সাকিব আল হাসান সম্প্রতি হাই পারফরম্যান্স ইউনিট, পাইপলাইন, ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে কথা বলায় তোলপাড় হচ্ছে। কিন্তু এই ধরণের কথা সাকিব এই প্রথম বলছেন না। ২০০৯ সালের এক সাক্ষাতকারে দেশের ক্রিকেট কাঠামো, পাইপ লাইন কিংবা জাতীয় লিগ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছিলেন।
সেই সাক্ষাৎকার ফিরে দেখা যাক।
গত ৬ ম্যাচে ৩২ উইকেট, সঙ্গে ৩৩৯ রান! এটাই কি সাকিবের স্বাভাবিক পারফরম্যান্স?
সাকিব আল হাসান: আমার তো মনে হয়, এটা স্বাভাবিক পারফরম্যান্স। হয়তো বোলিংটা একটু বেশি ভালো হচ্ছে। যতটা আশা করিনি। তবে ব্যাটিংটা আরও ভালো হওয়ার সুযোগ ছিল। যেভাবে খেলছি, তাতে আরও অনেক রান করা উচিত ছিল। বিশেষত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এই সিরিজে আরও রান হওয়া উচিত ছিল।
ব্যাটিং নিয়ে তাহলে ঠিক সন্তুষ্ট না?
সাকিব: না। ঠিক সন্তুষ্ট না।
আপনার বোলিংটা নিয়েই এখন বেশি আলোচনা। ছিলেন ব্যাটিং অলরাউন্ডার, হয়ে গেলেন দেশের সেরা স্পিনার! রহস্যটা কী?
সাকিব: রহস্য তো কিছু নেই। আমি আগেও বলেছি, বোলিং নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তা করি না। আমার কাছে মনে হয়, এটা একটা গড গিফটেড ব্যাপার। আমি প্রথম যেদিন ক্রিকেট বলে বল করলাম, প্রথম ওভারের প্রথম বলেই উইকেট পেয়েছিলাম। বলটা ঠিক জায়গায়ই ফেলতে পেরেছিলাম। ওই দিন তিন উইকেট পেয়েছিলাম, তিনটাই বোল্ড। আমার কাছে মনে হয়, আমার বোলিংয়ের শক্তিশালী দিক হচ্ছে, আমি একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ধারাবাহিকভাবে বল ফেলে যেতে পারি। সেটা ওই প্রথম দিনও ছিল, এখনো আছে। আমার সাফল্যের কারণ তো মনে হয় এটাই। চিন্তায় বা বোলিংয়ে কোনো পরিবর্তন তো হয়নি।
কিন্তু ব্যাপারটা খুব রহস্যময় না? চট্টগ্রামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টের আগ পর্যন্ত আপনার ৬ টেস্টে ৩ উইকেট। ওই ম্যাচের দল ঘোষণার সময় সবাইকে অবাক করে জেমি সিডন্স বললেন, আপনাকে স্পেশালিস্ট স্পিনার হিসেবে খেলানো হচ্ছে। আর আপনি জাদুর মতো ৭ উইকেট নিয়ে নিলেন!
সাকিব: এটা তো বিশ্লেষণ করা খুব কঠিন। ও বলল আর আমি উইকেট নেওয়া শুরু করলাম! হাঃ হাঃ হাঃ। আমিও জানি না, কেন বলল আর হয়ে গেল! তবে আমার মনে হয় না, অন্য রকম কিছু করছি। আমি আসলে এই পারফরম্যান্সগুলো বিশ্লেষণ করার অবস্থায় নেই।
এই ম্যাচগুলোর ভিডিও দেখেছেন?
সাকিব: না। একটাও দেখি না। সাধারণত খুব কম ভিডিও দেখি। সময়-সুযোগ পেলে পুরোনো ভালো পারফরম্যান্স অনেক সময় দেখি। দোষ-ত্রুটি বের করার জন্য না। উপভোগ করার জন্য। এই ম্যাচগুলোর হাইলাইটসও দেখিনি।
নেটে তো খুব বেশি বল করেন না।
সাকিব: না।
কিন্তু টেস্টে তো অনেক বল করতে হয়। অনুশীলন কম করে মাঠে গিয়ে ক্লান্তি আসে না?
সাকিব: না, এখন পর্যন্ত ক্লান্ত হচ্ছি না। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এক ইনিংসই পুরোপুরি বল করা লাগছে। তো এক ইনিংসে ৩০-৪০ ওভার বল করা স্পিনারের জন্য খুব কঠিন না। তবে সেটা ৬০-৭০ ওভার হয়ে গেলে ক্লান্তি আসতে পারে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওই রকম হয়েছিল। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। শরীর আর চলছিল না।
এখন তো আপনাকে নিয়মিতই অনেক বল করতে হবে। এবং দেখা যাবে, দুই ইনিংস বল করাটাও বাড়ছে। তাহলে অনুশীলন কি বাড়ানোর দরকার?
সাকিব: হ্যাঁ, আশা তো করছি, এখন থেকে নিয়মিত দুই ইনিংসই আমরা বল করব। আমিও চিন্তা করেছি, বাড়ানোর দরকার। কিন্তু এখন তো একটা সিরিজের মধ্যে আছি। এখন আলাদা করে ভাবছি না। তবে ভবিষ্যতে ব্যাটিংয়ের মতো বোলিং নিয়েও কাজ করতে হবে।
অনূর্ধ্ব-১৯ দলে কি বোলার হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন?
সাকিব: না, ঠিক বোলার হিসেবে না। ব্যাটিং তো তিন-চারেই নিয়মিত করতাম। এটা ঠিক যে ৫০ ওভার খেলা হলে আমি অবশ্যই ১০ ওভার বল করতাম। এখনকার মতোই ছিল।
ওই সময় নাকি খুব মারমার-কাটকাট ব্যাটিং করতেন? একটু বদলে গেছেন?
সাকিব: হ্যাঁ। বয়সভিত্তিক দলে খেলার সময় প্রচুর শট খেলতাম। পরে তো বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা পরিণত হয়েছি। কোচরাও কিছু চেঞ্জ এনেছেন।
ক্রিকেটের বাইরের কথা বলেন। অবসরে কী করেন?
সাকিব: আমি তো এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিকেএসপিতে ছিলাম। ওখানে তো অবসরে সেই হোস্টেল-জীবন। ওটা খুব উপভোগ করতাম। খুব দুষ্টুমি করেছি, নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে যত রকম মজা করা যায় করেছি। হোস্টেল-জীবন আসলে অন্য রকম একটা মজার জীবন। আর এখন তো ছুটি পেলে বাড়ি চলে যাই।
বাড়ি গিয়ে কী করেন?
সাকিব: আগে বাড়ি যাওয়াটা খুব এনজয় করতাম না। আসলে আমার ছোটবেলার বন্ধুরা সব পড়াশোনার জন্য বিভিন্ন জায়গায় চলে গিয়েছিল তো। সে জন্য বাড়িতে গিয়ে ভালো লাগত না। এখন অবশ্য আবার খুব ভালো লাগে। এখন তো বাসায় প্লে-স্টেশন আছে, কম্পিউটার আছে; বাড়ি গেলে ওগুলো নিয়ে সময় কাটাই। গেমস খেলতে মজা পাই। দু-একজন বন্ধুও আছে। সব মিলে ভালোই কাটে। মাঝেমধ্যে ফুটবল খেলি স্থানীয় খেলোয়াড়দের সঙ্গে। মজা লাগে।
ক্রিকেট খেলতে বলে না? কেউ এসে বলেন না, ‘সাকিব ভাই, একটু বল করে দেন!’
সাকিব: না, লোকাল ক্রিকেট খেলি না অনেক দিন। সর্বশেষ স্থানীয় একটা টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলেছিলাম। ভালোই খেলেছিলাম।
আপনার নাকি ক্রিকেটের বাইরে খুব একটা বন্ধু-বান্ধব নেই?
সাকিব: একদম নেই তা না। তবে হয়েছে কি, আমি স্কুল ছেড়েছি মাঝপথে। প্রতিভা বাছাইতে আমাকে পাওয়ায় ব্যতিক্রমীভাবে বিকেএসপিতে ক্লাস এইটে ভর্তি হয়েছিলাম। ফলে পুরোনো বন্ধুরা সব হারিয়ে গিয়েছিল। তাই বাড়ি গিয়ে দেখা যেত, কারও সঙ্গে মিশতে পারতাম না। ঘুরতে পারতাম না। সারা দিন বাসায় বসে-শুয়ে থাকতাম। এখন তো ওদের অনেকে আবার এলাকায় ফিরে এসেছে।
এলাকায় গিয়ে বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিশে পাবলিক প্লেসে ঘুরে বেড়ানো বা যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারেন?
সাকিব: আমি চেষ্টা করি সবসময় সিম্পল থাকার। স্বাভাকিভাবেই ঘোরার। কিন্তু পাবলিক প্লেসে বসাটা একটু কঠিন। নিজেই একটু এড়িয়ে চলি। কেমন যেন লাগে…। মনে হয়, সবার আবার দৃষ্টি আকর্ষণ করব? থাক, দরকার কি!
এই তারকা হয়ে যাওয়টা এনজয় করেন? অটোগ্রাফ দেওয়াটেওয়া?
সাকিব: খুব এনজয় করি। মজা লাগে। কেউ ছোট-ছেঁড়া কাগজ না দিলে অটোগ্রাফ দিতেও ভালো লাগে।
প্রেম করেন? বিয়ে কবে?
সাকিব: চার সাড়ে চার বছরের আগে না। প্রেমও করছি না। ভালো মেয়ে পাচ্ছি না তো.. হাঃ হাঃ হাঃ।
আপনার সম্পর্কে একটা কথা বলা হয়, অভিযোগও বলতে পারেন, প্রশংসাও ভাবতে পারেনÑআপনি একটু যান্ত্রিক ধরনের ছেলে। নিজের আবেগটাবেগ খুব একটা প্রকাশ করেন না।
সাকিব: আমাকে অনেকেই বলেন এটা। আবেগ আমারও আছে, হয়তো অনেকের চেয়ে বেশিই আছে। অন্যরা প্রকাশ করে, আমি করি না, কিংবা করতে পারি না। এর কারণ বলতে পারেন, বিকেএসপির হোস্টেল-জীবন। ওখানে যখন থেকেছি, আমার আবেগ লুকিয়েই রাখতে হতো। আমার কান্না বন্ধুদের দেখানো যাবে না। কী ভাববে তারা! মন খারাপ থাকলে কাউকে বুঝতে দিতাম না। চার-পাঁচ বছর এভাবে চলেছি। সেটা তো এত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হবে না।
আরেকটা ব্যাপার আছে। আপনি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় মনে হয়, উত্তরটুত্তর আগে সাজিয়ে রেখেছিলেন। এটা কি পরিকল্পনা করে আসেন?
সাকিব: না। সত্যি কথা বলি, আমার জীবনের কোনো ব্যাপার নিয়ে আমি আগে থেকে পরিকল্পনা করি না। একদিন পর কী করব, তা নিয়েও ভাবি না। তবে হ্যাঁ, এক ঘণ্টা পরের পরিকল্পনা করি। আর মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলা? আমি আসলে এ রকমভাবেই শিখেছি।
শুধু আপনি না, এই গুছিয়ে কথা বলা, পরিকল্পিত উত্তর দেওয়াটা শাহরিয়ার নাফীস বা মুশফিকুর রহিমের মধ্যেও দেখা যায়। আপনারা তো রিচার্ড ম্যাকিন্সের ছাত্র। এসবও উনি শেখাতেন নাকি?
সাকিব: ঠিক এভাবে না। ম্যাকিন্স আমাদের শুধু খেলাটা শেখাত না। ও আমাদের লাইফস্টাইল নিয়েও কাজ করেছে। ডাইরি লিখতে হতো। প্রতিদিন আমাদের সবার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলা, ইংরেজি কথোপকথনের সেশন ছিল। তাতে কিছু তো পরিবর্তন আসেই।
ম্যাকিন্সের কর্মপদ্ধতি নিয়ে তো অনেক বিতর্ক ছিল…
সাকিব: আমার তো এসব কথায় মন্তব্য করা ঠিক না। ওরও হয়তো কোনো দুর্বলতা ছিল। তবে দেখেন, ও বাংলাদেশের ক্রিকেট কালচারটা দাঁড় করিয়েছে। ও আসার আগে বাংলাদেশে ক্রিকেট কোচিং নিয়ে সে রকম কাজ হয়নি। হ্যাঁ, রতন স্যার, ওহায়িদ স্যার আর ফাহিম স্যার ছিলেন। জালাল স্যার ওই সময় বোধহয় বেশি কাজ করতেন না। এখন তো অনেক কোচ। এই যে খেলোয়াড়দের টানা অনুশীলন, ফিটনেসের গুরুত্ব এগুলো ও আসার আগে কিন্তু ছিল না। হতে পারে কেউ অনেক ভালো খেলোয়াড় কিন্তু ফিটনেস না থাকলে ভালো করা কঠিন। ও বলত, তুমি শুরুতে যে শটটা করবে, ফিট না থাকলে ৫০ রান করার পর ওটা আর খেলতে পারবা না। এগুলো তো ও-ই শুরু করেছে। ও এইচপিতে (হাই পারফরম্যান্স) যে কাজ করেছে তার সুফল আমরা পাচ্ছি। ওই রকম এইচপি থাকাটা খুব দরকার। আমি নিশ্চিত না, তবে মনে হয়, ওর সময়ের চেয়ে এখনকার এইচপির অনেক পার্থক্য। ম্যাকিন্স অনেক দূরের ব্যাপার ভাবতে পারত…
যেমন?
সাকিব: এই যে রকিবুল, আমরা রকিবুলের সঙ্গে খুব দুষ্টুমি করতাম, এখনো করি। ম্যাকিন্স বলত, দ্যাখো, ওর সঙ্গে দুষ্টুমি না করে বন্ধুত্ব করো। ও কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলবে। তোমরাও খেলবা। ম্যাকিন্স আসলে আমাদের জন্য পারফেক্ট ছিল। আপনি দেখবেন, এখন বাংলাদেশ জাতীয় দলের অন্তত ১০ জন খেলোয়াড় ওর হাতে তৈরি। ও কাজ করেছে নাফীসদের দলটা নিয়ে এবং আমাদের দলটা নিয়ে। আমরা এই দুই দলেরই বেশির ভাগ খেলোয়াড় কিন্তু ন্যাশনাল টিমে খেলেছি। এরপর কিন্তু একটা বড় গ্যাপ আসছে। আমরা যখন অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলতাম, সবাই জানত, এই দলটা থেকে এই কয়জন খেলোয়াড় অন্তত আসছে। কিন্তু এখন? ওরাও নিশ্চিত না, ওদের কেউ ন্যাশনাল টিমে খেলবে কি না। আমাদের পরের ব্যাচ থেকে কিন্তু এই প্রথম একটা খেলোয়াড় এল, রুবেল। তাও ঠিক বয়সভিত্তিক দলের আবিস্কার না ও। পেসার হান্ট থেকে আসছে। আপনিও ১৯-এর কারও নাম বলতে পারবেন না, যে চলে আসবেই। এর কারণ আমার মনে হয়, রিচার্ড আর ছিল না।
এমনও তো হতে পারে, আপনারা ন্যাশনাল টিমে একটা সেটল অবস্থা তৈরি করেছেন, বলে ওদের নাম আসছে না?
সাকিব: একে সেটল কী করে বলবেন! হয়তো জাতীয় দলে পাঁচ-ছয়জন খেলোয়াড় আছে, যারা নিশ্চিত হওয়ার মতো পারফর্ম করছে। তার পরও ওরা বয়সভিত্তিক দলে অসাধারণ কিছু করলেই না আমাদের জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। ধরুন, আমাকে রিপ্লেস করবে, এমন কাউকে আমি এ মুহূর্তে দেখছি না। এটা তো আমার জন্যই খারাপ। আমি হয়তো এতে রিল্যাক্সড হয়ে যেতে পারি। ও রকম চ্যালেঞ্জ করার মতো কেউ থাকলে চাপ তৈরি হবে। এবং আমার মনে হয় এই চাপটা খুব জরুরি।
তাহলে বয়সভিত্তিক দল থেকেই এই চাপটা আসতে হবে?
সাকিব: আমাদের দেশে বয়সভিত্তিক দলটাকেই তো গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে হবে। ওখান থেকেই কয়েক বছর ধরে জাতীয় দলের খেলোয়াড় আসছিল। কারণ, আমাদের ডোমেস্টিক ক্রিকেটের স্ট্রাকচার বা স্ট্যান্ডার্ড অত ভালো না। জাতীয় লিগে কাউকে ভালো করতে দেখে তাকে আপনি আন্তর্জাতিকের জন্য নির্বাচিত করতে পারছেন না।
কারণ কী?
সাকিব: কারণ তো আমাদের জাতীয় লিগ বা ক্লাব ক্রিকেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পার্থক্যটা আকাশ আর মাটি। বয়সভিত্তিক দলে তো আপনি আন্তর্জাতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই খেলে তৈরি হচ্ছেন।
বয়সভিত্তিক দলের প্রশংসা করছেন। কিন্তু ওই পর্যায়ে আমরা যে অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তানকে প্রায়ই হারিয়েছি, পরে সেই সব খেলোয়াড়ের বিপক্ষেই কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে আপনারা ভালো করতে পারছেন না।
সাকিব: ওরা বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলার পর যে এক-দুই বছর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলছে, ওটাই পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে। অনেক টাফ ক্রিকেট খেলতে হয় ওখানে। রঞ্জিতে দেখেন একটা ম্যাচের ম্যাচ ফি এক লাখ ৭৫ হাজার রুপি। চিন্তা করেন, কত হাজার খেলোয়াড়ের কম্পিটিশন হয় রঞ্জি দলে চান্স পাওয়ার জন্য! এর পরও ওরা ওই টাফ ক্রিকেটে এসে ডাবল-ট্রিপল মারছে। আমাদের এখানে কয়টা সেঞ্চুরি হয়? আর এখানে সেঞ্চুরি দেখেও আপনি মানটা বুঝতে পারবেন না…
কেন?
সাকিব: এখানে সেঞ্চুরি মারাটা সোজা কাজ। আমি যদি দুটো ইনিংস খেলি তো একটা সেঞ্চুরি মেরে দিতে পারি। এখন ফর্ম ভালো যাচ্ছে বলে বলছি না। গত জাতীয় লিগে যখন খেললাম, তার আগে জঘন্য ফর্ম ছিল। জাতীয় লিগে সেই ফর্ম নিয়েই রানের পর রান করলাম। জাতীয় লিগে সাতটা ম্যাচ খেলে শুধু একটা ম্যাচেই দুই ইনিংসেই ৫০ রানের কমে আউট হয়েছি। আমাদের জাতীয় লিগে সেঞ্চুরি হলেও সেটা দুই, আড়াই ঘণ্টার মধ্যে হয়ে যায়। তার মানে কোয়ালিটির কথা বাদ দিন, উইকেটে থাকার অভ্যাসও হয় না। টেস্টে আপনাকে একটা সেঞ্চুরি করতে গেলে চার-পাঁচ ঘণ্টা ব্যাটিং করতে হয়। এটা তো হওয়ার কথা না। অন্তত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কাছাকাছি কঠিন তো হবে। সেই চেহারাটা সত্যি দেখা যায় ভারত-অস্ট্রেলিয়ার প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে। ওরা ওখান থেকেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শিখে আসে।
সব মিলিয়ে এখন বাংলাদেশের ক্রিকেটের কী অবস্থা?
সাকিব: আসলেই আমরা একটা বড় পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। ২০০৭ বিশ্বকাপের পর থেকেই তো পারফরম্যান্স খারাপ হওয়া শুরু হয়েছে। কারণ ছিল অনেক। নতুন কোচ, নতুন ক্যাপ্টেন, অনেক নতুন খেলোয়াড় এল দলে, বোর্ডও নতুন ছিল। লোকজন বলবে, এসবে খেলার কী যায়-আসে? অনেক প্রভাব আসলে পড়ে। এখন কিন্তু আমরা ভালো অবস্থায় আছি। চোখে না পড়লেও আমরা টের পাচ্ছি। আমার মনে হয়, আর বেশি দিন না, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমরা চোখে পড়ার মতো ভালো করা শুরু করব। আসলে আমাদের অভিজ্ঞতা তো কম! এই ১০ টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি এখন সিনিয়র হিসেবে গ্রুপ ছবি তোলার সময় চেয়ারে বসি!
ডেভ হোয়াটমোরের সঙ্গে জেমি সিডন্সের তুলনা করবেন?
সাকিব: দুজনের ফিলোসপিই দুই রকম। ডেভ সবসময় একেবারে সামনের সমস্যাটা নিয়ে ভাবত। ডেভ ছিল অসাধারণ ম্যাচ ট্যাকটিশিয়ান। ফলে তাৎক্ষণিক ফলও পেত মাঝেমধ্যে। আর জেমি বাংলাদেশের ক্রিকেটটাকেই উন্নত করতে চাচ্ছে। এটা একদিনে হবে না। উন্নতি হবে, কিন্তু একটু আস্তে। গ্রাফের দাগটা অনেক সরল হবে। আজ ভালো, কাল মন্দ; তা না। ম্যাচ ট্যাকটিকস ওরও আছে, সেটা এখনো কাজে লাগাতে চাচ্ছে না।
নিজের কথায় আবার ফেরা যাক। ক্যারিয়ার শেষে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
সাকিব: আমি রেকর্ড, পরিসংখ্যান, র্যাঙ্কিং নিয়ে ভাবি না। আমার কাছে ক্রিকেট মানে, কোনো ডিপার্টমেন্টে ছাড় দেওয়া যাবে না। আমি স্বপ্ন দেখি, আমাকে আন্তর্জাতিক সব ক্রিকেটার তিন ভূমিকাতেই মনে রাখছে। বোলাররা বল করার সময় ভাববে, ব্যাটসম্যানরা আমার বল খেলতে গিয়ে ভাববে আবার আমার ফিল্ডিং পজিশনে বল পাঠিয়ে রান নিতে গিয়ে ভাববে।
কী স্বপ্ন দেখেন?
সাকিব: অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। আমার স্বপ্ন হলো…পারলে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন আছে।
৫ জানুয়ারি, ২০০৯; হোটেল শেরাটন, ঢাকা
প্রথম প্রকাশ: প্রথম আলো