এখনও গল্প লেখো, গান গাও প্রাণ ভরে

একটা ধুঁকতে থাকা দেশের অর্থনীতি। একটা ঋণের পাহাড় মাথায় নিয়েও কোনো রকমে টিকে থাকা দেশ। দারিদ্র সীমার নিচে থাকা হাজারে হাজারে মানুষ। বস্তি এলাকা ঘিরে ফেলছে রোজারিও কিংবা বুয়েনস আয়ার্স শহরের চারপাশ। অপত্য লালন-পালনের অভাবে স্বাভাবিকভাবেই জন্মহার বাড়িয়ে চলেছে নিম্ন মধ্যবিত্ত আর হত দরিদ্র আর্জেন্টাইনরা।

সময়টা ১৯৭৮ সাল। আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে নামছে কেম্পেস, পাসারেল্লা কিংবা গ্যালভানের চওড়া কাঁধে ভর করে, এই উন্মাদনার মাঝেই সান ফার্নিন্দোর এক হত দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিলেন প্রথম সন্তান রিকুয়েলমে। পরে জন্ম হয়েছিল তাঁর ১১ জন ভাই বোনের, বস্তির ঘিঞ্জি ঘর থেকে আকাশ দেখা হত না রিকুয়েলমের, ফার্দিনান্দোর অন্যান্য স্ট্রিট চাইল্ডদের সাথে ফুটবল খেলতে খেলতে কখন যেন এসে পড়া আর্জেন্টিনোস জুনিয়র দলে।

নজরে পড়লেন বোকা জুনিয়র্স আর রিভার প্লেটের দায়িত্বে থাকা নির্বাচকদের, সিলেকশনের সময় রিকেলমের পরিবারকে জানানো হয়েছিল যে সুযোগ পেলে ঘর ছাড়তে হবে পরিবারের বড় ছেলেকে। বুকে কষ্ট জমিয়ে রেখেও না করেননি বাবা, কারণ তিনি জানতেন ১১ জন সন্তানের ভরণ পোষণের জন্য রিকুয়েলমের অর্থ উপার্জন বড় প্র‍য়োজন।

বোকা জুনিয়ার্সে আসার আগে আর্জেন্টিনার রাস্তায় বল জাগলিং করে টাকা কামানো শুরু হল রিকেলমের, সারাদিন শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে পায়ে আর মাথায় বল নিয়ে রিকুয়েলমে তখন নীল-সাদা পতাকার দেশে জ্বালিয়ে দিচ্ছেন লক্ষ ওয়াটের আলো, বোকা জুনিয়ার্সে পায়ে বল নিয়ে নামতেই আর পিছু ফিরে তাকাতে হল না রিকুয়েলমে-কে, মাঝমাঠে আলবিসিলেস্তেরা বহুবছর বাদে পেল মারাদোনা-কেম্পেসের পর তাদের রূপকথার আর এক নায়ককে।

২৪ জুন বলেই হয়ত কেউ মনে রাখে না রিকুয়েলমে-কে, ২৪ শে জুন বলেই হয়ত মানুষ ভুলে যায় যে এই লোকটাকে দেখে একদিন স্প্যানিশ মিডিয়া লিখেছিল ‘Technically strongest player ever in argentine history’, ২৪ জুন বলেই হয়ত রাজকীয় নাটমেগের পাশে ফিকে হয়ে যায় কোপা আমেরিকায় সামনে এগিয়ে দেওয়া ম্যাজিকাল থ্রু-পাসগুলো, ২৪ শে জুন বলেই বোধ হয় বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা এক প্রতিভার গলি থেকে রাজপথে উত্থানের কাহিনীর জৌলুস ফিকে হয়ে যায় একটু্

রিকুয়েলমে নন ডিয়েগো ম্যারাডেনার, রিকুয়েলমে লিওনেল মেসিও নন কিন্তু মেসি-ম্যারাডোনা অন্তর্বর্তী সময়ে আর্জেন্টিনার হাজার হাজার অসহায়, হতদরিদ্র সমর্থকের যষ্ঠি হয়ে উঠেছিলেন হুয়ান রোমান রিকুয়েলমে। ব্রাজিলের চূড়ান্ত আধিপত্যের সময় রোনালদো, রিভালদো, রোনালদিনহো গাউচো, আদ্রিয়ানো কিংবা রবিনহোদের রাজকীয় উত্থানের পাশে এক একলা আর্জেন্টাইন সৈনিকের নাম রিকুয়েলমে।

২০০৭ সালের কোপা ফাইনালে নামার আগে দুর্ধর্ষ ব্রাজিলের সামনে ত্রাস ছিলেন আলবিসিলেস্তের ১০ নম্বর জার্সির প্রাক্তন মালিক – ট্রফি ক্যাবিনেট তাঁকে ফিরিয়ে দেয়নি হয়ত তাঁর প্রাপ্যটুকু কিন্তু হাজার হাজার ফুটবলপ্রেমীর মনে রিকুয়েলমে আছেন, ২৪ জুন জন্মদিন হলেও তিনি আছেন। নীল ধ্রুবতারার ঔজ্বল্যের পাশে যে নি:সঙ্গ শুকতারা ফিঁকে হলেও চিরকাল নিজের সবটুকু আলো উজাড় করে দেয় ফুটবল তাকে ফিরিয়ে দেয় অনেক কিছু।

ফুটবল তাকে ফিরিয়ে দেয় ‘জুয়ান রোমান রিকুয়েলমে’- করে, কোনো প্রত্যাশা না রেখেই যে আজও গল্প লেখে, খোলা মাঠে গেয়ে যায় ফুটবলের জয়গান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link