সাকিবের ‘বোঝা’ কি শেষ হয়েছে?

বাংলা ভাষাটা কখনো কখনো বেশ দুর্বোধ্য মনে হয়। এই যেমন এই লেখার শিরোনাম!

বাংলা ভাষায় ‘বোঝা’ শব্দটির দুই রকম অর্থ হয়। একটা অর্থ হচ্ছে, ‘ভার’। আরেকটা অর্থ হচ্ছে ‘বুঝতে পারা/অনুধাবন করা/উপলব্ধি হওয়া!’ সাকিবকে নিয়ে এই লেখায় ‘বোঝা’ শব্দটা ঠিক কোন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, সেটি ‘বুঝতে’ হলে অবশ্য আপনাদের কিছু মূল্যবান সময় খরচ করে এই বিশাল লেখাটি পুরোটুকু পড়ার ‘বোঝা’ মাথায় নিতে হবে!

আমরা অনেকেই জানি, আগামীকাল ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিবের ১বছরের নিষেধাজ্ঞা (দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা, এক বছরের স্থগিতাদেশ) শেষ হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এই নিষেধাজ্ঞা ছিল সাকিবের জন্য একটি বড় ‘বোঝা’। একদিকে নিজে খেলতে না পারার যন্ত্রণা, অন্যদিকে বুঝে কিংবা না বুঝে ভক্তদের উপর চাপিয়ে দেয়া অপেক্ষার বোঝা। যেই কাজের জন্য সাকিব এই নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন, অনেকের চোখেই সেটি সরাসরি ‘অপরাধ’ না হলেও আইসিসির আইন অনুযায়ী তা ছিল ‘অপরাধ’।

স্বাভাবিকভাবেই গত এক বছর ধরে সাকিব এই অপরাধের ‘বোঝা’ও টানছেন! এখন কথা হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা শেষ হবার সাথে সাথেই কি সাকিব এই অপরাধ কিংবা ভুলের বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে যাবেন? এই প্রশ্নের জবাব নাহয় আমরা লেখার শেষ অংশেই খুঁজে নেব!

বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বড় তারকার নাম নিঃসন্দেহে সাকিব আল হাসান। একই সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি যেই ক্রিকেটারকে ভুল বোঝা হয়েছে, সেই নামটিও হয়তোবা তর্কসাপেক্ষে সাকিব আল হাসানই। বিভিন্ন সময়ে সাকিবের বলা কিছু কথার কারণে অনেকেই তাকে ভুল বুঝেছেন। এর আগেও সাকিব কয়েক দফায় নিষিদ্ধও হয়েছেন, কখনো তিন মাস, কখনো ছয় মাস।

সেই সব নিষেধাজ্ঞার সময় এবং নিষেধাজ্ঞার পরও সাকিব পেয়েছেন ভক্ত -সমর্থকদের অকুণ্ঠ ভালবাসা ও সমর্থন। কড়া সমালোচক কিংবা কারো কারো চোখে কিছু ‘হেটার’ অবশ্য বরাবরই তার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তবে খুব সম্ভবত এই প্রথম সাকিবের নিষেধাজ্ঞার সংবাদে তাঁর অনেক নিখাদ ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীও বলেছেন যে, অল্প শাস্তিতেই পার পেয়ে গেছেন সাকিব! এবং ব্যক্তিগতভাবে এই প্রথম সাকিবের কোন নিষেদ্ধাজ্ঞা শেষ হওয়া নিয়ে আমার মাঝে আলাদা কোন ‘উচ্ছ্বাস’ কাজ করছে না, কেবলমাত্র একটা স্বস্তির অনুভূতিই হচ্ছে!

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এতো বছর খেলার অভিজ্ঞতা, আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটের সাথে বিভিন্ন সময় সরাসরি কাজ করে আসা সাকিব যে এমন ‘ভুল’ এর পরিণতি সম্পর্কে অসচেতন ছিলেন, সেটি আসলে মেনে নেয়া কঠিন। তারপরেও নাহয় ধরে নিলাম, সাকিব খামখেয়ালীপনা করেই এই অনাকাংক্ষিত বিপর্যয় ডেকে এনেছিলেন।

একটা সময় মনে করতাম, সাকিবকে সবচেয়ে ভালভাবে বুঝতে পারেন সাকিব নিজেই। কিন্তু নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে প্রখ্যাত ভারতীয় ধারাভাষ্যকার ও ক্রিকেট বিশ্লেষক হার্শা ভোগলেকে দেয়া তার এক সাক্ষাৎকার শুনে মনে হয়েছে কখনো কখনো সাকিব নিজেই নিজেকে বুঝতে ভুল করেছেন! এই কথা কেন বলছি?

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিবের অভিষেক হয়েছে ২০০৬ সালে। ২০০৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাকিব খেলেছেন টানা তিনটি বিশ্বকাপ (যার মধ্যে একটিতে তিনি দেশকে নেতৃত্বও দিয়েছেন)। এই ৩টি বিশ্বকাপের কোনোটাতেই যে সাকিব ঠিক ‘সাকিবীয়’ পারফরম্যান্স করতে পারেননি, বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেকে আলাদাভাবে স্মরণীয় করে রাখতে যে বিশ্বকাপের মত মঞ্চে ‘স্পেশাল’ কিছু করে দেখানো দরকার সেটি অনুধাবন করতেই সাকিবের লেগে গেছে ১যুগেরও বেশি সময়!

হার্শাকে দেয়া সেই সাক্ষাৎকারেই সাকিব বলেছেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথমবার তার এই উপলব্ধি হয়েছে! যেই উপলব্ধি থেকে নিজেকে বিশেষভাবে প্রস্তুত করার কাজ শুরু করেছেন তারও কয়েক মাস পর আইপিএল চলাকালীন সময়ে, প্রথম ৩ম্যাচ সাইড বেঞ্চে বসে থাকার পর! সত্যিই কেমন জানি বিস্ময়কর লাগে!

এবং বুঝতে পারার পর তিনি যেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন, যেভাবে বিশ্বকাপের মঞ্চে ব্যাটে-বলে আলো ছড়িয়েছেন তাতে মাশরাফির বলা একটা কথাই বার বার মনে পড়ে, ‘এমন পারফরম্যান্সের পর ২০১৯ বিশ্বকাপটা সাকিবের প্রাপ্য ছিল!’ সেটা হয়নি দলের বাকিদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত সমর্থন না পাবার কারণে। যেই ব্যর্থতার দায় অধিনায়ক মাশরাফির কাঁধেও অনেকখানি বর্তায়!

কিন্তু বিশ্বকাপের ঠিক আগ মুহূর্তে দলীয় ফটোসেশনে সাকিবের অনুপস্থিতি এবং সেটি নিয়ে দলের মধ্যে সৃষ্টি হওয়া অস্বস্তিও যে এর পেছনে ভূমিকা রাখেনি, সেটিও কি খুব জোর গলার বলা যায়? একই সাথে ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে সাকিবের যে উপলব্ধিটা হয়েছে, সেই উপলব্ধিটাই ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে হলেই হয়তোবা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আমরা একটা বিশ্বকাপ জিতে যেতে পারতাম! আফসোস!

যাই হোক, হার্শাকে দেয়া সেই সাক্ষাৎকারেই সাকিব এটাও বলেছেন, অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য যে কষ্ট তার ভক্ত সমর্থকরা পেয়েছেন এবং সাকিবের দুর্দিনেও তার ভক্ত সমর্থকেরা যে নিখাদ ভালবাসা আর অকুন্ঠ সমর্থন তাকে যুগিয়েছেন, প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘন্টা, প্রতিটি মুহূর্ত তার নিষেধাজ্ঞা শেষ হবার ক্ষণ গণনা করেছেন, সেই ভালবাসার প্রতিদান সাকিব দেবেন। এবং মন থেকে সাকিব যখন কিছু চান, সেটাকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই যে সাকিব করেন সেটি নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না!

আমরা তাই অপেক্ষায় থাকলাম। যে ভুলের বোঝা সাকিব গত এক বছরে ধরে বয়ে চলেছেন, সেই বোঝা নামানোর জন্য কিংবা ক্যারিয়ারে পড়ে যাওয়া দাগটুকু মোছার জন্য সাকিব নিশ্চয়ই স্পেশাল কিছুই তার ভক্তদের ও দেশকে উপহার দেবেন! কে জানে, সেটা কী? বিশ্বকাপ হাতে সাকিবের হাসিমুখ আর বাংলাদেশের কোটি মানুষের অশ্রুসজল মুখের কথা কি আমি বলেছি? কে জানে সাকিবের ‘বোঝা’ কবে শেষ হবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link