১৬ মে, ২০০৪। সান সিরো স্টেডিয়ামের প্রতিটা দর্শক, প্রতিটা মিনিট মুখর হয়েছিল তাঁর নামে। যতবার তিনি বলে টাচ করছিলেন ততবারই দর্শকদের চাঞ্চল্য দ্বিগুন হচ্ছিল। ম্যাচের ৮৪ মিনিটের মাথায় অবশেষে বদলি হয়ে নেমে যেতে হল। শেষ বারের মত। পুরা গ্যালারির দর্শক দাড়িয়ে তাকে ফুটবল মাঠ শেষ বিদায়টা দিল অশ্রুভরা চোখে। প্রতিপক্ষ অধিনায়ক পাওলো মালদিনি তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন, জড়িয়ে ধরলেন।
‘ব্যাজ্জিও! স্টিল বাজ্জিও! স্টিল বাজ্জিও! হোয়াটট্যা গোল বাই বাজ্জিও! দ্যাটস দ্যা গোল দ্যা অল হ্যাভ বিন ওয়েটিং ফর।’
____________________
ইতালির দর্শকদের সামনে ৯০ বিশ্বকাপে চেকেস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে মাঝ মাঠ থেকে ড্রিবল করে অসাধারণ গোলটা করে পুরো ইতালিবাসীকে সেদিন উচ্ছাসে ভাসিয়েছিলেন আর পৃথিবীকে জানন দিয়েছিলেন তাঁর আগমনী বার্তা।
কিন্তু, বাস্তবে তাঁর আগমন হয়েছিল আরো কিছু মৌসুম আগে। অংকের ভাষায় চার বছর। ‘কাল্দোগনো’র একটি গ্রামে তার ফুটবলে হাতেখড়ি হওয়ার পর ১১ বছরের মাথায় আশেপাশের অন্যান্য ক্লাবের নজরে আসে তাঁর প্রতিভা। স্থানীয় ক্লাবে মাত্র ২৬ ম্যাচে ৪৫ গোল করে বসেন। ১৩ বছর বয়সে ইয়থ টিম ভিসেঞ্জের হয়ে ১২০ ম্যাচে ১১০ গোল করেন। এরপরের মৌসুমেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাকে সিনিয়র দলে প্রমোট করা হয়।
সমস্যা হল তার দল ছিল সিরি ‘সি’ এর একটা টিম। কিন্তু প্রতিভা লুকিয়ে রাখার জিনিস না। তৃতীয় মৌসুমে তাঁর দলকে সিরি ‘বি’ তে তুলে আনার পর তাঁর পিছনে লেগে যায় ইতালির বড় ক্লাবগুলোর টানাটানি। জুভেন্টাসকে হারিয়ে মাত্র দেড় পাউন্ডে তাঁকে কিনে নেয় ফিওরেন্তিনা।
কিন্তু, তাঁকে কিনে উৎসব করার ঠিক আগ মুহুর্তেই ঘটে যায় বিপত্তি। ডিল ফাইনাল দুই দিন আগে হাঁটুর লিগামেন্ট ছিড়ে গিয়ে ক্যারিয়ারের হুমকিতে ফেলা ইনজুরিতে পড়েন ব্যাজ্জিও। কিন্তু ফিওরেন্তিনা তার উপর আস্থা রাখে এবং তাদের প্রস্তাবের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাকে কিনে শেষ পর্যন্ত।
সেই সাথে তাকে ফ্রান্সে ভাল চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় – যেটা ক্লাব ও খেলোয়াড়ের সম্পর্ককে শক্তিশালী করে। কিন্তু সেটা এমন এক ইনজুরি ছিল যেটা তিনি বয়ে বেড়ান তার পুরা খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারে। দুই মৌসুম প্রায় না খেলেই কাটান এই ম্যাজিশিয়ান।
কিন্তু যখনই ফিওরেন্তিনার শার্ট পড়ে খেলা শুরু করেন, তিনি খুব দ্রুতই সবার খুব কাছের হয়ে গেলেন। সাম্পোদোরিয়ার বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচ খেলেন এবং প্রথম গোল করেন চ্যাম্পিয়ন ন্যাপোলির বিপক্ষে। তিনটি দুর্দান্ত মৌসুম পার করেন ফ্লোরেন্সে। ফ্যান্টাসিস্তা অর্থাত প্লেমেকার হয়েও করেছেন একের পর এক গোল। ২০ টার উপর করে গোল করেছেন ওই তিন মৌসুমে। কিন্তু শুধু গোলসংখ্যা তার পক্ষে কথা বলার জন্য যথেষ্ট ছিল না।
গোলের চেয়েও বড় ব্যাপার ছিল কোয়ালিটি, বৈচিত্র। সবদিক থেকেই অসাধারণ – কার্ল করে যেমন গোল দিত, তেমনি ভলি থেকে। ড্রিবল করে যেমন গোল ছিল তেমনি ছিল ফ্রি-কিক এবং ঠান্ডা মাথার ফিনিশিং। পুরা একটা কমপ্লিট প্যাকেজ ।
তাঁর খেলাটা এতই মুগ্ধ করছিল যে ততকালীন আর্জেন্টাইন এবং ভিওলা মিডফিল্ডার মিগুয়েল মন্টুরি বলেই বসলেন, ‘ব্যাজ্জিও ম্যারাডোনা থেকেও প্রোডাক্টিভ। কোন সন্দেহ ছাড়াই সে বেস্ট নাম্বার টেন।’
৮৮ তে জাতীয় দলে প্রথম ডাক পান নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। কিন্তু প্রথম গোলটা করেন ট্রেডমার্ক ফ্রি-কিক থেকে উরুগুয়ের বিপক্ষে – ওই ম্যাচেই প্রথমবারের মত প্রথম একাদশে সুযোগ পান বাজ্জিও। এদিকে ফ্লোরন্সের দলকে উঠান উয়েফা কাপের ফাইনালে।
যদিও জুভান্তাসের সাথে ন্যূনতম ব্যবধানে হারে তাঁর দল কিন্তু সেই সাথে ইউরোপের বাকি দলগুলোর নজরে চলে আসেন ইতোমধ্যেই। অবশেষে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাঁকে তার ক্লাব জুভেন্টাসের কাছে বিক্রি করে দেয় ৯০ বিশ্বকাপের আগে।
রেকর্ড ৮ মিলিয়ন ট্রান্সফার ফিটা ব্যাজ্জিওর জন্য খুব সুখোকর ছিল না কারণ ফিওরেন্তিনার দর্শক এটাকে মেনে নিতে পারেনি এবং ব্যাজ্জিওর উপর ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। সেটা এতই বেশি ছিল যে ফ্লোরেন্সের রাস্তার ট্রান্সফারের বিপক্ষে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায় যেটাতে প্রায় ৫০ জন আহত হয়। ৯০-৯১ এর জুভেন্টাস বনাম ফিওরেন্তিনার মধ্যকার ম্যাচে জুভেন্টাস পেনাল্টি পায় । কিন্তু সদ্য ছেড়ে আসা ক্লাবের বিপক্ষে পেনাল্টি নেননি ব্যাজ্জিও।
যদিও তিনি সেটা তার সাবেক দলের বিপক্ষে শ্রদ্ধা দেখাতে কাজটা করেন। কিন্তু সেটা তাঁকে দু’দিক থেকেই ফেলে বিতর্কে যখন পেনাল্টি থেকে তার সতীর্থ গোল করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে জুভেন্টাসের ফ্যানদের মৃদু কোপানলে পড়েন ব্যাজ্জিও – যদিও ব্যাজ্জিও তাঁর সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেন এই বলে যে ফিওরেন্তিনার গোলরক্ষকের কাছে তিনি পরিচিত। ম্যাচ শেষে মাঠ ছাড়ার সময় এক ফিওরেন্তিনা সমর্থক তার দিকে স্কার্ফ ছুঁড়ে মারে যেটাতে মাটি থেকে কুড়িয়ে ব্যাজ্জিও চুমু খান। পরে অবশ্য সেটি তার কিছুটা সমালোচনা কমায় ফ্লোরেন্তিনোবাসীর কাছ থেকে।
কিন্তু তার নতুন ভক্ত কূলকে কিভাবে শান্ত করবেন? উত্তর হতে পারে একটাই – যেভাবে কিংবদন্তিরা করে থাকেন। পরের তিন বছর পুরা বিশ্ব তার পায়ের যাদুর মোহে ছিল। জুভেন্টাসের হয়ে পাঁচ বছরে নিয়ে যান বিশ্বসেরার আসনে। ৯৩ সালে জিতে নেন ফিফার বর্ষসেরা এবং ব্যালন ডি অর পুরষ্কার।
দেল পিয়েরোর আগমনে কোচ মার্সেলো লিপ্পি ব্যাজ্জিওর চেয়ে তরুণ তুর্কিকে ব্যাবহার করতে বেশি আগ্রহী হন, লজ্জাজনক ব্যাপার এটা তাঁকে এসি মিলানে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দেয়। যদিও সেখানে গিয়ে লিগ জেতেন কিন্তু ট্যাকটিকসের চাদরে ঢাকা মঞ্চে তাঁর মত জাদুকরের খুব কমই যোগ্য সম্মানটা পান। প্লাতিনির ১০ নাম্বারটা পেয়েছিলেন জুভেন্টাসে।
এসি মিলানে ১৮ নম্বরটা ছিল বেমানান। তার ওপর ইনজুরি, সাথে বেঞ্চে সময় কাটানো। মেনে নিতে পারেননি। তাই বেছে খুবই ছোট একটা ক্লাব। বোলগনা, উদ্দেশ্য একটাই – শেষ সময়টা রাজার মত কাটানো। সেখানে বাজ্জিও খেলার পূর্ণ স্বাধিনতা পায় যেটা পরবর্তীতে ৩০ ম্যাচে ২২ গোল করার মাধ্যমে ফিরে আসেন।
সেই সাথে সেটা তাঁকে জায়গা করে দেয় ১৯৯৮ বিশ্বকাপের দলে। বিশ্বকাপের পর আবারো মিলানে ফিরেন ব্যাজ্জিও, কিন্তু ইন্টার মিলান – যেখানে আবারো কোচ হিসেবে পান মার্সেলো লিপ্পিকে যেটা ব্যাজ্জিওর জন্য আরো সমস্যার কারণ হয়ে দাড়ায়। সোজা কথায় লিপ্পি আর বাজ্জিওর সম্পর্ক ছিল সাপে নেউলে। এমনকি ট্রেইনিং সেশনে ব্যাজ্জিও’র কেউ প্রশংসা করলে লিপ্পি তাঁদেরকে কড়া কথা শুনিয়ে দিত।
ব্যাজ্জিওর সাথে লিপ্পির আচরণ অজানা ছিল না মিডিয়ার কাছে যেটা লিপ্পিকে সব সময়ই বিতর্কে রাখত। ব্যাজ্জিও হলেন ফুটবল যাদুকর। হয়তো সেটা মানতে পারতেন না লিপ্পি। কিন্তু এভাবে তো চলে না । তাই তাকে আবারো দল ছাড়তে হল । কিন্তু যাওয়ার আগে ইন্টারকে উপহার দিয়ে গেলেন রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে দুটো লেট গোল করে। পার্মার বিপক্ষে শেষ ম্যাচ খেলতে নেমে দুই গোল করে ইন্টারকে চ্যাম্পিয়নস লিগের প্লে অফের জন্য কোয়ালিফাই ও করিয়ে দিয়ে যান ব্যাজ্জিও।
হয়ত এটাই হতে পারত শেষ। কিন্তু ‘নেভার গিভ আপ’ মানসিকতার ব্যাজ্জিও আবারো বেছে নেন একেবারে ছোট একটা ক্লাব ব্রেসিয়াকে। আবারো ১০ নম্বর জার্সি। কিন্তু আবারো এক মাসের ইনজুরি। যখন ফিরলেন , তার দল ছিল একেবারে তলানীতে। কিন্তু সেটা বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। ফ্যান্টাস্টিক ফ্যান্টাসিস্তার অনুপ্রেরণার সাথে ১০ গোল (অ্যাসিস্টের কথা নাই বললাম) মৌসুম শেষে তার দলকে ৭ নম্বরে উঠিয়ে দেয়। পরের তিন মৌসুমই বাজ্জিও দারুণ ফর্মে ছিলেন। তাঁর দলকে প্রতিবারই সিরি ‘এ’ তে ধরে রাখেন যেটা ওইরকম একটা ক্লাবের জন্য খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল।
অবশেষে সেই ১৬ মে ২০০৪। যেখানে লেখাটা শুরু করেছিলাম। ব্যাজ্জিও তাঁর পেশাদার ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেন এসি মিলানের বিপক্ষে। সেই ম্যাচে গ্যালারি ছিল হাউসফুল। ম্যাচটা মিলান বনাম ব্রেসিয়া ছিল না, ম্যাচটা ছিল এক কিংবদন্তির বিদায়ের ম্যাচ। ওই ম্যাচটাতে কোন প্রতিপক্ষ ছিল না। দু’দলের ফ্যানই উচ্ছাসে ফেটে পড়ে ব্যাজ্জিওর প্রতিটা টাচে। পুরা স্টেডিয়াম তার পায়ে এসে পড়ল ।
প্রতিভার তুলনায় ব্যাজ্জিওর ক্যারিয়ারের বিতর্কই ছিল বেশি। বিশ্বকাপে ১৬ ম্যাচে ৯ গোল করার পরও তাঁকে মানুষ স্মরণ করে ৯৪ ফাইনালে পেনাল্টি মিসের জন্য। অথচ, ওই বিশ্বকাপে ইতালিকে ফাইনালে আনার মূল কারিগর ছিলেন ব্যাজ্জিও। জাতীয় দলের হয়ে করেছেন ২৭ গোল ৫৬ ম্যাচে। সিরি ‘এ’-তে করেছেন ২০০’র বেশি গোল। একজন প্লে-মেকারের জন্য এটা ছিল আশাতীত একটা সংখ্যা ।
ক্যারিয়ার জুড়ে ছিলেন ইনজুরিগ্রস্থ। ফিউরেন্তিনার শুরুর ইনজুরির প্রভাব এতই বাজে ছিল, অবসরের সময় তিনি বলেন, ‘আমি যদি পুরা ফিট হয়ে ম্যাচ খেলতে চাইতাম তাহলে বছরে দু-তিনটা ম্যাচের বেশি খেলতে পারতাম না।’
সত্যি তিনি খুব বিরল এক উদাহারণ। ৯৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ইনজুরিতে থাকার পরও ফাইনালে খেলেন। পরে বলেছিলেন, ‘আমার যদি এক পাও ঠিক থাকত, আমি খেলতাম।
ব্যাজ্জিও – যিনি কখনোই হাল ছাড়েন না – যেন স্বর্গ থেকে আগত কোন উপহার।
অনেক তারকা – যাদের ঝুলিতে শিরোপা আর রেকর্ডের ছড়াছড়ি, তাদের ভিড়ে এসব কিংবদন্তিদের গায়ে আস্তে আস্তে ধূলি জমতে জমতে একসময় তারা পুরান ঘরের পুরনো সন্দুকের মত লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায় ।