রুবেল হোসেন ধাঁধা-সংকট

বাংলাদেশ দলে পেসার ছিল ছয় জন। এই ছয় জনের বিশেষত্ব হল এই ছয়জনের প্রত্যেককে নেওয়ার পেছনে নির্দিষ্ট কারণ আছে, নিজেদের কিছু বিশেষ শক্তিমত্তাও আছে। তাছাড়াও এই ছয়জনের প্রত্যেকেই কমবেশি একাদশে সুযোগ লাভের একটা দাবি জানাতে পারে। বুঝতেই পারছেন, এই ছয়জন থেকে একাদশে তিনজনকে সুযোগ দেওয়া ছিল টিম ম্যানেজমেন্টের জন্যে যথেষ্ট কঠিন কাজ। এই কঠিন কাজটা করতে গিয়ে প্রাপ্য কাউকে সাইডবেঞ্চেও রাখতে হবে এটাও তো জানা কথাই।

তা হয়েছেও কিন্তু তাই। একাদশে থাকার যোগ্য দাবিদার ছিলেন সাইফউদ্দিন, বিশেষ করে গত বিশ্বকাপে এমন পারফরম্যান্সের পর পেস বোলিং ইউনিটে বিশেষ করে স্লগ ওভারে সাইফউদ্দিনের বিকল্প দেখাটা কঠিন ছিল বাংলাদেশ দলের জন্যে। তা সেই সাইফউদ্দিনকেও বসিয়ে রাখা হয়েছে , বসিয়ে রাখা হয়েছে ডেথ ওভারে আরেক বিশেষজ্ঞ আল-আমিনকেও, নতুন বলে শরিফুলের কথা আপাতত তুললাম না।

সুতরাং, এদের বসিয়ে রেখে যাদের দলে নেওয়া হয়েছে তাঁরা নিশ্চয়ই যোগ্য ছিল? মুস্তাফিজ আর হাসান মাহমুদের বেলায় কথাটা সত্যি হলেও রুবেলের পারফরম্যান্স কিন্তু এক রকম ভিন্ন কথাই বলছে। প্রথম ওয়ানডেতে ৬ ওভার বল করেছিলেন, উইকেটের ঝুলিতে ভাঁড়ে মা ভবানী। শুধু তাই না, দলের সবচেয়ে বেশি ইকোনমির (৫.৭) বোলারও তিনি। এর চাইতে ভয়ংকর কথা হল, রুবেলের বোলিংয়ে আক্রমণের ছিটেফোটাও দেখা যায়নি। সদ্য অভিষিক্ত হাসান মাহমুদও যেখানে তাঁর ঝুলিতে ৩ উইকেট পুরেছিলেন, রুবেল সেখানে একেবারেই হতাশ করেছেন।

এখানে আরেকটা ব্যাপার নিয়েও কথা বলতে হবে, এই ওয়ানডেতে রুবেল বল হাতে ওপেন করেছিলেন। পিচে সারারাতের শিশির ছিল, আকাশ মেঘলা ছিল, উইকেটেও অনভিজ্ঞ দুই ওপেনার ছিলেন। মোটামুটি পেস বোলিংয়ে তাণ্ডব চালানোর একটা সুযোগই ছিল রুবেলের সামনে, কিন্তু রুবেল তাতে সম্পূর্ণই ব্যার্থ!

প্রথম ওয়ানডে ছেড়ে দ্বিতীয় ওয়ানডের দিকে ফেরা যাক। প্রথম ম্যাচে এই বোলিংয়ের পরও দল তাকে দ্বিতীয় ওয়ানডের একাদশে নিয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে দল রুবেলকে বেশ বড়সড় বিশ্বাসই করে। কিন্তু, সেই বিশ্বাসের প্রতিদান দিয়ে  দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও রুবেল নিজের ঝুলিতে কোন উইকেট পুরতে পারলেন না।

এ ম্যাচে অবশ্য ইকোনমিটা বেশ কমিয়ে এনেছেন (৩.৩), কিন্তু উইন্ডিজের এই দ্বিতীয় (নাকি তৃতীয়?) সারির দলের বিপক্ষেও যদি ঘরের মাঠে কোন পেসারকে শুধু ইকোনমি নিয়েই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে হয়, তাহলে তো সেই পেসারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টেকার মনোভাব নিয়েই একটা বড় প্রশ্ন তুলে দেওয়া যায় অবলীলায়।

এখন, আপনি এমনটা ভাবতে পারেন যে করোনাকালের দীর্ঘ বিরতির পর ফিরেছে ক্রিকেট, রুবেলের পারফরম্যান্সের গ্রাফ তাই হয়তো একটু নিচে নেমে যাচ্ছে।

আলোচনার সংক্ষিপ্তকরণের জন্যে আমরা আমাদের এই পরিসংখ্যানের আলোচনা ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকেই শুরু করব। বিশ্বকাপের বছরটা বাদ দিয়ে আমরা যদি ২০১৬ সাল থেকে শুরু করি, তাহলে দেখব সে বছর রুবেলের বোলিং গড় ছিল ৮৬.০০! হ্যা, ভুল পড়েননি। বিশেষজ্ঞ একজন পেসারের এক বছরের বোলিং গড় ৮৬। অবশ্য রুবেল সে বছর ম্যাচ খেলেছেনই মাত্র দুটি, তবে সেই ম্যাচ না খেলার আক্ষেপ তিনি অন্তত ২০১৭ সালে করতে পারবেন না।

সে বছর সবমিলিয়ে তিনি গোটাদশেক ওয়ানডে খেলে ফেলেছিলেন । তা এই ১০ ওয়ানডে খেলে রুবেল উইকেট নিয়েছিলেন মাত্র ১০ টি, ইকোনমি রেট ছিল ৬.১৩! তা এই বেশি ম্যাচ খেলার বছরে রুবেলের বোলিং গড়ের কিন্তু বেশ উন্নতিই হয়েছিল বলতে হবে। আগের বছরের ৮৬ এবছর এসে ঠেকেছিল ৫১.৫০ তে! রুবেল যদি ব্যাটসম্যান হতেন তাহলে এতদিনে এই গড় নিয়ে আইসিসির র‍্যাংকিংয়ে চলে আসতেন নিশ্চিত!

যা হোক, রুবেল ব্যাটসম্যান নন তাই এই গড় ঠিক কাজে আসেনি। তবে ২০১৮ সালটা কিন্তু রুবেলের জন্যে বেশ পয়মন্ত গেছেই বলতে হবে। এ বছর ১৫ ওয়ানডে খেলে ২২.০৮ গড়ে রুবেল নিয়েছিলেন ২৩ উইকেট, ইকোনমিটাও ছিল ছয়ের নিচে- ৫.০১! এমন কিছু জরুরী তথ্য নয়, তবুও জানিয়ে রাখি এ বছরের ১৫ ওয়ানডের ৮টিতেই প্রতিপক্ষ হিসেবে ছিল জিম্বাবুয়ে,ওয়েস্ট,ইন্ডিজ আর আফগানিস্তান!

যা হোক, বিশ্বকাপের আগের বছর দুর্দান্ত পারফর্ম করে বিশ্বকাপের টিকিটটা কিন্তু নিশ্চিতই করে ফেলেছিলেন রুবেল। তাছাড়াও তিনি যেহেতু একজন পেসার, ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বকাপে তাঁর ওপর দলের চাওয়াও ছিল একটু বেশি। মেঘলা কন্ডিশনে ইংলিশ পিচে পেসাররা কি করতে পারে এ তো আমরা সবাই জনাই।

তা রুবেলকে বিশ্বকাপে নেওয়া হলেও অবশ্য সব ম্যাচ খেলানো হয়নি, অস্ট্রেলিয়া আর ভারতের সাথে মাত্র দুটি ম্যাচেই তিনি একাদশে ছিলেন। সে দুই ম্যাচে ১৭ ওভার বল করে ১ উইকেট নিলেও রুবেলের বোলিং গড় এবার আপনাকে ভিরমী খাওয়াতে বাধ্য- ১৩১!

যা হোক, আমরা যেহেতু বছর ধরে আলোচনা করছিলাম , তাহলে সে আলোচনাতেই আবার ফিরে আসি। ২০১৯ সালে সে দুই ম্যাচ ছাড়াও তিনি আরো চারটি ওয়ানডে খেলেছিলেন। মোট ছয় ওয়ানডে মিলিয়ে রুবেলের বোলিং গড় ৬৯! উইকেট ? মাত্র ৫ টি! উইকেট আর গড়ের বেহাল দশাতে রুবেলের ইকোনমিটাও কিন্তু এ বছর তাঁর হয়ে কথা বলছে না- ৬.৭৬!

তাঁর মানে যেটা দাঁড়াল, বিশ্বকাপের বছরের পর থেকে রুবেলের বোলিং গড় হল যথাক্রমে ৮৬, ৫১.৫০, ২২.০৮ আর ৬৯.০০!

জঘন্য এই পরিসংখ্যানের পরও রুবেলকে দলে নেওয়ার আরো একটা কারণ থাকতে পারত আর সেটা হল ডেথ ওভারগুলোতে রুবেলের পারদর্শীতা। তা সেই কারণেও কিন্তু রুবেল আক্ষেপ বাঁধিয়ে দিয়েছেন এই ক’বছরে। নিদাহাস ট্রফিতে ১৯তম ওভারে একাই ২২ রান দিয়ে ম্যাচ হারিয়ে এসেছেন, আফগানিস্তানের সাথে শেষ ওভারে ২০ রান দিয়ে সিরিজ ডুবিয়ে এসেছেন। ডেথ ওভারে রুবেলের ওপর আস্থা এরপর অনেকটাই কমে আসা শুরু করে, সে ব্যাটন পরে সাইফউদ্দিন ধরেছেন!

যা হোক, বিগত কয়েক বছরে এই পারফরম্যান্সের পর বাংলাদেশ দল কিন্তু একরকম রুবেলকে ছাড়াই তাঁদের পরিকল্পনা হাতে নেয়। যে কারণে ২০২০ সালে গুটিকয়েক যে ওয়ানডে খেলে বাংলাদেশ তাতে রুবেলকে একাদশে দেখা যায়নি। রুবেলের বদলে সুযোগ দেওয়া আল-আমিনকেও লম্বা দৌড়ের ঘোড়া বলেই মনে হচ্ছিল। আর তাছাড়াও, কয়েক বছর ধরে জঘন্য পারফর্ম্যান্সের পর রুবেল দলে থাকবেন না সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু, প্রশ্ন হল হঠাৎ করে ২০২১ এ এসে রুবেলের অন্তর্ভুক্তির কারণ কি? যে দুই ম্যাচ তিনি খেলেছেন, কোনটাতেই রুবেলের বোলিংয়ে কোন উন্নতি চোখে পড়েনি। বিগত কয়েক বছরেও রুবেলের বোলিংয়ে নিয়ন্ত্রণের অভাব ছিল, এখনও সেটাই আছে। বেশিরভাগ সময় যেটা মনে হয়, রুবেল কোন পরিকল্পনা মেনে বল করছেন না।

সামনে থাকা ব্যাটসম্যানের শক্ত আর দুর্বল জোন সম্বন্ধে অবগত থেকে বল করা, এসব ব্যাপারে রুবেলকে গত কয়েক বছরে একদমই মনোযোগী মনে হয়নি। বেশিরভাগ তিনি বল করতে এসেছেন, গুড লেংথের নিচে বল ছুঁড়েছেন ,অযাচিত বাউন্সার ছুঁড়েছেন-  এতে দলের লাভ হয়নি তেমন! বোলিংটা যে হাত  নয়, মাথা দিয়েও করতে হয়!

এখন খুব সূক্ষ্মভাবেই একটা প্রশ্ন আমি করতে চাই, বাংলাদেশ যেহেতু বিশ্বকাপ পরিকল্পনাতে দল সাজাচ্ছে, সেই পরিকল্পনাতে রুবেল ঠিক কতটা খাপ খাওয়াতে পারবেন? যেখানে সাইড বেঞ্চেই তিনজন পেসার বসে আছেন!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link