ফেসবুকের এই যুগে ট্রল ব্যাপারটা নিতান্তই সাধারণ। ক্রিকেট পাড়ায় আফগান তারকা রশিদ খানের বয়স নিয়ে ট্রল হওয়াটা এখন যেন বড্ড সাধারণ। তবে, এসব পাশ কাটিয়ে রশিদ নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন বর্তমান বিশ্ব সেরাদের কাতারে। রশিদ খানের বয়স নিয়ে ট্রলকারীরাও মানেন তিনি বিশ্বসেরা লেগ স্পিনার। আর তাতে কারো সন্দেহ থাকার কথাও নয়। ট্রলটা ট্রলের জায়গায়ই থাকুক না, তাঁর সামর্থ্য আর প্রতিভা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবিদার।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পরিসংখ্যান দেখে হুট করেই মন্তব্য করে ফেলতে পারেন রশিদের ক্যারিয়ারের অধিকাংশ উইকেটই এসেছে খর্ব শক্তির দলগুলোর বিপক্ষে। ক্যারিয়ারে বড় দলের বিপক্ষে যার অর্জনের খাতার বেশির ভাগটাই খালি তাঁকে বিশ্বসেরা খ্যাতি দিতে অনেকেরই আপত্তি। তাঁদের জন্যই হয়তো নেভিল কার্ডাস বলেছিলেন, ‘পরিসংখ্যান আস্ত একটা গাধা।’
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বড় দলের বিপক্ষে আফগানিস্তান সিরিজ খেলার সুযোগই বা পায় কোথায়? কালেভদ্রে বিভিন্ন টুর্নামেন্টে বড় দলের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পায় আফগানরা। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ, (আইপিএল) বিগ ব্যাশ, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল), পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) সহ বিশ্বের বিভিন্ন লিগে ফ্র্যাঞ্চাইজি গুলোর পছন্দের তালিকায় সবার উপরের দিকে থাকা রশিদ খানকে স্রেফ বয়স কিংবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খর্বশক্তির দলগুলোর পারফরম্যান্স দিয়ে বিবেচনা করলে ভুলই হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন লিগে প্রতিনিয়ত ব্যাটসম্যানদের নিজের লেগস্পিন ভেলকিতে নাকানিচুবানি খাইয়ে ইতিমধ্যেই নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন সেরাদের তালিকায়। তাঁর আক্ষেপটা হয়তো আফগানিস্তান নিয়মিত বড় দলগুলোর বিপক্ষে খেলার সুযোগ পায় না।
যুদ্ধ বিধ্বস্থ একটা দেশ থেকে উঠে এসে ক্রিকেট বিশ্বের বড় বড় ক্রিকেটারদের নিয়মিতই মাতিয়ে দিচ্ছেন তিনি! নিজ দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন বিশ্বের বিভিন্ন লিগে। অবশ্য এই উঠে আসার পেছনের গল্পটা হয়তো অনেকেরই জানা নেই।
টিভিতে ক্রিকেট দেখেই স্বপ্ন জাগে ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়ার। তবে, বোলার নয় চেয়েছিলেন একজন পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হতে। কিন্তু পরিবার ছিলো ক্রিকেটের বিরুদ্ধে। বন্ধুদের সাথে লুকিয়ে বাইরে খেলতে গিয়ে প্রথম দিনে হাত ইনজুরি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন রশিদ। রক্তাক্ত হাত নিয়ে বাড়ি ফিরলেও ২-৩ সপ্তাহ কাউকে বুঝতে দেননি ক্রিকেট খেলতে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে।
পরিবার চেয়েছিলো রশিদ পড়াশোনা করবে, ডাক্তার হবে। তাঁরও পরিকল্পনাটাও এমনই ছিল। বাবা-মা ক্রিকেটের জন্য কখনোই অনুমতি দিতেন না। ভাইদের সাপোর্টে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন রশিদ। সেখানে ক্লাবে ভালো খেলতে খেলতে সুযোগ পেয়ে যান অনূর্ধ্ব- ১৯ দলে। ব্যাট ছেড়ে বনে গেলেন লেগ স্পিনার! অনূর্দ্ধ-১৯ দলের হয়ে দু’টি সফরে যান রশিদ। সেখানে ভালো করায় সুযোগ পান আফগানিস্তান এ দলেও! তবে, সেখানে কোনো ম্যাচে সুযোগ পাননি তিনি।
সেখানে বাদ পড়ার পর ক্রিকেট ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন রশিদ। এমনকি তার বড় ভাইও পরামর্শ দেন ক্রিকেট ছেড়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে। তবে, মায়ের কথায় আবারো ক্রিকেটে ফিরে যান রশিদ। এরপর ঘরোয়া ক্রিকেটে ৩ ম্যাচে ২১ উইকেট শিকার করে নিজেকে জানান দিলেন তিনি! সেখান থেকে ২০১৫ সালে ডাক পান জাতীয় দলে। পাকিস্তানে অনূর্ধ্ব -১৯ দলের হয়ে ৬৪ রানের ইনিংস খেলার পর থেকেই পরিবারের সবাই তাঁকে সাপোর্ট দিতে শুরু করেন।
এরপর একের পর এক সফলতার সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠেন রশিদ। ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। সেই পারফরম্যান্সের পর জনপ্রিয় কমেন্টেটর আকাশ চোপড়া একটা টুইট বার্তায় লিখেছিলেন, ‘বর্তমানে সেরা লেগ স্পিনার রশিদ। তাকে আইপিএল দলে নেওয়া উচিত।’
পরের আসরেই ২০১৭ সালে আইপিএলে ‘ফর্ম সাবমিট’ করেন রশিদ। আইপিএলের নিলামের সময় রশিদ ছিলেন জিম্বাবুয়েতে। ভোর তখন সাড়ে তিনটা! তিনি জেগে আছেন আর আইপিএলের নিলাম দেখছেন। এক ফোনে আইপিএলের নিলাম আর আরেক ফোনে পরিবারের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছিলেন তিনি। রশিদের আগে সে সময়ের এক নাম্বার টি-টোয়েন্টি বোলার ইমরান তাহির আনসোল্ড হয়ে যায়। এরপর দল পাবার আশা ছেড়ে দেন রশিদও! কিন্তু তার ভাই আশা দিচ্ছিলেন মুম্বাই হয়তো তাকে কিনে নিবে। এরপর নিলামে ৪ কোটি রুপিতে রশিদকে দলে ভেড়ায় সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ।
নেট সেশনে দেখা পেলেন ভিভিএস লক্ষ্মণ, মুত্তিয়া মুরালিধরনের মতো তারকা ক্রিকেটারদের। রশিদের বোলিং দেখার পর মুরালি তো বলেই ফেললেন, ‘স্কিলের দিক থেকে তুমি আমার চেয়েও ভালো।’ সেখান থেকে আইপিএলে অভিষেক। জীবনের পরিবর্তনের শুরু সেখান থেকেই।
২০১৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে একাই ধসিয়ে দেন ক্যারিবিয়ানদের। আফগানদের দেওয়া মাত্র ২১৩ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে রশিদের ক্যারিয়ার সেরা ৭ উইকেট শিকারে মাত্র ১৪৯ রানেই গুড়িয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। মাত্র ১৮ রানে ৭ উইকেট শিকার করেন রশিদ খান!
২০১৯ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে চার বলে চার উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়েন তিনি! প্রথম বোলার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে চার বলে চার উইকেট নেওয়ার রেকর্ড গড়েন তিনি। একই সাথে একমাত্র স্পিনার ও সপ্তম বোলার হিসেবে টি-টোয়েন্টি হ্যাট্রিক করেন তিনি। ম্যাচের কঠিন মুহূর্তে রশিদের দূর্দান্ত বোলিংয়ে জয় পায় আফগানরা।
ঐ বছর ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (সিপিএল) ইতিহাসে প্রথম হ্যাটট্রিক করেন রশিদ। জামাইকা তালাওয়াইসের বিপক্ষে এই হ্যাট্রিক শিকার করেন তিনি। অবশ্য এর আগেও ৪-৫ বার হ্যাটট্রিকের সুযোগ করেছিলেন তিনি। কিন্তু কাছে গিয়েও বার বার এই কীর্তি গড়তে ব্যর্থ হন রশিদ।
অবশ্য ২০১৯ বিশ্বকাপে মোটেও নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি তিনি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে তো তাঁর সামনে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিলেন ইংলিশ অধিনায়ক ইয়ন মরগ্যান! ৯ ওভার বল করে ১১ ছক্কায় ১১০ রান দেন রশিদ! বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে খরুচে ও ওয়ানডে ইতিহাসের দ্বিতীয় খরুচে বোলার হিসেবে নাম লেখান রশিদ।
পরের বছরই বিগ ব্যাশে সিডনি সিক্সার্সের বিপক্ষে প্রথম স্ট্রাইকার্স বোলার হিসেবে হ্যাটট্রিক করেন রশিদ। সিপিএলের পর বিগ ব্যাশেও হ্যাট্রিকের কীর্তি গড়েন এই লেগি। ২৩ বছর বয়সেই ইতিমধ্যেই নিজের নামে করেছেন বেশ কিছু কীর্তি। কমপক্ষে ১০০০ বল করা বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো গড় এখন রশিদের (১৮.৫৭)! ওয়ানডেতে দ্রুততম ১০০ উইকেটের মাইলফলকেও আছেন তিনি (৪৪)। এছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে কনিষ্ঠতম ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ও ওয়ানডেতে অধিনায়কত্বের কীর্তি গড়েন তিনি!
ছোট দলের এই মহাতারকার সামনে ক্যারিয়ারে এখনো লম্বা পথ! ইতিমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিজের স্পিন ম্যাজিকে বেশ সুনাম কামিয়েছেন রশিদ। ক্যারিয়ার শেষে হয়তো নিজেকে রেখে যেতে চাইবেন কিংবদন্তিদের তালিকায়। বয়স নিয়ে ট্রল করুন কিংবা মাঠের বাইরের রশিদকে কিন্তু রশিদের সামর্থ্য কিংবা প্রতিভাকে অস্বীকার করার কারণ নেই!