সারাটা ক্যারিয়ার জুড়ে মোটে ১৬.৩ ওভার বল করেছেন। বছর দশেক আগে ভারতের বিপক্ষে এক ম্যাচে ২ উইকেট পেয়েছিলেন। এ ছাড়া উইকেট বস্তুটার সাথে তার বিশেষ খাতির ছিলো না। তারপরও ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচের অন্তিমলগ্নে তাঁর হাতে বল তুলে দিলেন অধিনায়ক।
ক্রিকেট নিয়ন্তা মুচকি হাসছেন তখন। তৃতীয় বলটা করলেন তিনি; পেলেন উইকেট! আহ! কী দারুণ একটা সমাপ্তি। চিত্রনাট্যটা এর চেয়ে ভাল ভাবে লেখা সম্ভব না!
ক্যারিয়ারের শেষ বলে উইকেট নিয়ে ক্যারিয়ার শেষ করলেন কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান রস টেলর। যেন ইতিহাস ভেবে রেখেছিল এমন কিছু একটা। ২০০৭ থেকে ২০২২, শেষ হলো এক কিংবদন্তির উপাখ্যান।
ক্রিকেট বোধহয় তাঁর প্রিয় সন্তানদের এভাবেই বিদায় জানায়। নিজের শেষ টেস্টে ব্যাট হাতে দ্বিতীয়বার নামার সুযোগ পেলেন না। তাই বল হাতে এবাদতের উইকেটটাই ছিল ক্রিকেটের পক্ষ থেকে উপহার। প্রতিদিন কত ব্যাটসম্যানই তো ব্যাট হাতে ওই বাইশ গজে নামেন।
তবে ক্রিকেট আলাদা করে পরিকল্পনা করেন কজনের জন্য। টেলরের জন্য ক্রিকেট করেছে, কেননা টেলর যে ক্রিকেটের এক সোনালি ইতিহাস। সবসময় চুপচাপ থাকা নিপাট এক ভদ্রলোক। কিউইদের হয়ে টানা ১৫ টা বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেললেন।
দেশটির কত জয়ের নায়ক তিনি। তবে নিজেকে কখনো সামনের সারিতে আনতে চাননি। পিছন থেকে সত্যিকারের নায়কের মত দলের জন্য খেলে গেছেন। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের সবচেয়ে খারাপ দিনেও দলটার হাল ধরেছেন। ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে নিয়ে মেরামতের কাজ করেছেন।
নিউজিল্যান্ড আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। একসময় বিশ্বের অন্যতম সেরা দলে পরিণত হয়েছে। কেন উইলিয়ামসনের নেতৃত্বে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে। তবে তখনো দলটার মেরুদন্ড হয়েছিলেন রস টেলর। ব্যাট হাতে যেকোন কন্ডিশনে, যেকোন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে রান করে গেছেন।
কিউই ব্যাটিং লাইন আপটাকে এক যুগ ধরে সামলে রেখেছেন। কত ঝড় এসেছে, কত কিছু তছনছ হয়েছে, তবে এক বট বৃক্ষের মত ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন রস টেলর।
তাঁর ব্যাটিং নিয়ে বিশ্লেষকদের অনেক সমালোচনা ছিল। হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে ক্লাসি ব্যাটসম্যানদের একজন ছিলেন না। লেগ লাইগে খেলতেই বেশি পছন্দ করতেন। তবুও নিজের মত করে ব্যাটিং করে গেছেন। নিউজিল্যান্ডের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসেবেই ক্রিকেটটাকে বিদায় বললেন।
ওয়ানডেতেও ক্রিকেট দুনিয়ার সেরা একজন হিসেবে খেলেছেন। ২৩৩ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ৪৮.২০ গড়ে রান করেছেন। ২১ টি সেঞ্চুরি সহ যার ঝুলিতে আছে ৮৫৮১ রান। এই ফরম্যটেও দেশটির সফলতম। সব মিলিয়ে টেলর বাইশ গজে থাকা মানে যেন নিউজিল্যান্ডের জন্য স্বস্তি। তিনি যতক্ষণ আছে ততক্ষণ একটা আশা আছে।
তবে এখন থেকে আর ব্যাট হাতে কিউইদের হয়ে মাঠে নামবেন না। বাইশ গজে আঁকড়ে পড়ে থাকবেন না। মিডল অর্ডারে কিউইদের এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হবে। এই জায়গাটায় যেই খেলতে আসবে তাঁর কাছে এক ট্রেডমার্ক হয়ে থাকবেন রস টেলর। যেন টেলরকে ছুঁতে পারার এক আকুতি।
ব্যাটটাকে এবার উঠিয়ে রাখবেন একেবারে। ক্রিকেট মাঠে তাঁকে আর দেখা যাবে কিনা তা হয়তো তিনিই জানেন। অন্তত ক্রিকেট গুরু হয়ে তাঁর মানের ব্যাটসম্যান তৈরির ব্রত পালন করবেন, হয়তো করবেন না। তবে ওই বাইশ গজ চিরকাল মনে রাখবে নীরব-শান্ত আবার জিহ্বা বের করে বুনো উল্লাস করা দুই ভিন্ন চরিত্রের এক রস টেলরকে।
তাইতো যাবার আগে বলে গেলেন, ‘সব ভালোরই তো একটা শেষ আছে, আমার জন্য সেই শেষের সময়টা এসেছে। আর কয়েকটা ওয়ানডে ম্যাচ, এরপর হয়তো জীবনের নতুন কোন অধ্যায় শুরু হবে।’ টেলরকে তাঁর নতুন অধ্যায়ের জন্য শুভকামনা।