একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অন্তত এক হাজারের বেশি রান আছে এমন খেলোয়াড়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গড় কার? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য যদি বিরাট কোহলি বা স্টিভেন স্মিথের নাম বলেন, তাহলে আপনি ডাহা ফেল, কিংবা একটু ভেবে চিনতে যদি মাইকেল বেভান বা ক্রিস গেইলের নামও বলে ফেলেন, তাহলেও আপনি গেলেন, মাইনাস পয়েন্ট অপেক্ষা করছে আপনার জন্যে।
পুরস্কার পাবেন যে উত্তর বললে সেটা হলো রায়ান টেন ডেসকাটে, নেদারল্যান্ডের ক্রিকেটার, যাঁর আদরের নাম ‘টেন্ডো’ হ্যাঁ নেদারল্যান্ডসের হয়ে মাত্র ৩৩টি একদিনের ম্যাচে দেড় হাজারের বেশি রান করে যিনি ঈর্ষণীয় ৬৭ গড়ের মালিক!
নেদারল্যান্ডস ক্রিকেটে কিংবদন্তিতুল্য এই ডেসকাটের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা সবই কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকায়। কেপটাউনের ফেয়ারবেয়ার্ন কলেজ পড়তে ক্রিকেট, রাগবি, গলফ সবেতেই দক্ষ ‘টেন্ডো’র একটু বড়ো হবার পর ক্রিকেটকেই পেশা হিসাবে বেছে নেওয়ার ইচ্ছা হল, কিন্তু ইচ্ছা থাকলেই যে দক্ষিণ আফ্রিকার সবুজ হলুদ জার্সি গায়ে চাপাবেন তা ততো সোজা ছিল না।
বর্ণবাদের জেরে সেদেশের ক্রিকেটে সংরক্ষণের ফলে, দলে ঢুকতে গেলে বিশাল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হত। আর জন্টি রোডসকে আদৰ্শ মেনে চলা আর ততদিনে ওয়েস্টার্ন প্রভিন্সের দলে নিয়মিত হয়ে যাওয়া ডেসকাটের স্বপ্ন যেভাবেই হোক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতেই হবে। ওদিকে ইংল্যান্ডের এসেক্স কাউন্টি দলের প্রতিনিধি দলের হয়ে গ্রাহাম গুচ তখন দক্ষিণ আফ্রিকায় ঘুরছেন প্রতিভা অন্বেষণে, ‘টেন্ডো’ চোখে পড়ে গেলেন তাঁর, ‘জহুরির চোখ জহর চেনে।’
দক্ষিণ আফ্রিকার পোর্ট এলিজাবেথ থেকে ডেসকাটে পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ডের চেমসফোর্ডে, সঙ্গী একটা ডাচ পাসপোর্ট। কলপ্যাক নিয়মে ২০০৩ সালে সেই যে এসেক্স কাউন্টিতে সই করলেন ডেসকাটে, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত চেমসফোর্ডের ঘরের ছেলেই হয়ে গেছেন, পরবর্তী কালে অধিনায়কত্ব ও করেছেন এসেক্সের হয়ে, এখনো খেলছেন সেই এসেক্সের হয়ে, আর সে কাউন্টি দলেও তিনি কিংবদন্তিসম।
এদিকে ডাচ পাসপোর্ট থাকার ফলে আর এসেক্সে দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে অচিরেই ২০০৬ সালে ডাক এসে গেল শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে একদিনের সিরিজে, সে সিরিজে তেমন ভালো করতে না পারলেও পরের ইন্টার কন্টিনেন্টাল কাপে দুর্ধর্ষ পারফরমেন্স নেদারল্যান্ড দলে ডেসকাটেকে নিয়মিত করে দেয়। ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের সর্বকালের সেরা স্কোরটা তাঁর ব্যাট থেকেই এলো, কানাডার বিরুদ্ধে অপরাজিত ২৫৯ রানের।
বছর ঘুরতেই সুযোগ পেয়ে গেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিশ্বকাপে খেলার। অরেঞ্জ জার্সি গায়ে ছাপিয়ে বিশ্বকাপে দলের হতাশা জনক ফলের মধ্যেও মোটামুটি পারফরমেন্স করে গেলেন ‘টেন্ডো’, বিশ্বকাপের প্রস্তুতি ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে বল হাতে ৫ উইকেট আর ব্যাট হাতে ৫৭ রান করে তাঁর প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেলেন।
একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিয়মিত খেলার সুযোগ পেতো না নেদারল্যান্ডস, যতটুকু সুযোগ পেতো তার মধ্যেই ফুল ফোটাতেন ডেসকাটে, কি ব্যাট হাতে আর কি বল হাতে সমান দক্ষতায় পারফর্ম করে যেতেন অবলীলায় এবং কখনো কখনো প্রায় একার হাতে। পরের দিকে অস্ট্রেলিয়াজাত টম কুপারের সাহায্য পেয়েছেন, এবং কুপার-ডেসকাটে যুগলবন্দী নেদারল্যান্ডসকে অনেক ম্যাচ জেতাতে সাহায্য করেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় হওয়া পরবর্তী বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ারেও দারুন পারফরমেন্স করলেন ডেসকাটে, এবং দলকে ২০১১ বিশ্বকাপের মূলপর্বে তুলতে এডগার সিফারলি ও আলেক্সি কারভেজির পাশাপাশি বড়ো ভূমিকা নিলেন।
পাঁচ জুন, ২০০৯, স্থান লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড। নেদারল্যান্ডসের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা একটি দিন হিসাবে পরিচিত হল, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই সংগঠক ইংল্যান্ডকে চার উইকেটে হারিয়ে চমকে দিলো প্রথমবার এই কুড়ি বিশের বিশ্বকাপে পা রাখা নেদারল্যান্ডস। আর এই বিরাট জয়ে বড়ো ভূমিকায় অবতীর্ন হলেন ডেসকাটে।
প্রথমে বল হাতে গোটাদুয়েক উইকেট নিয়ে ইংরেজদের তারপরে ব্যাট হাতে ১৭ বলে ২২ নটআউট থেকে উইনিং স্ট্রোক মেরে শেষ বলে দলকে জিতিয়ে হিরোর তকমা তখন ডেসকাটের গায়ে। ডেসকাটের হিরোগিরি বিশ্বমঞ্চে আবার প্রকাশ পেলো ২০১১ তে বিশ্বকাপে। নেদারল্যান্ডসের হয়ে সে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই আবার ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠলো ডেসকাটের ব্যাট, দুর্দান্ত সব স্ট্রোক প্লে সমেত ১১৯ রানের ঝকঝকে ইনিংস খেললেন তিনি, সে বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে আবারো উজ্জ্বল ‘টেন্ডো’র ব্যাট।
ইডেন গার্ডেন্সে আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধেও অসাধারণ সেঞ্চুরি উপহার দিয়ে বিশ্বকাপ মাতিয়ে গেলেন ডেসকাটে। তারপরের ৬ বছর ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলার জন্য নেদারল্যান্ডস এর হয়ে খেলেননি তিনি, ২০১৭ সালে ডাচ দলে আবার প্রত্যাবর্তন করলেন আবারো একটা বিশ্বকাপে দলকে তুলে ধরতে, কিন্তু ২০১৯-এর বিশ্বকাপে দেশকে কোয়ালিফাই করাতে না পারলেও সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে হওয়া টি ২০ বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ারে নেদারল্যান্ডসকে চ্যাম্পিয়ন করে পরবর্তী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের টিকিট পাওয়াতে আবারো বড়ো ভূমিকা রেখেছেন ডেসকাটে।
ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট যে তাঁর মতো অলরাউন্ডারকে পেলে লুফে নেবে সে তো সবাই জানে, আর ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের রমরমার যুগে তাই বহু বছরে ধরেই টেন ডেসকাটে ছিলেন ‘হট কেক’। ক্রিকেট ফেরিওয়ালার মত ছুটে বেরিয়েছেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট খেলতে নিউজিল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ কিংবা কানাডা থেকে ভারত।
আইপিএলে প্রথম তিন বছরে অ্যাসোসিয়েট দেশের খেলোয়াড়েরা সুযোগ পাননি, সেই অচলায়তনটাও ভাঙলেন ডেসকাটে, ২০১১ আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে, ২০১৫ পর্যন্ত কেকেআরের হয়ে অনেক গুলি ম্যাচ খেলেছেন ও দুবার শিরোপা জয়ে যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন টেন ডেসকাটে। এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট চলে আর তিনি খেলেননি। নয় নয় করে সতেরোটি ফ্রাঞ্চাইজির হয়ে খেলে ফেলেছেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৩৬৯ ম্যাচে সাড়ে সাত হাজারের বেশি রান ও ১১০-এর বেশি উইকেটের অধিকারী ডেসকাটে।
একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ব্যাট হাতে নানা শৌর্যের অধিকারী হলেও দলের হয়ে তিনি অলরাউন্ডারের ভূমিকাই পালন করতেন। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্র ৩৩ ম্যাচেই ৫৫ উইকেট তারই নমুনা প্রকাশ করে। নাহ, টেস্ট ক্রিকেটার হওয়ার যে সাধ ছোট থেকে মনে পোষণ করেছিলেন, সেই স্বপ্ন সত্যি হয়নি তাঁর।
অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার তেমন সম্ভাবনাও নেই, কারণ ডাচ দের ক্রিকেটের কুলীন ফরম্যাটে সুযোগ দেওয়ার তেমন কোনো অভিপ্রায় এইমুহূর্তে নেই আইসিসির। ফলত প্রায় ২০০এর কাছাকাছি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে প্রায় ১১০০০ রান করা আর ৭ বার ৫ উইকেট সহ ২০০র ওপর উইকেট নেওয়া টেন ডেসকাটেকে তাই ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়ত এক ক্রিকেট ফেরিওয়ালার নায়ক হিসাবেই মনে রাখবে।
আর বছর চল্লিশের চিরসবুজ ডেসকাটের কাছে আগামী বছরে ভারতের কুড়ি বিশের বিশ্বকাপে ডাচ দলের তাই আবদার থাকবে হয়তো, ‘যাও গো এবার যাওয়ার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাও।’