ মিডিয়ায় এমনভাবে চাউর হয় যে, সবাই ধারণা করে বসে, আর্সেনালই বোধহয় রানির বোধহয় পছন্দের ক্লাব।
ফুটবল তো গেলো, এবার একটু ক্রিকেট পাড়ায় রানির বিচরণের মুহূর্ত ফ্ল্যাশব্যাকে আনা যাক।
- আ লেডি এট লর্ডস
১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ম্যাচ চলাকালীন সময়ে লর্ডস প্যাভিলিয়নে প্রবেশের অনুমতি ছিল না। এমনকি ভারতের নারী টেস্ট ক্রিকেটার ডায়ানা ইডালজিকেও একবার প্রবেশপথ থেকে ফিরে যেতে হয়। তবে ব্যতিক্রমী উদাহরণ তৈরি করেছিলেন রানি এলিজাবেথ। ১৯৯৯ সালেই ম্যাচ চলাকালীন সময়ে লর্ডস প্যাভিলিয়নে এসেছিলেন তিনি।
যদিও রানি প্রথমবারের মতো লর্ডসে এসেছিলেন ১৯৪৭ সালে গিয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত ৩৩ বার লর্ডসের মৃত্তিকায় নিজের চরণ স্পর্শ করেছেন তিনি৷ তবে ম্যাচ চলাকালীন সময়ে প্যাভিলিয়নে গিয়েছিলেন ঐ বারই প্রথম।
- ডেনিস লিলি আর একটি ফটোগ্রাফ
সাল ১৯৭৭। মেলবোর্নের শতবর্ষী টেস্ট দেখতে এসেছিলেন রানি এলিজাবেথ। ম্যাচ শুরু আগে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের সাথে সৌজন্য এক সাক্ষাৎ করতে গেলেন তিনি ৷ এর মাঝে অজি বোলার ডেনিস লিলি রানির কাছে অদ্ভুত এক আবদার করে বসলেন। লিলি তাঁর গালে রানির একটা অটোগ্রাফ চাইলেন৷ স্বাভাবিকভাবেই লিলি সে অবদারে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন৷ তবে এর কিছুুক্ষণ পরেই রানি এলিজাবেথ তাঁর একটি ফটোগ্রাফ পাঠিয়ে দেন লিলির কাছে।
সেই লিলিই ১৯৮১ সালে রানির কাছ থেকে বাকিংহাম প্যালেসে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। একই সাথে রানির কাছ থেকে পেয়েছিলেন ‘মেম্বার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ অ্যাওয়ার্ড।
অলিম্পিকের বিশ্বায়নের ক্ষেত্রে রানি এলিজাবেথের ভূমিকা ছিল অসামান্য। তাঁর শাসনামলের আগে বেশিরভাগ অলিম্পিক আসরই হতো গ্রেট ব্রিটেন নয়তো আমেরিকায়। তবে রানি এলিজাবেথ তাঁর শাসনামলে এসে অলিম্পিক বিশ্বায়নে কাজ শুরু করেন। এর পর থেকেই অলিম্পিকের বিভিন্ন আসরের স্বাগতিক দেশ হিসেবে এশিয়া, আফ্রিকার দেশগুলোর দেখা মেলে।
রানির এ প্রস্থান ক্রীড়াবিশ্বের কাছেও মহাপ্রয়াণ। কারণ শত শত বছরের ক্রীড়াঙ্গনের শতটা ফ্রেমজুড়ে রয়েছেন রানি। এ সকল স্থিরচিত্রে রানির তরুণ থেকে বুড়ো হওয়ার প্রবাহও যে বিদ্যমান। তাই এ শোক তো ক্রীড়াঙ্গনকে স্পর্শ করবেই।
রানির বিদায়ের শোকে এখন মোহাচ্ছন্ন পুরো ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ড – দক্ষিণ আফ্রিকার তৃতীয় টেস্ট ইতোমধ্যেই স্থগিত হয়ে গিয়েছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগও এ মাসজুড়ে বন্ধ থাকার খবর শোনা যাচ্ছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যারা রানি এলিজাবেথের অস্তিত্বে অভ্যস্ত সেই রানির প্রস্থানের শোকে মুহ্যমান তো তারা হবেনই।