বিশ্বের সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার কে?
এই আলোচনা কোথাও উঠলে তর্কের হয়তো বিশেষ জায়গা থাকবে না। হ্যাঁ, শেন ওয়ার্ন, ইমরান খানের মত কেউ হয়তো আব্দুল কাদিরের নাম বলবেন। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান যেমন মনে করতেন ‘টাইগার’ ওরেইলি বিশ্বের সর্বকালের সেরা লেগস্পিনার। সুভাষ গুপ্তে বা অনিল কুম্বলের নাম ও এসে যাবে বিবেচনায়।
কিন্তু, কয়েক আলোকবর্ষের দূরত্বে থেকে যাবেন লেগ স্পিনারদের মুকুটহীন সম্রাট, শেন কিথ ওয়ার্ন। শেন ওয়ার্নের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম কারণ হলো, ডান-হাতি ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে রাউন্ড দ্য উইকেট এসে ব্যাটসম্যানকে আউট করার ক্ষমতা। লেগ স্পিনের জন্ম লগ্নে বা মধ্যবয়স পর্যন্ত রাউন্ড দ্য উইকেট আসার প্রধান কারণ ছিল রান আটকানো।
প্রথম যিনি এই ধারার বদল ঘটান, সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনারের আলোচনায় তাঁর নাম কদাচিৎ ওঠে। যার দেখিয়ে দেয়া পথ ধরে ওয়ার্ন লেগস্পিন বিপ্লব ঘটালেন, তাঁর ভাষ্যকার সত্তা যেন তাঁর লেগ স্পিনার সত্তাকে পুরোপুরি গ্রাস করেছে। তিনি রিচি বেনো। ‘মাইকের পিছনের ব্র্যাডম্যান’ সহ আরও অনেক ঐতিহ্য মণ্ডিত উপাধি তিনি পেয়েছেন দীর্ঘ ভাষ্যকার ও সাংবাদিক জীবনে।
সম্প্রচারক হিসেবে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, লেগ স্পিনার হিসেবে ওয়ার্নের শ্রেষ্ঠত্বের মতই। আলোচনায় অনেকেই আসবেন, তবে তিনি বাকি সকলের চেয়ে কয়েক আলোকবর্ষ এগিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের সুউচ্চ বেদিতে নিজের আসন সংরক্ষণ করে রাখবেন। তবে সেটা নিয়ে অন্য কোনো সময় আলোচনা করা যাবে। এবার না হয়, লেগ স্পিনার বেনো কে নিয়ে কথা বলবো।
১৯৫২ সালে খেলা শুরু করা রিচি, প্রথম কয়েক বছর লেগ স্পিনার বা ব্যাটসম্যান, কোনো ভূমিকাতেই তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। ১৯৫৫ সালে ওয়েস্টইন্ডিজ সফর ও ১৯৫৬-এর ইংল্যান্ড সফরে নিজের প্রতিভার অল্প স্বল্প পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর ক্রিকেট জীবনের মোড় ঘোরানো সফর হয়ে থেকে যাবে ১৯৫৬-এর ভারত সফর।
শুরু করলেন মাদ্রাজে ৮ উইকেট নিয়ে, বোম্বেতে পরের টেস্টে বিশেষ কিছু প্রভাব ফেলতে পারেননি। এরপর এলো ইডেন টেস্ট। গোলাম আহমেদের প্রথম ইনিংসে সাত উইকেট প্রমান দিয়েছিল শুরু থেকেই পিচে বল ঘোড়ার। অস্ট্রেলিয়া ১৭৭ এ শেষ হয়ে গেলেও, ভারতকে চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করতে হবে, এই বিশ্বাসে তারা ম্যাচে টিকেছিল। হলোও তাই।
কন্ট্রাক্টর, মাঞ্জেরেকার, মানকর-সহ ছয় উইকেট নিলেন রিচি, ভারত শেষ হলো ১৩৬ রানে। দ্বিতীয় ইনিংসেও, ভারতীয় মিডল অর্ডারের তিন স্তম্ভ, অধিনায়ক উম্রিগার, মানকর এবং মাঞ্জেরেকার সহ পাঁচ উইকেট নিলেন রিচি। ভারত হারলো বেশ বড় ব্যবধানে। আর রিচি বেনো হয়ে উঠলেন নতুন তারকা।
এরপর ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ভাল খেলার সুবাদে অধিনায়ক নির্বাচিত হলেন ঘরের মাঠে ১৯৫৮-এর অ্যাশেজে। অধিনায়ক হিসেবেও দারুণ ছিলেন। ১৯৬০-৬১ তে স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেলের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এর অস্ট্রেলিয়া সফর এবং ব্রিসবেনের টাই টেস্ট নিয়ে তো আজও আলোচনা হয়।
এরপর এলো ১৯৬১ সালের ইংল্যান্ড সফর। প্রথম টেস্ট অমীমাংসিত এবং দ্বিতীয় টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের পর, ফ্রেড ট্রুম্যানের ঘরের মাঠ লিডসে ফ্রেড ট্রুম্যানের ১১ উইকেট অস্ট্রেলিয়াকে ধরাশায়ী করে দেয়। সিরিজ ১-১, এই অবস্থায় গিয়ে পৌঁছলো ম্যানচেস্টারে। বেনোর ব্যাট ও বল, দুই দিকেই খারাপ পারফরম্যান্সের ফলে তাঁকে সরিয়ে লিল হার্ভিকে অধিনায়ক করার প্রস্তাব দিতে লাগলেন সব বোদ্ধারা।
টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার শুরুটাও হলো যাচ্ছেতাই। বেনোর দীর্ঘদিনের ধারাভাষ্যের সঙ্গী, বিল লরি ও কিছুটা ব্রায়ান বুথ ছাড়া ট্রুম্যান-স্টেথামের গোলাগুলি বাকি কেউই সামলাতে পারেননি। ফলস্বরূপ অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস গুটিয়ে যায় ১৯০ তে। জবাবে পিটার মের ৯৫ এর উপর ভর করে ইংল্যান্ড করে ৩৬৭।
বেনোর উইকেট সংখ্যা ০। দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য অস্ট্রেলিয়া ঘুরে দাঁড়ায়। বিল লরির সেঞ্চুরি, ওয়াসিম আকরামের আগের বিশ্বের অন্যতম সেরা বাঁ-হাতি ফাস্ট বোলার অ্যালান ডেভিডসনের ৭৭ ও শেষে ব্যাট করতে নেমে গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জির ৩২ এর পর ইংল্যান্ডের লক্ষ্য মাত্রা দাঁড়ায় চার ঘন্টার কাছাকাছি সময় ২৫৬। বেশির ভাগই ভেবেছিলেন ম্যাচ ড্র হতে চলেছে।
কিন্তু, টেড ডেক্সটারের মাথায় অন্য কিছু ছিল। যে রকম সংহার মূর্তি ধারণ করেছিলেন, তাতে ইংল্যান্ড সময় শেষের আগেই জিতে যাবে এমনটা মনে হচ্ছিল। এরপরই বেনো নিয়ে এলেন সেই রণনীতি। রানের জোয়ার বন্ধ করতে, রাউন্ড দ্য উইকেট এলেন।
গদার যেমন কোনো শৈল্পিক কারণে না, ছবির দৈর্ঘ্য কমানোর জন্য ‘ব্রেথলেস’ ছবিতে জাম্পকাট নিয়ে আসেন, তেমনি লেগস্পিনার এর রাউন্ড দ্য উইকেট যাওয়া প্রধানত রান আটকানোর জন্য। কিন্তু বেনো নিজেও হয়তো ভাবেননি ফ্ল্যাভেল, ট্রুম্যান, ম্যাকেঞ্জিদের তৈরি করা ফুটমার্ক এভাবে তাঁকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ফকির থেকে রাজায় উন্নীত করবে।
বেনোর বলে ডেক্সটার আউট হতেই, তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো ইংল্যান্ডের প্রতিরোধ। বেনো শেষ করলেন ৬ উইকেট নিয়ে, ইংল্যান্ড ম্যাচ হারলো ৫৪ রানে। সেই প্রথম ক্রিকেট বিশ্ব বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলো, লেগস্পিনার রাউন্ড দ্য উইকেট এসে রান আটকানো ছাড়াও, গোছা গোছা উইকেট তুলতে পারে।
ক্রিকেট সম্প্রচারে বিপ্লব নিয়ে আসা চ্যানেল নাইনের প্রধান ভাষ্যকার ও সঞ্চালক রিচি বেনো, লেগস্পিন বোলিংয়েও যে বিপ্লব এনেছিলেন তা আধুনিক কালে শেন ওয়ার্নকে সর্বকালের সেরা লেগ স্পিনার বানাতে অন্যতম ভূমিকা নিয়েছিল।