নিউজিল্যান্ডের রিচার্ড হ্যাডলিও অনেকটা ইমরান খানের মতোই ক্যারিয়ার আরম্ভ করেছিলেন শুধুমাত্র ফাস্ট বোলার হওয়ার অভিপ্রায়ে। একঝাঁক অবিন্যস্ত চুল, লম্বা দোহারা শরীর, ২৩ পায়ের লম্বা রান আপ, সাইড অন অ্যাকশন এবং দুরন্ত গতি – এই ছিল শুরুর দিকে হ্যাডলি এবং তার বোলিংয়ের মুখ্য চরিত্র।
বোলার হ্যাডলি প্রথম সাফল্যের মুখ দেখেন ভারতেরই বিরুদ্ধে। ওয়েলিংটনে ২৩ রানের বিনিময়ে ৭ ভারতীয় ব্যাটসম্যানকে আউট করে (ম্যাচে সবসুদ্ধ ১১ উইকেট) নিউজিল্যান্ডকে জয় এনে দেন হ্যাডলি। এই টেস্টে হ্যাডলি ছিলেন নিউজিল্যান্ডের চতুর্থ পেসার। কোন ইনিংসেই নতুন বলে বল করার সুযোগ পান নি হ্যাডলি।
নটিংহ্যামশায়ারের হয়ে কাউন্টি ক্রিকেট খেলার সময় ক্রমে নিজের বোলিং নিয়ে পরীক্ষা আরম্ভ করেন হ্যাডলি। ডেনিস লিলিকে সামনে রেখে বদলে ফেলেন নিজের বোলিং। চুল এবং রান আপ দুটোই ছোট করে মনোযোগ দেন স্যুইং, সিম এবং নিয়ন্ত্রনে।
শুরুর দিকে মূলত আউট স্যুইং বোলার হলেও ক্রমে যোগ করেন ইনস্যুইং এবং অত্যন্ত অসুবিধাজনক লেন্থ থেকে বলকে বাউন্স করানোর ক্ষমতা এবং নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ। তার বিরুদ্ধে ব্যাট করার সময় অক্সিজেনের অভাব বোধ করতেন প্রায় সব ব্যাটসম্যানই।
হ্যাডলির এই রান আপ ছোট করে বল করার সিদ্ধান্তকে কিন্তু প্রথমে অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি। এমন কি একসময় নিউজিল্যান্ডের সতীর্থদেরও মনে হয় যে নিজের কাজে ফাঁকি দিচ্ছেন হ্যাডলি। মাত্র আট–নয় পা ছুটে এসে ফাস্ট বোলিং – এ আবার টেস্টে চলে নাকি?
কিন্তু সাফল্যর সঙ্গে তর্ক চলে না। যখন হ্যাডলির নতুন পদ্ধতির বোলিং কাঁড়ি কাঁড়ি উইকেট আর একের পর জয় এনে দিতে লাগল নিউজিল্যান্ডকে তখন ক্রিকেট বিশ্ব মেনে নিতে বাধ্য হল তার ফর্মুলার কার্যকারিতা।
হ্যাডলির পরের পর্যায়ের বোলিং অ্যাকশন দেখে মনে হয় যেন কম্পিউটারে তৈরি। সাত আট পা ছুটে, উইকেটের গা ঘেঁষে কানের একটু ওপর থেকে চাবুকের তীব্রতায় নেমে আসত হ্যাডলির ডান হাত। মনে হত যেন একটা অদৃশ্য সুঁতোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে তার একশন এবং বলের গতি। উইকেট টু উইকেট বল করাকে এতটাই গুরুত্ব দিতেন হ্যাডলি যে প্রায়ই তার হাতের আঘাতে নন স্ট্রাইকার এন্ডের উইকেটের বেল পড়ে যেত।
প্রয়োজনের চেয়ে এক ফোঁটা বেশি শক্তি ব্যয় করতেন না হ্যাডলি তার বোলিংয়ে। যতটা না ছুটলেই নয় ঠিক ততটাই ছুটতেন, ন্যুনতম যে গতিতে বল করলে ব্যাটসম্যান অস্বস্তি বোধ করবে ঠিক ততটাই গতি থাকতো তার বলে, ঠিক যতটুকু স্যুইং করলে ব্যাটসম্যানের ব্যাটের কানা পাওয়া যাবে ঠিক ততটুকুই স্যুইং করত তার বল।
এমন কি এলবিডব্লিউয়ের জন্যে আপিল করার সময়ও ঠিক যতটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার দরকার ততটাই করতেন হ্যাডলি। নিজের অনুকুলে আম্পায়ারের নির্ণয় পেয়ে যাওয়ার পর আর কোন বাড়তি উচ্ছাস বা আবেগ নেই। নেই ব্যাটসম্যানদের দিকে ফলো থ্রুতে গিয়ে কটমট করে তাকানো বা নিজেকে তাতাবার জন্যে স্লেজিং। টেনিসের যেমন পিট সাম্প্রাস, ক্রিকেটের তেমনই হ্যাডলি। বরফের শীতল মানসিকতা, কম্পিউটারের মতো নিখুঁত অথচ বিধ্বংসী। ম্যাচের পর ম্যাচ।
হ্যাডলির ব্যাটিংয়েও পরের দিকে উন্নতি হলেও এটা মেনে নেওয়াই ভালো যে তার ব্যাটিং অন্য তিনজনের চেয়ে অনেকটাই কমজোরি ছিল। তবে প্রতিভা নয়, এর জন্য মূলত দায়ী ছিল মনোযোগের অভাব। অবশ্য হ্যাডলিকে দোষ দেওয়া যায় না কোনমতেই, নিউজিল্যান্ডের বোলিং প্রায় একার কাঁধে তিনি বয়ে বেড়িয়েছেন নিজের পুরো ক্যারিয়র জুড়ে। সেই সময় বলা হত নিউজিল্যান্ডের বোলিং আক্রমণ ছিল এক প্রান্ত থেকে বিশ্ব একাদশের, অন্য প্রান্ত থেকে ক্লাব টিমের।
হ্যাডলি শুধু এই চারজনের মধ্যেই নয়, নিজের ক্রিকেট জীবনের শেষ ছয়–সাত বছরও বিশ্বের সেরা বোলার ছিলেন। এমন কি নিজের শেষ টেস্টেও ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়ে খেলা ছাড়েন হ্যাডলি, উইকেট দখল করেন জীবনের শেষ টেস্ট বলেও। তখন তার ঝুলিতে টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি উইকেট – ৪৩১।
কপিল, বথাম, ইমরান ও হ্যাডলি – এই চারজনকে দুই দলে ভাগ করা যায়। এক দলে থাকবেন বথাম ও কপিল যারা নিজের ক্যারিয়রের আরম্ভ থেকেই সহজাত প্রতিভার জোরে সাফল্য পান। কিন্তু একটা সময়ের পর তাদের ক্যারিয়র গ্রাফ ক্রমশ নিচের দিকে নামতে থাকে।
অন্য দলে থাকবেন ইমরান ও হ্যাডলি। নিজের ক্রিকেটে মস্তিষ্কের প্রয়োগ করার ফলে সময়ের সাথে সাথে তাদের ক্রিকেটে ক্রমাগত উন্নতি ঘটতে থাকে। চারজনের ক্যারিয়রের শেষে দেখা যাবে ইমরান ও হ্যাডলির পরিসংখ্যান অন্যদের তুলনায় বেশি উজ্জ্বল।
আমরা আগেই আলোচনা করেছি বথামের প্রথম ডাবল আসে ২১ টেস্টে, কপিলের ২৫। হ্যাডলি ও ইমরানের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ছিল যথাক্রমে ২৮ ও ৩০। বোথাম দ্বিতীয় ডাবল করেন ৪২তম টেস্টে, কপিল ৫০, হ্যাডলি ৫৪ এবং ইমরান ৫০তম টেস্টে। অর্থাৎ ইমরানের দ্বিতীয় ১০০০ রান ও ১০০ উইকেট আসে মাত্র ২০ টেস্টে। তৃতীয় ডাবল অর্থাৎ ৩০০০ রান ও ৩০০ উইকেট নিতে বোথামের লাগে ৭২ টেস্ট, ইমরানের ৭৫, কপিল এবং হ্যাডলি ৮৩ টেস্ট।
অলরাউণ্ডারদের মহত্ত্ব মাপার একটা সহজ পদ্ধতি হচ্ছে ব্যাটিং এবং বোলিং গড়ের মধ্যে পার্থক্য তুলনা করে দেখা। এই মানদণ্ডে ইমরান অন্য তিনজনকে অনেকটাই পেছনে ফেলে দিয়েছেন। তার বোলিং গড় প্রায় হ্যাডলির সমতুল্য, ব্যাটিং গড় চারজনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই পার্থক্যের ব্যাপারে ইমরান আর কিথ মিলার বেশ কাছাকাছি।
তবে পরিসংখ্যান সবসময় পুরো ছবি দেখায় না। নিজের পিক ফর্মে বথাম বা কপিল ব্যাট হাতে যতটা বিধ্বংসী ছিলেন ইমরান কোনদিন তার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেন নি। তবে তিনি নিজের উইকেটের মুল্য বুঝতেন বলে কখনও নিজের উইকেট ছুঁড়ে আসতেন না। প্রচুর ইনিংসে নট আউট থাকার ফলে তার ব্যাটিং গড় আরও স্বাস্থকর হয়েছে। একই পরিস্থিতিতে কপিল বা বোথাম হয়ত দর্শকদের খুশি করার চেষ্টায় ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হয়ে ফিরে আসতেন।
একই সঙ্গে ব্যাটিং – বোলিং দুটোতেই ম্যাচ জেতানোর রেকর্ডে চারজনের মধ্যে বোথাম সবচেয়ে এগিয়ে। তবে ক্যারিয়রের পরের দিকে তার ক্রিকেটের পতনও সবচেয়ে বেশি।
ফিল্ডিংয়েও কপিল আর বোথাম চারজনের মধ্যে এগিয়ে ছিলেন। বথাম মূলত স্লিপে ফিল্ডিং করতেন, কপিল আউট ফিল্ডে। ক্যারিয়রের শেষের দিকে কপিলও স্লিপে দক্ষতার সঙ্গে ফিল্ডিং করেছেন। সব মিলিয়ে চারজনের মধ্যে কপিল দেবই ফিল্ডার হিসেবে শ্রেষ্ঠ।
কপিল এবং হ্যাডলি দুজনেই দুর্বল বোলিং আক্রমণকে নিজের কাঁধে টেনে নিয়ে গেছেন। কপিলকে আবার তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে উপমহাদেশের মরা পিচ এবং দুর্বল স্লিপ ক্যাচিংয়ের বিরুদ্ধেও। যেখানে অসুস্থতার সময় ইমরান বা হ্যাডলি মাঝে মাঝেই ক্রিকেট থেকে ব্রেক নিয়ে তরতাজা হয়ে ফিরে এসেছেন, সেখানে কপিল দেব একনাগাড়ে ১৬-১৭ বছর টেস্ট এবং একদিনের ম্যাচ খেলে গেছেন।
সম্পূর্ণ ফিট না থাকা অবস্থায়ও তিনি বহু ম্যাচ খেলেছেন। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাঁর রেকর্ড। স্কোরবোর্ড বা রেকর্ড বই এই ফ্যাক্টরগুলো গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না। আর সে জন্যেই রেকর্ডকে একমাত্র মাপকাঠি না করাই শ্রেয়।