ভাই-বন্ধু-শত্রু!

অবিকল সিনেমার গল্পের বাস্তব চিত্রায়ন। ভাবুন তো আপন দুই ভাইয়ের বয়সের ফারাক মোটে এক বছর। কি করবে তারা মারামারি, খুনশুটি, ঝগড়াঝাটি এবং অবশ্যই খেলাধুলা। এই খেলাধুলা করতে করতে যে একদিন দুই ভাইকে মুখোমুখি হতে হবে নিজেদের বিপক্ষে তা নিশ্চয়ই রোমাঞ্চকর একটি ঘটনা।

তা যদি হয় আবার ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালকে ঘিরে তাহলে ঘটনার তীব্রতা কিংবা রোমাঞ্চ যে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় গিয়ে ঠেকবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কি মনে হচ্ছে না সিনেমার গল্প? চলুন তাহলে সিনেমা শুরু করা যাক ছেলে বেলা থেকেই।

আর্জেন্টিনার বুয়েন্স আয়ারস নামক ছোট্ট একটি শহরে সুখী দম্পতি জর্জ-মির্তা মিলিতো। তাদের ঘর আলো করে এলো দু’টি পুত্র সন্তান, এক বছরের ব্যবধানে। বাবা-মা বড় ছেলের নাম রাখলেন ডিয়েগো মিলিতো এবং ছোটটার রাখলেন গ্যাব্রিয়েল মিলিতো। খুনশুটি, মারামারি, খেলাধুলা করে দুইভাই পার করেন তাঁদের শৈশব, কৈশর। বয়সটা আঠারো পেরোলেই দুই ভাইয়ের ফুটবল খেলার দক্ষতা তাঁদেরকে আলাদা করে দিলো, আলাদা নয় শুধু একে অপরের প্রতিপক্ষ বনে গেলেন তাঁরা।

বড় ভাই ডিয়েগো যোগ দিলেন স্থানীয় ক্লাব রেসিং ক্লাবে আর ছোট ভাই গ্যাব্রিয়েল চলে গেলেন শহর প্রতিদ্বন্দ্বী ইন্ডিপেন্ডেন্ট এফসির ডেরায়। শুরু হলো দুই ভাইয়ের ফুটবলীয় রেষারেষি। সবচেয়ে মজার বিষয় বড় ভাই ডিয়েগো ছিলেন আক্রমণ ভাগের খেলোয়াড় আর ছোট ভাই গ্যাব্রিয়েল খেলতেন রক্ষণে৷

কি মধুর দ্বন্দ্ব! বেশ ক’বার আর্জেন্টিনার ক্লাবগুলোতে নিজেদের প্রতিপক্ষ হিসেবে খেলার দিনের অবসান ঘটিয়ে সহদর দু’জন পাড়ি জমালেন স্পেনে। জারাগোজা ফুটবল ক্লাবের হয়ে পেশাগত ফুটবল জীবনে একসাথে প্রায় আঠারো মাস খেলার সুযোগ পান তাঁরা।

ডিয়েগোর অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্য আর গোল করবার ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে স্পেন থেকে ইতালির ক্লাব ইন্টার মিলানে নিয়ে যান তৎকালীন কোচ হোসে মরিনহো। ২০০৯-১০ মৌসুমে মরিনহোর ট্রেবল জয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন ডিয়েগো মিলিতো।

অন্যদিকে তৎকালীন আরেক জায়েন্ট বার্সেলোনাতে যোগদান করেন গ্যাব্রিয়েল। ২০০৭ সালে জারাগোজা থেকে বার্সাতে আসেন তিনি।

২০০৯/১০ মৌসুমে দু’দলই নিজেদের দ্যুতি ছড়াচ্ছিলেন ইউরোপীয় ফুটবল অঙ্গনে। সমূহ সম্ভাবনা ছিল তারা ইউরোপীয় ক্লাব পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের আসর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মুখোমুখি হতে চলেছেন। নিয়তির কি পরিহাস! একই গ্রুপে ঠাঁই হয় দুই দলের। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শেষে এফ গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরবর্তী রাউন্ডে পা রাখে পেপ গার্দিওলার বার্সেলোনা। দুইটি জায়েন্ট দলেরই সম্ভাবনা ছিল প্রখর, শ্রেষ্ঠত্বের আসন দখল করবার৷

দুই ক্লাবের সাফল্য একই সাথে যতটা উজ্জ্বল ছিলো দুই ভাই ডিয়েগো ও গ্যাব্রিয়েলের ভাগ্য তেমনটা ছিল না। যদিও ডিয়েগো ইতালিয়ান ক্লাবটাকে সিরি ‘এ’-তে চ্যাম্পিয়ন বানাতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু গ্যাব্রিয়েলের সময় কেটেছিল ইনজুরি আক্রান্ত হয়ে। প্রায় দুই বছর মাঠের বাইরে থেকে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে মাঠে ফেরেন গ্যাব্রিয়েল।

এদিকে বার্সেলোনা স্টুটগার্ট ও আর্সেনালকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে। অন্যদিকে ইন্টার হারিয়েছিল চেলসি আর সিএসকেএ মস্কোকে। নিয়তি ফাইনালের আগেই ফাইনালের উত্তাপ ছড়াতে আবার মুখোমুখি করেছিল তৎকালীন সেরা দুই ক্লাব বার্সা ও ইন্টারকে।

ক্লাব পর্যায়ে বেশ কবার মুখোমুখি হয়েছিল এই মিলিটো সহদরদ্বয়৷ তবে প্রতিবারই ছোট ভাইয়ের সম্মুখে নিজের পুরোটা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন বড় ভাই ডিয়েগো। এমনকি তাঁদের স্বদেশের ক্লাব ডার্বির এক ম্যাচে ডিয়েগো মাত্র ১৫ মিনিটে লাল কার্ড দেখে মাঠ ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে বার্সা-জারাগোজার মধ্যকার দুই ম্যাচে মিলিটো সহদর মুখোমুখি হয়েছিল, দুই ম্যাচেই ডিয়েগো গোল করতে ব্যর্থ হয়।

২০০৯-১০ মৌসুমের উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমির প্রথম লেগে মাঠে নামা হয়নি গ্যাব্রিয়েলের। দলে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে বহুদিন মাঠের বাইরে থাকা খেলোয়াড় খেলিয়ে হয়ত ঝুঁকি নিতে চাননি কাতালান কোচ পেপ গার্দিওলা। তবে ডিয়েগো খেলেছেন এবং সেন সিরো তে ইন্টারের জয়ে রেখেছেন অবদান। করিয়েছিলেন দুই গোল করেছিলেন এক গোল। একাই যেন ঘরের মাঠের সেরা পার্ফরমার ডিয়েগো মিলিতো। সাইডলাইন থেকে ভাইয়ের অভাবনীয় খেলা বসে বসে দেখেছেন গ্যাব্রিয়েল মিলিতো।

তবে পরবর্তী লেগে মাঠে নামার সুযোগ হয়েছিল গ্যাব্রিয়েল মিলিতোর। কার্ড জটিলতায় বার্সা অধিনায়ক কার্লোস পুয়োল ম্যাচ খেলতে না পারায় একাদশে সুযোগ হয় গ্যাব্রিয়েলের। কিন্তু খুব বেশিকিছু কারোই করার ছিল না গ্যাব্রিয়েল কিংবা ডিয়েগোর। মরিনহোর সেই স্পেশাল বাস পার্কিং ট্যাক্টিসে ডিয়েগোকেও সামাল দিতে হয়েছে ইন্টারের রক্ষণ দূর্গ। ম্যাচটি বার্সা ১-০ তে জিতলেও দুই লেগ মিলিয়ে ইন্টার চলে যায় তাদের ট্রেবল জয়ের দাড় প্রান্তে।

আবারও সেই ডিয়েগো মিলিতো, আবারও তাঁর একক নৈপুণ্যে। বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে একাই দুই গোল করে নিজের ক্লাব ইন্টার মিলানকে এনে দেন শিরোপা, আর দল পায় ট্রেবেল জয়ের অমৃত স্বাদ।

অবশ্য পরবর্তী মৌসুমেই বার্সার হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতেন গ্যাব্রিয়েল।

ক্লাব ফুটবলে দ্বৈরথ থাকলেও দুই ভাই কিন্তু পাশাপাশি খেলেছেন জাতীয় দল আর্জেন্টিনার হয়ে। সিনেমার শেষটায় দু’জনকে আবার এক সাথে কোন ক্লাবে খেলতে দেখার আক্ষেপটা বাড়িয়ে তাঁরা ইতি টানেন তাঁদের ফুটবলীয় ক্যারিয়ারের। ইউরোপীয় ফুটবলে দুই সহদরের দ্বন্দের সমাপ্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link