সেলিম মালিক, টস ও জিম্বাবুয়ের রুপকথা!

১৯৯৫ সালের ৩১ জানুয়ারি। জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় একটি দিন। ক্রিকেটের জন্যও দিনটি স্মরণীয় এক অভূতপূর্ব কান্ডের জন্য। ভণিতা না করে সোজা গল্পে চলে আসি বরং।

টেস্ট ম্যাচ, সেটাও নবাগত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। হোক না সেটা জিম্বাবুয়ের মাঠে, পাকিস্তান ক্রিকেট দলের কেউই ঘুণাক্ষরেও নেগেটিভ রেজাল্টের কথা ভাবেনি, ভাবেনি ক্রিকেট বিশ্বও। সকালে যখন পাকিস্তান অধিনায়ক সেলিম মালিক অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের সাথে টস করতে মাঠে প্রবেশ করলেন, তখন তাঁদের সাথে উপস্থিত ছিলেন ম্যাচ রেফারি গ্রেট ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান উইকেট কিপার জ্যাকি হেন্ড্রিকস! মিডিয়া ম্যান এবং আরও কিছু ব্যক্তির সামনে সেন্টার উইকেটে দাঁড়িয়ে কয়েন ছুঁড়লেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার এবং হয়ত তখনই ট্রিক করার ভূতটা মাথায় চাপলো সেলিম মালিকের!

টসের জন্য ব্যবহৃত জিম্বাবুয়ের কয়েনটির একপাশে ছিল ঈগল। মালিক কল করলেন ‘বার্ড’! মানে, ঈগল না উঠলেও যেন দ্বিতীয়বার টস করার সুবিধা নেওয়া যায়। টসে ঈগল সাইড উঠে এল, মালিক টস জিতে নিলেন অদ্ভুত কৌশলে এবং ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিলেন! অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের আপত্তি ছিল না কিন্তু বাধ সাধলেন আর্গুবলি উইন্ডিজের সর্বকালের সেরা উইকেট কিপার হেন্ড্রিকস!

স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন তিনি কলটা পরিস্কার করে শুনতে পাননি! দ্বিতীয়বার কয়েন ছোড়ার মাধ্যমে ইতিহাসে অমরত্ব পেয়ে গেল টেস্টটি। বিরস বদনে মালিক দেখলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার টস জিতে সুন্দর ব্যাটিং উইকেটের ফায়দা নিতে ব্যাট ঘুরানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন! গল্পের প্রথম পর্বের সমাপ্তি এখানেই, তবে ইতিহাসের আরেকটি প্রথমের সাক্ষী হতে হলে আপনাকে আরেকটু ধৈর্য নিয়ে পরের অংশটুকুও পড়তে হবে।

মালিকের ট্রিক কাজ না করলেও পাকিস্তানি বোলারদের শৈল্পিক ট্রিক ঠিকই কাজ করতে লাগল সকালের পিচে। ওয়াসিম আকরাম এবং আকিব জাভেদের তোপে ৯ রান তুলতেই ২ উইকেট খুইয়ে বসলো জিম্বাবুয়ে! প্রাথমিক ধাক্কা সামলে রানের গাড়ি ৭৩ রানে যেতেই আবারও উইকেট পতন। ৭৩/৩, এমন অবস্থায় ক্রিজে তখন দুই ফ্লাওয়ার ব্রাদার্স!

পাকিস্তানি বোলারদের শুরুর সাফল্যে মাটি চাপা দেয়া এক ম্যারাথন জুটি গড়ে কার্যত পাকিস্তানকে ম্যাচ থেকেই ছিটকে দেয়া এক পার্টনারশিপ! ২৬৯ রানের জুটি সময়ের হিসেবে খেলেছে ৩৩৬ মিনিট! ব্রাদার্স পার্টনারশিপ রেকর্ড ২৬৪, যেটা কিনা দখলে ছিল অজি লিজেন্ড গ্রেগ এবং ইয়ান চ্যাপেলের দখলে সেটা ভেঙে এখন অবধি টিকে থাকা ফ্লাওয়ার ব্রাদার্সদের জুটিটি ভাঙে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের বিদায়ে। ১৫৬ রান করা অ্যান্ডি প্যাভিলিয়নে ফিরলেও গ্রান্ট তার ম্যারাথন ইনিংস টেনে নিয়ে চলেন আরেক অলরাউন্ডার গাই হুইটালের সাথে জুটি গড়ে!

পাকিস্তানি বোলারদের চরম ক্লান্তিতে ডুবিয়ে জিম্বাবুয়ে যখন ইনিংস ঘোষনা করে তখন স্কোর ৫৪৪/৪। ২০১ রানে অপরাজিত গ্রান্ট ফ্লাওয়ার ততক্ষণে খেলে ফেলেছেন ৫২৩ বল, অপর ব্যাটসম্যান গাই হুইটালও অপরাজিত ১১৩ রানে!

শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত পাকিস্তান দল মানসিকভাবেও পিছিয়ে যায়, যখন স্লিপে ক্যাচ নেবার সময় ইনজামামের শোল্ডার ডিসলোকেটেড হয়। আমির সোহেলের ৬১ রানের প্রতিরোধ স্বত্বেও পাকিস্তানের স্কোর দাঁড়ায় ১৫১/৬! ফলো অনের চোখ রাঙানির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে যান ইনজুরি আক্রান্ত ইনজামাম এবং ইজাজ আহমেদ৷

সাবলীল ব্যাটিংয়ে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকে পাকিস্তানের ইনিংস। যখন মনে হচ্ছিল ফলো অনকে এড়িয়ে যাবার খুব কাছে পাকিস্তান, তখনই ইজাজকে ফিরিয়ে কফিনে আরেকটি পেরেক ঠুকে দেন হিথ স্ট্রিক! ওয়াসিমকে নিয়ে একটা শেষ চেষ্টা অবশ্য করেছিলেন ইনজামাম, কিন্তু ৪৬ রানের জুটির সমাপ্তির মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ইনিংস হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। ২২২ রানে পিছিয়ে থেকে ফলো অন করা শুরু করে সেলিম মালিকের দল।

দ্বিতীয় ইনিংসে ধীর-স্থির ব্যাটিং করে ম্যাচ বাঁচানোর যে শেষ আশাটুকু বুকে ধারন করেছিল পাকিস্তানি ভক্তকুল, সেই আশায় শুরুতেই ছুরি বসান ডেভিড ব্রায়ান। নিজের প্রথম স্পেলেই সোহেল, আসিফ মুজতবা এবং ক্যাপ্টেন মালিককে তুলে নিয়ে পাকিস্তানের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন। দেখতে না দেখতেই ৩৫ রানে ৫ উইকেট নেই এবং তখনও কোন ব্যাটসম্যান ডাবল ফিগারে পৌঁছাতে পারেনি।

বরাবরের মতই হাল ধরতে হাজির ইনজামাম। কিন্তু ব্যক্তিগত ৬৫ রানে তার ফিরে যাবার সাথে সাথেই পাকিস্তানের রণতরীর সলিল সমাধি হবার সূচনা। ১৫৮ রানে অলআউট হয়ে ইনিংস পরাজয়, সেটাও সদ্য কুলিন সদস্যপদ পাওয়া জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে! ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়ে আনসাং হিরো হিথ স্ট্রিক! নিজেদের এগারোতম ম্যাচেই প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ নিল জিম্বাবুয়ে!

কি হত, যদি সেলিম মালিক সেদিন ট্রিক না করে স্বাভাবিক উপায়ে টস কল করতেন? নবাগত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পরাজয়ের এই গ্লানিতে ডুবে হাজারো ভক্তের মনে এই প্রশ্ন তখন উঠেছিল! কি হত, যদি পাকিস্তান আগে ব্যাট করত সেই চমৎকার উইকেটে! হয়ত কিছুই বদলাতো না! কিন্তু শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতের দাগটা নিশ্চয়ই তাদেরকে বারবার প্রশ্নটা মনে করিয়ে দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link