২০১৯ বিশ্বকাপের আগেই আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশিয় সিরিজ জিতে বাংলাদেশ দল। সেখানে দলের সেরা বোলার ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। অথচ, ঠিক পরের টুর্নামেন্টে, মানে বিশ্বকাপেই তিনি চূড়ান্ত ফ্লপ। আর ব্যর্থতার খাতাটা এতটাই পূর্ণ ছিল যে, বিশ্বকাপের মাঝপথেই একাদশ থেকে বাদ দেওয়ার জোর দাবি উঠেছিল।
মাশরাফি চাইলে সেই বিশ্বকাপটা দিয়েই বিদায় নিতে পারতেন, মাথা উঁচু করে। তিনি করেননি। ২০২০ সালের অনেকটা জোর করেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) তাঁকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। সতীর্থরা মাশরাফিকে কাঁধে চড়িয়ে বিদায় জানায়। মাশরাফি তখনও ক্রিকেটকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিদায় জানাননি। তিনি বারবারই বলে এসেছেন, বিদায় জানানোকে তিনি জরুরী মনে করেন না।
মাশরাফিকে বাংলাদেশ ক্রিকেটে এখন অতীতই বলা যায়। ক্রিকেট কিংবা যেকোনো পারফরমিং আর্টই আসলে এমন। এখানে কাল যিনি রাজা ছিলেন, আজ হয়তো তাঁর দিকে কেউ ফিরেও তাকাবে না। এখানে সময়, পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট খুব দ্রুতই বদলে যায়। এখানে সময় ভাল থাকতে থাকতে বিদায় নিতে পারাটাও আলাদা একটা শিল্প।
সেই শিল্পটা আয়ত্তে আনতে পারেননি মাশরাফি। কোনো সন্দেহ ছাড়াই তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় কিংবদন্তি। তাঁকে পুরো বাংলাদেশ মাথায় তুলে বিদায় বলার সুযোগ পাননি। কে জানে, এমন সুযোগ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও আদৌ দিবেন কি না!
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসটা খেলেই টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছেন। নি:সন্দেহে সাহসী একটা সিদ্ধান্ত। আর ওই জায়গাটাতে এখন তরুণদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা সুযোগ পেতে পারেন।
একই কথা ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রিয়াদ এখন সাদা বলের ক্রিকেটেও নিজের নামের প্রতি একদমই সুবিচার করতে পারছেন না। আসলে পারবেনই বা কি করে, বয়সটা যে ৩৬। তাঁর ব্যাটিং রিফ্লেক্স নষ্ট হয়ে গেছে, হ্যান্ড আই কম্বিনেশন নেই বললেই চলে। স্ট্রাইক রোটেট করতে পারেন না ঠিক মত। যতক্ষণ তিনি ক্রিজে থাকেন, যথেষ্ট কুৎসিত লাগে।
এমনকি এমন ম্যাচ খুঁজে পাওয়া কঠিন, যেখানে রিয়াদ ফিল্ডিংয়ে বড় কোনো ভুল করছেন না। অথচ, তিনিই নাকি টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক, যেটা তারুণ্যের খেলা। প্রতিনিয়ত নিজের সাথে পাল্লা দেওয়ার খেলা। প্রতিটা ম্যাচেই যেন একটু একটু করে সমস্যাগুলো আরো বেশি ঘণিভূত হচ্ছে।
রিয়াদ এক সময় ফিনিশার ছিলেন, প্রয়োজনে ইনিংস বিল্ড আপও করতে পারতেন। সেটা এখন আর পারছেন না। হ্যাঁ, তিনি আমাদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা। কিন্তু, ওই যে যেকোনো পারফর্মিং আর্টের বাস্তবতাই তো এমন। এখানে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। যত দিন এগোবে, ততই সেরা সময়টা অতীত হতে থাকবে।
একটা সময় ওই একই আর্টই করতে গেলে সেটা খুব কুৎসিৎ দেখাবে, যেটা এখন রিয়াদের ক্ষেত্রে হচ্ছে। নিজের চূড়ান্ত সেরা সময়ে হয়তো তিনি পরপর দুই ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করতে পারতেন, দুই এক ম্যাচ বাদে বাদে হাফ সেঞ্চুরি করতে পারবেন। এখন পারছেন না, পারার কথাও নয়। হয়তো তারপরও কখনও কখনও একটা হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলবেন, কোনো একদিন হয়তো হাত খুলে রান করবেন, খুব পেটাবেন বোলারদের। কিন্তু সেটা তাঁর কোয়ালিটির জোরে। সেই পারফরম্যান্সটা আগের মত ধারাবাহিক হবে না। এই বয়সে, এই ফিটনেসে সেটা সম্ভবই নয়!
রিয়াদের এই শেষটার সাথে মাশরাফির শেষের মিল আছে। মাশরাফির ক্যারিয়ারের শেষটা সুখকর হয়নি। আগে যার দলে থাকা, অধিনায়কত্ব করা নিয়ে কোনো প্রশ্নই ওঠেনি – সেই মাশরাফিকে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের পর। সেই প্রশ্নটা আজকাল রিয়াদকে নিয়েও উঠছে। দু’জনের প্যাটার্নটা ঠিক একই রকম। শুরুতে চাপা অসন্তোষ, ফিঁসফাস। এরপর সরাসরি সমালোচনা, এরপর চূড়ান্ত ট্রল – ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি।
রিয়াদের উচিৎ সময় থাকতেই কিংবদন্তি হিসেবে বিদায় নিয়ে ফেলা। রিয়াদের উচিৎ আরও অসুন্দর কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগেই বিদায় বলা। রিয়াদ আমাদের হিরো। তাঁকে মাথায় তুলে বিদায় বলতে চাই, রোজ রোজ তাঁর বাদ পড়া কামনা করতে চাই না। মাশরাফির মত আরেকটি ঝরে পড়া দেখতে চাই না।